প্রচ্ছদ / লেখালেখি / অণুকথা / প্রকৃতির মৃত্যু হলে মানুষ কি মানুষ হয়ে বাঁচে !

প্রকৃতির মৃত্যু হলে মানুষ কি মানুষ হয়ে বাঁচে !

ফররুখ হাসান জুয়েল
Jewelসব বেদনা কি বর্ণমালা পায়? সব কষ্ট কি অশ্রু হয়ে ঝরে? হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ কি ইতিহাস হয়? মনের অহমিকা নিভে গেলে কোথাও কি আঁধার নেমে আসে? নদীর জীবন থেমে গেলে কি মানুষ মানুষ থেকে দূরে সরে যায়থেমে যায় কি রাতের মতো মানুষের জীবনপাল্টে ফেলে কি মানুষ তার ভেজা মন?
শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার যে বিষয় নিয়ে কথা সে বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। ব্যাপক পড়াশুনা অনুসন্ধান কার্যক্রমও আমার নেই। এমনকি সুনির্দিষ্ট তথ্যও আমার হাতে নেই। অতএব অনেক কথাই ভূল প্রমাণিত হতে পারে। কথাগুলো যে একদম নতুন তাও নয়। এমন নয় যে, এই কথাগুলো কেউ কখনও ভাবে নি।
কথাগুলো, ভাবনাগুলো হাটেমাঠেঘাটে সবসময় বিচরণ করে বেড়ায়। কখনও কখনও ভদ্রলোকদের সভা সেমিনারেও স্থান করে নেয়। আমার কথারভাবনারচিন্তার সাথে কারো কারো অনেক খানি মিলে যেতে পারে। আবার একদমই না মিলতে পারে। কেউ কেউ হয়ত একদম নাকচ করে দিতে পারেন আমার চিন্তা। তারপরও আমাদের মধ্যে কথা হতে পারে। পরস্পর বিরোধী মত নিয়েই হতে পারে সে আলোচনা, আলোচনা হতে পারে সভাসেমিনারআড্ডায়। আলোচনা শেষে আমরা একমত নাও হতে পারি। তারপরও আলোচনা জরুরি। বিষয়টা যখন জীবিকা নিয়েজীবন নিয়েজীবনের টিকে থাকা নিয়ে, তখন মুখ বন্ধ করে থাকাটাই হবে বোকামি।
না, এমন নয় যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই চিন্তায়। চিন্তার পরিসর তার চেয়ে অনেক ছোট। ভাবনার ক্ষেত্রটা বাগেরহাটের প্রাকৃতিক জলাশয় আমাদের জীবিকার অন্যতম মাধ্যম চিংড়ী ঘের নিয়ে। আর সেই কেন্দ্রীক সরকারিবেসরকারি উন্নয়ন চিন্তা নিয়ে।
ভৈরবে (দড়াটান) বুকে বাগেরহাট শহর।
ভৈরবে (দড়াটান) বুকে বাগেরহাট শহর।
অনেক দিন ধরেই আমাদের নদী নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে (আমাদের নদী বলতে বাগেরহাট শহরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দড়াটানা/ভৈরব, যাত্রাপুর বাজার থেকে ফকিরহাট চিতলমারির সংযোগস্থল গোদাড়া পর্যন্ত চিত্রা নামে প্রবাহিত নদী) এই নদীতে প্রতি বছর বর্ষার সময় জোয়ার পানি ঠেকানোর জন্য কাজ হচ্ছে। পানিতে লবণাক্ততা নিয়ে চিন্তা ভাবনা কম হচ্ছে না। কথা হচ্ছে আমাদের চিংড়ী ঘের এর পক্ষে বিপক্ষে। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি লবণাক্ততা নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তার সমাধানের জন্য ছোটবড়সাময়িকদির্ঘস্থায়ী নানা পরিকল্পনা, তার বাস্তবায়নের কাজ কম চোখে পড়ে না। সে সমস্ত উদ্দ্যোগে আমাদের সরকারিবেসরকারি বাজেট কম খরচ হচ্ছে না। এমনকি এই সব কথা বলে কিছু কিছু এন.জি. কিভাবে বিদেশী ফান্ড আনা যায় তার চেষ্টার ত্রুটি করছে না।