তখন আষাঢ় মাস। ক্লাস শেষ করে বের হতেই কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে। স্যার স্কুল শেষে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে বলেছেন। কাক ভেজা হয়ে স্যারের বাড়ি পৌছালাম। টিনের চালের ঘর স্যারের।
ভয়ে স্যারকে না ডেকে বাইরে দাড়িয়ে রইলাম। স্যার খাওয়া শেষ করে বাইরে পানি ফেলতে এসে আমাকে দেখে ভিতরে আসতে বললেন। সিড়ি পর্যন্ত আসতেই স্যার কাঁধ থেকে ব্যাগটি নিয়ে আমাকে বাড়ি যেতে বলেন। কাল থেকে যেন আর পিছনের সিটে না বসি। এটা বলতেই স্যার আমাকে বাড়ি আসতে বলেছিলেন। এই ছোট কথাটা ক্লাসে বা স্কুলে না বলে বাড়ি পর্যন্ত কেন আসতে বলেছিলেন তখন বুঝিনি। এখন বুঝতে পারি।
স্যারের প্রকৃত নামটা ভুলতেই বসেছিলাম। প্রকৃত নামটা স্যারের ব্যক্তিত্বের আড়ালে সবসময় ঢাকা ছিল। নারায়ণ কুমার মৈত্র্য। আমাদের নারায়ণ স্যার। স্যার অংকের ক্লাস নিতেন। কিন্তু ছাত্ররা তার ক্লাসে গল্প শুনতে আসতো। ইংরেজী ক্লাসে যে ছাত্ররা পিছনের সিটে বসতো স্যারের ক্লাসে সামনে বসার জন্য তারা রীতিমত লড়াই করতো। বিভূতিভূষনের ‘আরন্যক’ উপন্যাসের জয়পাল কুমারের কথা অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই স্যারের কাছে শুনেছিলাম। স্যারের ক্লাসে অংক না পারলে গল্প বলতে হতো। একবার স্যারের কাছ থেকে চুরি করা গল্পের বই থেকে গল্প বলতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলাম। শাস্তির বদলে স্যারের কাছ থেকে আরেকটা বই উপহার পেয়েছিলাম।
স্যার ক্লাসে টমাস বাটার গল্প শুনাতেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। টমাস বাটা তাঁর আত্নজীবনী লিখেছেন “Bigger the impediments and difficulties, greater are the opportunities for men of strong hearts” অর্থাৎ বাধা বিপত্তি যতই প্রচন্ড হবে, শক্তিমানের কাজ করার ততই সুযোগ আসবে। কথাগুলো এখন পড়ি। তখন শুনতাম। আজ কথাগুলো স্যারের মুখ থেকে বড় বেশী শুনতে ইচ্ছা করে।
গল্পবলা মানুষটি এখনো মনে হয় গল্প শুনান। শুনেছি স্যার অবসরে গিয়েছেন। গল্প পড়ার অনেক সময় পাচ্ছেন। কিন্তু শুনাতে না পারার জ্বালা বোধ হয় স্যারকে তাড়িয়ে বেড়ায়। স্যার, যে গল্পের বীজ আপনি আমাদের মাঝে ছড়িয়ে গেছেন তা অনাদিকাল ফল দিয়ে যাবে।…
স্বত্ব ও দায় লেখকের…