• রুতব সরকার
প্রতিটি ভাষারই আজকের অবস্থায় পৌঁছাতে যে পথচলা তাকে একটি ভ্রমন বলা যেতে পারে। আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাষা বাংলারও আজকের এই রূপে আসতে পার হতে হয়েছে বহু কণ্টকাকীর্ণ পথ।
‘কা আ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চি এ পৈঠা কাল’
আশ্চর্য হলেও এটাই ভাষা হিসেবে বাংলার পথচলার শুরুর দিকের রূপ। বাংলা সাহিত্যের শুরুর দিকের সাহিত্যকর্ম ‘চর্যাপদ’, যার লেখকেরা ছিলেন সহজিয়াপন্থি বৌদ্ধসাধক। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’; যা মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্যকর্ম বলে পরিচিত।
‘কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে’
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অন্তর্ভূক্ত এই পদগুলির রচয়িতা বড়– চন্ডিদাস। শ্রী বিদ্বদ্বলভ রায় এই পুঁথি আবিষ্কার করেন একটি গোয়ালঘরের মাচা থেকে। মধ্যযুগের অন্যান্য বিখ্যাত কীর্তির ভিতর রয়েছে মহাকবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, মঙ্গলকাব্যসমূহ। মূলত আজকের এই বাংলা ভাষা চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্যসমূহের আধুনিক রূপ।
বাংলা রচনায় গদ্যরূপ এবং যতিচিহ্নের প্রবর্তক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ ভাষায় রচিত হয়েছে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘সনেট’। ১৯১৩ সালে বাংলা ভাষার ‘গীতাঞ্জলি’ পেয়েছে নোবেল পুরষ্কার। এ ভাষায় এসেছে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দফতর’। বাংলায় ভাষায় এসেছে লালনের মরমী, রজনীকান্ত-দ্বীজেন্দ্রলালের দেশপ্রেম।
১৯৪৮ সালে যখন বাংলায় কথা বলার স্বাধীনতায় প্রথম বাধা এল, “নো-নো” বলে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৯৫২ সালে রাজপথে প্রাণত্যাগ করেছিলেন জব্বার-বরকত-রফিকেরা। সেই ফাল্গুনের বিকেলের স্মৃতি প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকবে।
এই দীর্ঘ পথচলায় বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষা আজ গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ আসনে পৌছেছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়ন বাংলাকে তাদের দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। ফলে সেখানেও বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে নানাভাবে ।
ভাষা হিসেবে বাংলা বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা। মাতৃভাষার দিক থেকে চতুর্থ এবং জনসংখ্যার বিচারে এ ভাষা সপ্তম অবস্থানে। এ ভাষায় রচিত গল্প-উপন্যাস, কবিতা-সাহিত্য, গবেষণা-প্রবন্ধ ছিনিয়ে এনেছে বিশ্বস্বীকৃতি।
কী মধুর ভাষা এই বাংলা! কবি অতুল প্রসাদ সেন তাই লিখেছেন –
‘মোদের গরব, মোদের আশা,
আ মরি বাংলা ভাষা।’
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।