• অমিত রায় চৌধুরী
বাঙ্গালির সবচেয়ে প্রিয় কণ্ঠ, প্রিয় মুখ, প্রিয় নাম-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙ্গালি বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন-তার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা, অহঙ্কারের সাতকাহন, আত্ম মর্যাদার প্রতীক-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
বাঙ্গালির ইতিহাস, পরম্পরা, ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ব সভায় সম্মানের, গৌরবের। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস, স্বামী বিবেকানন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ,কে ফজলুল হক, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা আচার্র্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখ মনীষীগণ বাঙ্গালি মননের গভীরতা, উৎকর্ষ, স্বকীয়তা ও তীক্ষ্নতার আলোকবর্তিকা বিশ্বময় সঞ্চারিত করেছেন। তবে বিশ্বব্যাপি বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত একটি জনমত জরীপে দেখা গেছে বঙ্গবন্ধু মুজিব বাঙ্গালির চেতনার রাজ্যে মুকুটহীন রাজা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি।
ভাষা, সংস্কৃতি, জীবন যাপনের ধরণ, দৈহিক ও আবেগিক গড়ন-সব কিছু বিচারে প্রায় অভিন্ন বৈশিষ্ট্য পললে পরিপাটি এক অনন্য, অবিমিশ্র জনপদ এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ আমাদের প্রিয় এ মার্তৃভূমি বাংলাদেশ। ধর্মভীরু, সরল, অতিথিপরায়ন, সংবেদনশীল, আবেগ প্রবণ, সহনশীল অথচ মেধার উৎকর্ষে দীপ্যমান, চিন্তায় অগ্রগামী, প্রাকৃতিক কিংবা আরোপিত যে কোন বৈরীতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেওয়াল তুলতে অকুতোভয়, নির্ভীক, দৃঢ় প্রত্যয়ী-এমনই এক আপাত বিপরীত অনিঃশ্বেষ শক্তি ও অনিন্দ্য সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত বাঙ্গালি জাতিসত্তার অন্তর্নিহিত পরিকাঠামো। আর সে জাতির যিনি আক্ষরিক, মনোজাগতিক ও সার্থক প্রতিনিধি, প্রতিভূ, প্রতীক; তিনি আর কেউ নন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙ্গালি তার নিজস্ব ভাষাভঙ্গি, চিন্তার আদল, ভাবনার দিশা, মেধার উৎকর্ষ, আদর্শের নৈকট্য, শ্রেণির সাহচর্য, ভরসার অবলম্বন-সব উপাদান খুঁজে পায় বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বে। তাই ৫২ এর টগবগে তরুণ মুজিব ৬৬এর ছয় দফাকে সংগে নিয়ে ‘৬৯ এ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু, ৭১ এর ৭ মার্চে হ্যামিলনের বংশীবাদক, ২৫শে মার্চের ঘোর অন্ধকারে পুরোদুস্তুুর এক যাদুকর। নেতার আদেশে হাজার হাজার নিরস্ত্র জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর ট্যাংকের সামনে, অবুঝ কিশোর তাজা রক্তের আখরে লিখে যায় মার্তৃভূমির রক্তঋণ শোধ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, অশ্রুসজল জননী প্রাণপ্রতিম সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দেন অবলীলায়, আবালবৃদ্ধ-বণিতা লিপ্ত হয়ে পড়ে সর্বাত্মক এক জনযুদ্ধে।
বিচারপতি বি,এ সিদ্দিকী তদানিন্তন পাক জেনারেল টিক্কা খানকে প্রশাসক হিসেবে শপথ বাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন, বেসামরিক আমলাগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের নয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতে থাকেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তানী জান্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, পুলিশ ই.পি.আর দুর্বার প্রতিরোধ রচনা করে, বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সকলে এ মুক্তিযুদ্ধে একাকার। এমন ঘটনা ইতিহাসে নজির বিহীন। এ যেন এক রূপকথার রাজপুত্রের সম্মোহনী কীর্তিশৈলী।
বঙ্গবন্ধুকে প্রখ্যাত বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন-আপনার সবচাইতে বড়গুণ কোনটি? স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায় চকিতে উত্তর করেছিলেন- ‘আমার দেশের মানুষকে আমি ভালবাসি।’ প্রাজ্ঞ সাংবাদিকের ফিরতি প্রশ্ন-আপনার চরিত্রের দুর্বলতা কোনটি? বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায়, সারল্যে, চরিত্রের ঋজুতায় ঝলসে উঠেন, বলে উঠলেন আমার মানুষকে আমি বড্ড বেশি ভালবাসি।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত এক ঘাতক কর্ণেল রশিদ বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে সাংবাদিকের এক ক্ষুরধার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তাকে এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনারা রাষ্ট্রপতি মুজিবকে বন্দী করে বিচারের মুখোমুখি করতে পারতেন-কিন্তু এভাবে হত্যা করলেন কেন। ঘাতক উত্তর করেছিল-তাঁকে বাঁচিয়ে রাখলে জনতাকে আমরা সামাল দিতে পারতাম না। তাই তাঁকে হত্যার কোন বিকল্প ছিলনা।