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বঘোষিত একমাত্র ত্রাণকর্তা এন.জি.ও(NGO) গুলোর কর্তা ব্যক্তিরা চিন্তায় অস্থির হয়ে কপালে ভাজের সংখ্যা কম তৈরী করছেন না। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় এন.জি. গুলোর বোতলজাত পানিবিরানীর প্যাকেট সমৃদ্ধ সেমিনারের উৎসবও কম দেখি না। এত কিছুর পরও বিপদ কমার কোন লক্ষণ আমরা দেখছি না। কোন কোন পরিকল্পনায় সাময়িক উপকার হলে পরে তা কাজে লাগছে না অথবা সেই পরিকল্পনায় নতুন কোন সমস্যা তৈরী হচ্ছে। আবার এমনও হচ্ছে যে সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য আমি যে কাজ করলাম সেই কাজের ফলেই যে আমার সমস্যায় ছিলো না, তাকে আমার সমস্যায় ফেলে দিলাম।
যে নদী নিয়ে কথা হচ্ছে তা বিশাল কোন নদী নয়। অনেক বড় বড় ঢেউ এই নদীতে ভেঙ্গে পড়ে না। এই নদীর তীব্রতা রাতে পাড় ভেঙ্গে মূহুর্ত্বেই গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে না।নদীর দুই পাশের অথবা আরো ভেতরের গ্রামগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা যে একদমই খারাপ তাও নয়। তারপরও এই নদীর ১৬১৭ কিলোমিটারের মধ্যে চারটি কনক্রীট ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে।
দড়াটানায় প্রথম ব্রীজটার ৪ কিলোমিটার দূরে ২য় (মুনিগঞ্জ), তার / কিলোমিটার দূরে হদেরহাটে ৩য় এবং / কিলোমিটার দূরে উজলপুরে ৪র্থ টি।এর পাশাপাশি নদীর দুপাড় জুড়ে একের পর এক বেড়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছেহচ্ছে। নদী থেকে সৃষ্ট খালের মুখে তৈরী করা হচ্ছে স্লুইচ গেট।
ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্যে। ভেড়ী বাঁধ, স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হয়েছেহচ্ছে জোয়ারের পানি, লবণাক্ততা মৎস্য ঘের ঠেকানোর জন্য। জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশের ফলে বসবাসব্যবসাবানিজ্যেসবকিছুতেই চরম অসুবিধা তৈরী করে। লবণ পানি ফসলের ক্ষতি করে, সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সব বিষয়ে কি একটু অন্যভাবে ভাবা যায় না? আগেই বলেছি চিন্তার সাথে দ্বিমত থাকতে পারে। চিন্তায় চিন্তায় সৃজনশীল স্বতস্ফুর্ত দ্বন্দ্বই সমাধানের পথ দেখায়, সভ্যতার অগ্রগতি ঘটায়।
আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য চারটি ব্রীজ করলাম। বরিশাল বিভাগের সাথে যোগাযোগের জন্য দড়াটানা ব্রীজ হয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বাকি তিনটা ব্রীজ আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কি এমন ভূমিকা রাখছে? তিনটা ব্রীজ নির্মাণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে ক্ষতি হয়েছেহচ্ছেহবে তার অনেক কম অর্থ ব্যয় করেপ্রকৃতির অনেক কম ক্ষতি করে স্থলভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালে কি আমাদের সবদিক বিবেচনায় উপকার হতো না?
