“রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি,
তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।”- চারণ কবি শামসুদ্দিন আহমেদ
‘রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও করিলিরে বাঙলী,
তোরে ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।
ও বাঙ্গালী…ও ওওও।
তোতা পাখী পড়তে আইসা খোয়াইলি পরান,
মায় সে জানে পুতের বেদন,… যার কলিজার জান।
….. ইংরেজ যুগে হাটুর নীচে চালাইতো গুলি,
স্বাধীন দেশে ভাইয়ে ভাইয়ের ওড়াই মাথার খুলি,
তোরা ঢাকা শহর রক্তে রাঙ্গালি।’
মহান ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগের মহত্ত্ব তুলে ধরে এই মর্মস্পর্শী গানের রচয়িতা বাগেরহাটের চারণ কবি শামসুদ্দিন আহমেদ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলের সময় পাক সেনাদের নির্বিচার গুলিতে ঢাকার রাজপথে ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনার দিনই (২১শে ফেব্রুয়ারি) রাতেই বাগেরহাটের চারণ কবি শেখ সামছুদ্দিন আহমদ “রাষ্ট্রভাষা” নামে রচনা করেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানটি।
পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাগেরহাটের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্তক ধর্মঘট পালন শেষে সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক (সিসি ব্যাংক) মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশে নিজের লেখা গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন ছাত্র-জনতাকে।
`রাষ্ট্রভাষা‘ গানটি তিনি প্রথমে নিজের মতন করে লোক সুরে গেয়েছিলেন। পরবর্তিতে শামসুদ্দিন আহমেদ রচিত গানটি সুর করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ এবং প্রথম কণ্ঠ দেন রথীন্দ্রনাথ রায়। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা নিয়ে লেখা হলেও এ গান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
শুধু বাগেরহাটবাসী নয় তার এ গানের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের মত সারা দেশ ও বিশ্বের কাছে চির দিন অমর হয়ে থাকবেন তিনি।
কবি শামসুদ্দিন আহমেদ-
কবি শামসুদ্দিন আহমেদ বাগেরহাটের স্বনামধন্য লোককবি। ১৯১৫ সালে বাগেরহাট জেলা শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পূর্বে ফতেপুর গ্রামে জন্ম করেন তিনি। তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট টাউন স্কুলে (বর্তমান বাগেরহাট বহুমুখি কলেজিয়েট স্কুল)। এখান থেকেই তিনি জুনিয়র পাস করেন। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি। তবে ছোটবেলা থেকেই তার ছিল কবিতা ও গানের প্রতি অসাধারণ ঝোঁক। বাল্যকাল থেকে তিনি ছিলেন পল্লীগীতির সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের ভক্ত।
পেশায় তিনি ছিলেন এক জন ক্ষুদ্র ব্যবসয়ী। কেউ কেউ তাকে তেল বিক্রেতা বলে উল্লেখ করেন। আবার কারও কারও মতে তিনি হাটে-বাজারে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রী করতেন আর গান বাঁধতেন।
জানা যায়, সে সময় তিনি শহরের বিভিন্ন স্থানে তার ‘রাষ্ট্রভাষা’ গান গেয়ে ভাষা অন্দোলন গতি সঞ্চার করেন। তার এ গান এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে স্বল্প সময়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে।
তার গানের সূত্র ধরে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালে খুলনার দি ইষ্টার্ন প্রেস থেকে পাকিস্তান পল্লীগীতি নামে তার লেখা গানের একটি সংকলন প্রকাশ হয়। সেখানে তার এই বিখ্যাত গানটিসহ মোট ১৬টি গান ছাপা হয়। যার প্রতিটি চরণে তৎকালিন পাকিস্তান সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও সমালোচনা ছিল। এ বইটি আব্বাছ উদ্দিন, কবি জসিমউদদীন এবং পিসি কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক মীর মশাররফ হোসেনসহ দেশবরণ্য লোকদের প্রশংসা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান সরকার বিরোধীদের তালিকা তৈরি করছে এ আশঙ্কায় তিনি নিজের লেখা পুড়িয়ে ফেলেন। এক প্রকার নিভৃতে ১৯৭৪ সালে তিনি মারা যান।