স্বার্থের খাঁচায় বন্দী নাগরিক জীবনে নিজেকে ছাড়া চিন্তা করার বিলাসিতা আমাদের নেই। জীবনকে টেনে নিয়ে ছুটে চলা এই আমরা যেন কিছু দেখেও দেখি না, বুঝেও বুঝতে চাই না। নানা কৃত্রিম সংকটে আমাদের বর্তমানে ব্যস্ত রাখা হয়।
অন্যদিকে ভবিষ্যত যে আরও অনিশ্চিত করা হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তার, কথার, প্রতিবাদের ফুসরতটুকুও আমাদের হয় না। দৃশ্যমান সঙ্কটে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে অদূরের অদেখা সংকট আমাদের গায়েই লাগে না। এই সুযোগেই কিছু ‘নগদ প্রাপ্তি’র আশা দেখিয়ে সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিশ্চিত হুমকিতে ফেলে গড়ে উঠছে বিশাল কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এটি শুধু ৫ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার একমাত্র অবলম্বনই নয়, এটি প্রাকৃতিক দূর্বিপাক থেকে আমাদের রক্ষা পাবার একমাত্র সহায়।
সিডর-আইলার উন্মত্ততা আমাদের কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে যেত যদি না সুন্দরবন বুক চিতিয়ে বাধা হয়ে না দাঁড়াত। প্রকৃতির রুষ্ঠতা থেকে এই বন বরাবরই আমাদের রক্ষা করেছে। নীরবে আমাদের অর্থনীতিতে রেখে চলছে বিরাট অবদান।
আমরা এবার সেই বনটিকেই হত্যা করতে যাচ্ছি রামপাল প্রকল্পের মাধ্যমে। বিশাল এই প্রকল্প কাজে ইতোমধ্যেই অধিগ্রহণের নামে জোর করে দখল করা হয়েছে ১৮৩৪ একর জায়গা। মাটি ভরাটের যে প্রারম্ভিক কাজ চলছে তার মাধ্যমে দূষণ চক্র ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
প্রতি বছর লক্ষ টন ধান আর হাজার টন মাছের উৎপাদন জলাঞ্জলি দিয়ে যে বিশাল কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে ভারত হয়েছে আমাদের ব্যবসায়িক অংশীদার। এ প্রকল্পে ভারত বিনিয়োগ করবে মাত্র ১৫ শতাংশ। ৭০ শতাংশ ভারতেরই কোন ব্যাংক হতে উচ্চসুদে ঋণ করা হবে বলে ধারণ করা হচ্ছে।
এখানে ভারত যন্ত্রপাতির ব্যবসা করবে, কন্সালটেন্সি ফি কামাবে, কর অবকাশ সুবিধা পাবে, উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারত নির্ধারিত দামেই আমাদের কিনতে হবে। সুন্দরবনের সহ সকল ক্ষতির দায় বর্তাবে বাংলাদেশের উপর। কিন্তু প্রকল্পের মুনাফা আবার সমানভাগেই ভাগ হবে।
অথচ জ্বালানী ব্যবস্থায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য একটি রাষ্ট্রের যা যা প্রয়োজন বাংলাদেশে তার কোনটারই কমতি নেই। এ কথা প্রচলিত এবং অপ্রচলিত উভয় প্রকার জ্বালানীর ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। আমাদের বিস্তীর্ণ সমুদ্র সীমানায় গ্যাস প্রাপ্তির অমিত সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না।
এছাড়া পঙ্গু করে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স-পেট্রোবাংলাকে। দেশী-বিদেশী লবিস্টদের চাপে সাগরের গ্যাস ব্লক বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেবার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের উত্তরাঞ্চলের বিশাল কয়লার মজুদ আধুনিক উপায়ে ‘আন্ডার গ্রাউন্ড গ্যাসিফিকেশন’ এর মাধ্যমে ব্যবহারের দিকে না যেয়ে ভূঁইফোড় অনভিজ্ঞ বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে যাদের প্রধান লক্ষ্য পরিবেশ প্রতিবেশের কথা চিন্তা না করে ২ লক্ষ মানুষকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে উন্মুক্ত কয়লা খনি প্রকল্প চালু করে দ্রুত মুনাফা করা।
আমাদের বিশাল পশু সম্পদ আর পোল্ট্রি শিল্প কাজে লাগিয়ে সামান্য অবকাঠামো উন্নয়নে বর্তমান অবস্থাতেই পাওয়া সম্ভব কমপক্ষে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এছাড়া প্রতিদিন তৈরী হওয়া বর্জ্যের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরীর সম্ভাবনা তো রয়েছেই।