আগেই বলেছি জোয়ারের পানি ঠেকানোর জন্য আমরা একের পর এক ভেড়ী বাঁধ, স্লুইচ গেট নির্মাণ করছি। আমরা সভাসেমিনারমিডিয়ার বিভিন্ন আলোচনায় প্রতিনিয়ত শুনছি সমস্ত পৃথিবীতে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর জমাট বরফ গলতে শুরু করেছে। ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং সেই পানির চাপ আমাদের নদীর উপর পড়ছে। আই.পি.সি.সি. সমীক্ষা মতে ১৯৯০ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সমুদ্রের উচ্চতা বাড়তে পারে ২০ সেন্টিমিটার।
বিষয়টি অবশ্যই বিপদের। কিন্তু আমাদের নদীতে কি দেখছি। গত ১৫ বছর আগে জোয়ারে যে টুকু পানির উচ্চতা নদীতে দেখা যেত তার চেয়ে / ফুট পানি এখন বেশী দেখা যায়। বিষয়টা একটু অন্যভাবে দেখি। বাগেরহাট দড়াটানা ব্রীজ থেকে গোদাড়া গেট পর্যন্ত (গোদাড়া, ফকিরহাট চিতলমারির সংযোগস্থল, যেখানে এই নদী চিত্রা নাম নিয়ে শেষ হয়েছে) এই ২০/২২ কিলোমিটার নদীপথ।
এই নদী পথে নদী সৃষ্ট কয়টি খালউপখাল আছে, তার মোট সংখ্যা আয়তন কত তা আমার জানা নেই। তবে চলতেফিরতেঘুরতে যা দেখেছি তাতে নিশ্চিত করে বলা যায় আমাদের খাল গুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা নদীর চেয়ে অনেক বেশী। আর নদীখালের পাড়ে যে ধানের ক্ষেত, যেখানে জোয়ারের সময় স্বাভাবিক ভাবেই পানি ধারণ করত তার হিসাব ধরলে নদীর জোয়ারের এত ভয়ংকর রূপ দেখা যেত না।
অথচ যে সময় জোয়ার আসে তখন খালগুলোর মুখে স্লুইচ গেট থাকার কারণে পানি ঢুকতে পারে না। আবার গেট যদি খোলা থাকে পানি প্রবেশের জায়গা সংকীর্ণ থাকায় খালের পানির উচ্চতা নদীর পানির চেয়ে অনেক কম থাকে। আবার নদী খালপাড়ের ধানের জমিতে অধিকাংশ জায়গায় চিংড়ী চাষের ঘের হওয়ায় জোয়ারের পানি যে গতিতে যে পরিমাণে সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে যেত, তা পারছে না।
ফলে নদীর জোয়ারের সময়কাল বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি জোয়ারের পানিও নদীর অনেক বেশী ধারণ করতে হচ্ছে। পানি নিচু জমিতে প্রবাহিত হওয়ায় স্বাভাবিক ধারা রক্ষা করতে অপেক্ষাকৃত উচু জমিতে ঢুকে যাচ্ছে। আর সেই পানি থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাটহাটবাজারবাগানবাড়িফসলি জমি। আর সেই সব রক্ষা করার জন্য নির্মাণ করে চলেছি একের পর এক ভেড়ী বাঁধ। আমরা সম্পদ রক্ষার জন্য বাঁধ দিচ্ছি সেই বাঁধ আরেক জনের উপর জোয়ারের পানির চাপ বৃদ্ধি করছে। সে আবার বাঁধ সৃষ্টি করে আরেক জনের বিপদ সৃষ্টি করছে। এই বিষয়টা এখন চক্রাকারেই শুরু হয়েছে।
নিজের সুখের জন্য অন্যের ঘাড়ে বিপদ চাপিয়ে দেওয়ার এক কুৎসিত সংস্কৃতিতেই কি আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি না? বাঁধ নির্মাণ, পূণঃনির্মাণের যে খেলা চলছে তাতে অচিরেই হয়ত দেখা যাবে নদী আমাদের বসত ভিটাফসলি জমি থেকে অনেক উচুতে অবস্থান করছে।যদিও প্রশ্ন আছে নদী কি ততদিন বেঁচে থাকবে? নদী যদি থেকেই যায় তখন ভরা বর্ষায় আমাদের অবস্থাটা কি হবে? তখন তো প্রতিদিন বৃষ্টি হবে। আমাদের ফসলের জমি ডুবে যাবে। ডুবে যাবে আমাদের বসত ভিটা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নদী খাল না থাকায় অথবা অনেক উঁচুতে থাকায় আমরা বাঁধ গুলো কেটে দিতে পারবো না, কেননা তাতে কোন উপকার হবে না বরং বিপদ আরো বাড়বে।

কথা
প্রসঙ্গে হয়ত লবণ পানির বিষয়টা সামনে চলে আসবে। ২০/২৫ বছর আগে কি আমাদের এই নদীতে লবণ ছিল না? ছিলো (তবে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মত অনুযায়ী স্বাভাবিক গতিতে লবণ পানি আসাযাওয়া করলে তাঁকে পরিবেশের জন্য লবণাক্ত আগ্রাসন হিসাবে ধরা যায় না। বরং কোন ভাবে কোন পরিবেশে স্থায়ী ভাবে স্থবির অবস্থায় লবণ পানি আটকে গেলে তা থেকে লবণের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করে) কিন্তু আগে ছিলো মিষ্টি পানির প্রবাহ। বর্ষার শুরুতেই মধুমতির পানির প্রবাহ অধিক পরিমাণে এসে মিশত আমাদের নদীতে।
ফলে গরমের শুরুতে মাস তিনেক লবণের প্রাধান্য থাকলেও বর্ষার শুরুতেই তা কমে যেত।
মধুমতি নদী
মধুমতি নদী
মিষ্টি পানির চিংড়ী ঘের রক্ষার জন্য অপরিকল্পিত রাস্তাঘাটস্লুইচগেটকালভার্ট নির্মাণ করে আমরা সেই মধুমতি থেকে কোদালিয়া সকুনিয়া বিলের মধ্যে থেকে আমাদের নদীর মিষ্টি পানির প্রবাহে ভূমিকা রাখা খালগুলো (জয় খাঁ, কাটাখালি, ঠাকুরবাড়ী, দাইবাড়ী, মাঝিবাড়ী, হক ক্যানেল, গোদাড়া, নারানখালী সহ মোট ১৮টি বড় খাল) হত্যা করেছি। মধুমতির শাখা নদী ছোট বলেশ্বরও এখন অপেক্ষায় মৃত্যুউত্তর শোক সভার
আমাদের জনপদে প্রাণদায়ী এইসব জলাশয় চিরতরে হারিয়ে গেলে আমরা কি ভাবে টিকে থাকবো? প্রশ্নটা যদি হয় জীবনেরজীবনের টিকে থাকার, সবুজের অহমিকা নিয়ে হেটে চলার তখন আলোচনা হওয়াটা জরুরি।

আলোচনা
জরুরি আমাদের মাছ চাষ, বিশেষ করে চিংড়ী ঘের নিয়েও। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই চিংড়ী চাষ শুধু আমাদের এই এলাকা নয় বরং জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। তারপরও চিংড়ী চাষ নিয়ে কতগুলো প্রান্তিক চিন্তা আমরা করতে পারি কি না? সেইসব চিন্তা এক করে লাভক্ষতি কি হচ্ছে তা আমরা ভাবতে পারি কি না?