বাংলাদেশে বছরের প্রায় ৩০০ দিন প্রখর সূর্যালোক থাকে যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বিরল। ব্যাটারিবিহীন গ্রিড কানেক্টেড সিস্টেমে মিনিগ্রিড ব্যবস্থার মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন খুবই সম্ভব। অথচ তা না করে এই সোলার সিস্টেমের ব্যবসা ছেড়ে দেয়া হয়েছে অনভিজ্ঞ-ব্যবসায়িক নীতি বিবর্জিত বিভিন্ন কোম্পানির হাতে যারা উচ্চমূল্যের ব্যাটারিকেন্দ্রিক ব্যবসায় কোটি কোটি টাকা অযৌক্তিক মুনাফা করছে।
আর অন্যদিকে চাপিয়ে দেয়া দাম বৃদ্ধির ফলে সোলার সিস্টেম আশানূরুপ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না।
বাংলাদেশে সুবিস্তৃত উপকূলীয় অঞ্চলে বাতাসের বেগ সারা বছর জুড়ে গড়ে ৫ মি./সে. যা কিনা বায়ুবিদ্যুত প্রসারে খুবই উপযোগী। অথচ এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কোন উদ্যোগ নেই।
আমাদের দেশে নদীগুলোর বর্তমান প্রবাহতেই শুধুমাত্র কিছু টাকা ব্যয়ে ড্রেজিং করে এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে কোনরূপ বাধ নির্মাণ না করে ‘রান অফ দ্য রিভার’-এর মাধ্যমে কম করে হলেও প্রাথমিকভাবে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা বছর ধরে পাওয়া সম্ভব। এতে করে যেমন নদীর নাব্যতা বাড়বে তেমনি নদীগুলো আবার মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু এ ব্যপারে কোন উদ্যোগ নেই, ঠিক যেমনটি উদ্যোগ নেই মাটির নীচের তাপ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও।
ভারত বাংলাদেশের পরিবেশ বিপন্নকারী প্রকল্পের লাভের গুড় খেতে চলে এলেও আইন অনুসারে ভারত নিজের দেশে এমন প্রকল্প করার কথা চিন্তাও করতে পারত না। সেখানে জীববৈচিত্র্য সম্পন্ন কোন এলাকার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এমন কোন কেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব নয়। সুলভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু উপায় থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নের পথে না গিয়ে কেন সুন্দরবনকে নিশ্চিত হুমকিতে ফেলে এরকম ব্যয়বহুল একটা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, কার স্বার্থে কী হচ্ছে-এসব নিয়ে আছে চরম অনিশ্চয়তা আর সীমাহীন শঙ্কা।
তবে এই হতাশার মাঝেও আশার ধ্রুবতারা হয়ে এগিয়ে এসেছেন মহৎপ্রাণ কিছু মানুষ। এর মাঝে আছেন ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী সহ নানা স্তরের মানুষ।
রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে বিভিন্ন সংগঠন ভিত্তিক উপায়ে, সবাইকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে গড়ে উঠছে পাঠাগার কেন্দ্রিক আন্দোলন। এখনও আশার শিখা হয়ে সমাজে জ্বলতে থাকা এই স্বার্থত্যাগী মহানুভবদের থেকেই দেশপ্রেমের আলো ছড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে।
আমাদের সুন্দরবন আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবনের উপর আমাদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত। আমরা কারো কাছে এই বন ইজারা দেইনি যে যার খুশি মত একে নিয়ে যাচ্ছেতাই খেলায় মেতে উঠবে। প্রভুদের গায়েবী আশ্বাসের বিশ্বাসে আর কাজ নেই।
সুন্দরবন রক্ষার সংগ্রামী আলোর অগ্নিশিখা জ্বলে উঠুক সবার মাঝে- ছড়িয়ে যাক দক্ষিণ থেকে উত্তরে, হাতে হাত রেখে একেক জন হয়ে উঠুক বন বিবির যোদ্ধা- এটাই এখন একমাত্র চাওয়া।
• লেখক- মওদুদুর রহমান
প্রকৌশলী, পুনর্নবায়ন যোগ্য জ্বালানী-বিশেষজ্ঞ।
রিনিউয়েবল এনার্জি পিপলস এসেম্বলির (আরিপিএ) বাংলাদেশ প্রতিনিধি।
সুত্র- পরিবর্তন