নদীর আলোচনায় এসেছে আমাদের জোয়ার ভাটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নদী খালের দুই পাশের ধানের জমিতে ঘের তৈরী হওয়ায় পানি কি ভাবে আমাদের জন্য বিপদ তৈরী করছে। আরো কতগুলো বিপদ একটু ভেবে দেখি। ঘেরে লবণ পানি অনেক দিন আটকে থাকায় মাটিতে যে লবণ বসে যাচ্ছে তাতে ফসলের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে? সেই লবণাক্ততা আমাদের নারকেল সুপারি সহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদনের কতটুকু ক্ষতি করছে? কতটুকুই বা ক্ষতি করছে আমাদের ধান সহ অন্যান্য ফসলের? ঘেরের কারণে ছোট ছোট জমির মালিকরা যে জিম্মি হয়ে জমি হারাচ্ছে বড় জমির মালিকদের কাছে তার ক্ষতিই বা কতটুকু? ঘেরের জন্য যে কৈ, শিং, মাগুর, রয়না, খলিশা সহ প্রভৃতি মিষ্টি পানির মাছ বিলুপ্তির পথে তার কি হবে? সেই সব মাছ শিকার করে যারা জীবিকা নির্বাহ করত তাদের ঘর সংসারের আলোর উজ্জ্বলতা এখন কেমন? মাছের খাবার যোগান দিতে গিয়ে চালগমের চাহিদা কতটুকু বৃদ্ধি করেছি? মাছের খাবার হিসাবে যে শামুক নিধন হচ্ছে, সেই শামুক প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় কতটুকু জরুরী ছিলো? চিংড়ীর পোনা ধরতে গিয়ে অন্যান্য মাছের পোনা যে মারা যাচ্ছে তার ক্ষতি কতটুকু? জোয়ারের পানিতে ঘেরে ঢুকে যাওয়া নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ (টেংরা, বেলে, পারশে প্রভৃতি যাকে আমরা সাদা মাছ বলি) যে ঘেরেই বড় হচ্ছে তার মালিকানা তো ঘের মালিক হয়ে যাচ্ছে।
অথচ তার জন্য কি ঘেরে তেমন কোন বিনিয়োগ করতে হয়েছিল? নদীর মাছ তো নদীতেই থাকার কথা ছিলো। যারা স্বাভাবিক ভাবে মাছ শিকার করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করত, সেই মাছের মালিকানা ঘের মালিকদের হয়ে যাওয়ায় সেইসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনীতি এখন কেমন? ঘের মালিকদের মাধ্যমে একসাথে অধিক সংখ্যক সেই মাছ শিকারের ফলে সংরক্ষণের মাধ্যমে বাজারে বিক্রি করায় মাছের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা? তাতে আমাদের মাছ থেকে পাওয়া পুষ্টিতে ঘাটতি পরছে কিনা? ঘেরের কারণে পিতাপুত্রের প্রতি, ভাইভাইয়ের প্রতি, বন্ধুবন্ধুর প্রতি যে বিশ্বাসভালবাসা হারিয়ে ফেলছে তার সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষতিই বা কতটুকু?
ঘেরের কারণে গ্রামের বাড়ীতে বাড়ীতে হাঁস মুরগি পালন কমে গেল, আর তাতে আমাদের গ্রামের প্রান্তিকতম জনগোষ্ঠী নারীদের অর্থনৈতিক নূণ্যতম স্বাধীনতা কমে গেল তারই বা কি হবে? ঘেরের কারণে ধানসহ বৈচিত্র্যময় ফসলের রূপ রস গন্ধ থেকে কি আমরা বঞ্চিত হচ্ছি না? এই রংরূপরস যদি হারিয়ে যায় আমাদের সাহিত্যের উপাদানের ভবিষ্যৎ কি? প্রকৃতির ছোয়াহীনছায়াহীনরূপহীন মানুষ কি মানুষ কে ভালবাসতে পারবে? ঘেরের আলের কারণে আমাদের ফসলি জমি কতটুকু কমে গেল, আমরা কি একটু হিসাব মিলাব? ঘেরের আলের কারণে বিশাল বিশাল বিল খন্ড বিখন্ড হয়ে বিশালতা দেখার দ্বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার কি হবে?
জল থৈ থৈ বিল, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ দেখে কি আমাদের হৃদয়ের বিশালতা তৈরী হতো না? বিশালতার জায়গা ধ্বংস হলে আমাদের বড় মনের মানুষ কিভাবে তৈরী হবে? বড় মনের মানুষ ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ কি? প্রতিকূলতায় লড়াই করে বাঁচতে হয়। তারুণ্যে এই শিক্ষার প্রথম পাঠ তো নদীর উজানে সাঁতার কেটেই আমরা নিয়েছি। ২৫ বছর পর কি সেই তরুণ আমরা খুজে পাব? তারুণ্যের দু:কষ্টপ্রেমপ্রণয়ের নানা অভিমানে যে নদী আমাদের আপন করে নেয়, নদী না থাকলে তখনকার তরুণ কোথায় যাবে?
একটি দেহের একটি মাত্র হাত সচল রেখে বাকি সব ক্রিয়াশীল অঙ্গ ধ্বংস করে আমরা কত দিন টিকে থাকতে পারব? দেহের কোন একটি অঙ্গ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে সেখানে ক্যানসার বাসা বাঁধার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের চিংড়ী ঘের কি সেই অভিজ্ঞতা দিয়ে যাবে না?

ইতিমধ্যে
লবণ পানি নির্ভর চিংড়ী চাষ এলাকাগুলো থেকে ভয়ংকর সব সংবাদ আসতে শুরু করেছে। জমিতে মাছ চাষে লাভ হচ্ছে না আবার ফসল হচ্ছে না। ভাবার কোন কারণ নেই মিষ্টি পানিতে চিংড়ী চাষ হলে কোন ক্ষতি হবে না। সেইসব ঘের রক্ষার জন্য নদী খালে বাঁধ দেওয়া স্লুইচগেট নির্মাণের কারণে স্থায়ী জলবদ্ধতা তৈরী হওয়া হয়ত দ্রুতই শুরু হবে। তাহলে সমাধানের এখন উপায় কি? না এতবড় চিন্তার আয়োজন আমার প্রতিভায় কুলায় না।
আমি শুধু যা কিছু দেখতে দেখতে বড় হয়েছি তার কথাই বললাম। আমার কথাগুলো অনেকটাই বাগেরহাট সদর থানার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী খাল নিয়ে, তার পাশে গড়ে ওঠা জনপদ নিয়ে, আর সেই জনপদের অর্থনৈতিক জীবনে কিছু অংশের চিত্র নিয়ে।
আমরা কি আমাদের জেলার অন্যান্য নদীখালবিলফসলের মানচিত্রে খুব বেশী পার্থক্য খুজে পাব?
একটু চোখ মেলে তাকাই ২৫ বছর পর। নদীর স্বাভাবিক জীবনের জন্য ক্ষতিকর নানা পরিকল্পনায় নদী প্রায় শুকিয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। দির্ঘদিন ধরে চিংড়ী চাষ করতে করতে, লবণ আর কীটনাশকের অত্যাচারে ধান ক্ষেতে ধান আর সোনা রং ঝরায় না। আসপাশের চাষ যোগ্য জমিও সেইসব অত্যাচারে ফলহীনফসলহীনসবুজহীন।
এরই মধ্যে নদী খাল ভরাট হওয়ায় বর্ষার পানি সরে যেতে না পারায় আমাদের মাঠ ঘাট বসত ভিটা সব ডুবিয়ে রেখেছে। আমাদের সন্তানরা স্কুলে যেতে পারে না। কর্মক্ষম মানুষগুলোর কাজের অভাবে খাবার জোগাড় করতে পারছি না। আমরা স্বজনের লাশ দাফন করার জায়গা পাচ্ছি না। কেমন হবে তখন?

দাতা
সংস্থা, সরকারি বেসরকারি পরিকল্পনাবিদ, গোলটেবিল বৈঠকী বাহিনী, উন্নয়ন চিন্তার ত্রাতা এনজিও উন্নয়ন চিন্তায় আমাদের জীবন লুটপাট হওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন। আমরা কি সেই আয়োজনে গা ভাসাবো?

লেখক – রাজনীতিক ও সমাজ কর্মী।
E-mail: jewel_cpb@yahoo.com

About Bagerhat Info Blog