কাজেই একদিকে বঙ্গবন্ধুর আত্মোপলব্ধি, প্রত্যয়, জনমানসে তাঁর প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আর অন্যদিকে খল-নায়কের ভীরু স্বীকারোক্তি বঙ্গবন্ধুর সততা, যথার্থতা ও দেশপ্রেমেরই প্রামাণিক দলিল হিসেবে অনাগত দিনগুলিতে বিবেচিত হতে থাকবে।
মহাত্মা গান্ধী ভারতের সর্বোদয় নেতা। পশ্চিমা শিক্ষায় তিনি পরিমার্জিত ছিলেন। তাঁর নীতি, আদর্শ নিয়ে আমাদের মনে কোন সংশয় নেই। তবে এটা ঠিক যে, নিজ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাতারে আসতে গিয়ে তাঁকে চলনে, বলনে, পোশাকে, ভঙ্গিতে রূপান্তর ঘটাতে হয়েছিল, অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি হয়েও তাঁকে দারিদ্র পীড়িত ভারতীয়দের জনক হয়ে উঠতে হয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একইভাবে ভূস্বামী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ছিলেন। পশ্চিমা ভাবধারায় তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরী হয়েছিল। এমনকি ধর্মীয় মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও ব্যক্তি পর্যায়ে তিনি ছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষ, ধর্মচর্চায় ছিলেন মুক্তমনা; যা পাকিস্তান সৃষ্টি কিংবা বিশেষ করে দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল ‘স্পিরিট’ এর সংগে সাংঘর্ষিক।
বঙ্গবন্ধুকে নিজের আত্মপরিচয়, সত্তাকে কখনও আড়াল করতে হয় নি। তিনি যা, যে শ্রেণির প্রতিনিধি বা যে বিশ্বাস বা আদর্শের অনুগামী-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার মানুষ তার মাঝেই তাদের অস্তিত্বের প্রতিবিম্ব আবিষ্কার করেছিল। আর সেভাবেই তিনি হতে পেরেছিলেন গণমানুষের নেতা, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির ভাগ্য নিয়ন্তা। নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত, মার্শাল টিটো, চেগুয়েভারা, মাও সেতুং কিংবা লেনিন-এমন কালজয়ী বিশ্ব নেতৃত্বের উচ্চতাকে বঙ্গবন্ধু স্পর্শ করেছিলেন-দীর্ঘ এক সফল নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালির হাজার বছরের আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় ঘটিয়ে।
বঙ্গবন্ধু অতিমানব ছিলেন না। স্বাভাবিক রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁর মধ্যে কোন বিচ্যুতি কিংবা দুর্বলতা থাকাও অস্বাভাবিক নয়। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনামল নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যাবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে পূণর্গঠন করে প্রগতির পথে, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত করতে যা কিছু প্রয়োজন তার সবটাই তিনি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে অনুভব করতেন, দেশের ভবিষ্যতকে দেখতেন স্বচ্ছ চোখে।
দ্রুত একটি সংবিধান প্রণয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প কিংবা বিদেশনীতি-সবক্ষেত্রেই তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির প্রমাণ মেলে। দেশের উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে তিনি দারিদ্র, অশিক্ষা ও দুর্নীতিকে সনাক্ত করেছিলেন। সাদামাটা কৃষক শ্রমিকের অর্থ লোপাট করার বিরুদ্ধে তিনি সমাজের অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী শ্রেণীকে সতর্ক করেছিলেন। সমকালীন বিশ্ববাস্তবতায় তিনি বাংলাদেশের করণীয় দক্ষহাতে নির্ধারণ করেছিলেন। বলেছিলেন
‘বিশ্ব আজ দু‘ভাগে বিভক্ত। শাসক আর শোষিত। আমরা আছি শোষিতের পক্ষে।’
সত্যিই তিনি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে। সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন গোটা বিশ্বের রোল মডেল।
কোটি ভক্তের ভালবাসায় সিক্ত মুজিব যেমন ‘৭১ এর ৭ মার্চ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়ে জাতিকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, ২৫শে মার্চের কালরাতে দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে জাতিকে চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছিলেন, আবার ১০ জানুয়ারি, ‘৭২ এ অশ্রুসজল নেত্রে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বলেছিলেন কবিগুরু তুমি এসে দেখে যাও-সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি প্রমাণ করেছে-তারা মানুষ হয়েছে।
এমন সম্মোহনী নেতা, এমন দার্শনিক রাজা ইতিহাসে বিরল। নিয়তির নির্মম পরিহাস বাংলার কিছু বিপথগামী নরঘাতকের হাতেই ইতিহাসের মহানায়কের রক্ত ঝরল। মুজিবের সেই তাজা রক্ত ছড়িয়ে গেল বাংলার বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে, কল্লোলিনী নদীর স্রোতধারায়, কোটি জনতার শিরা-উপশিরায়। জাগতিক মৃত্যু জনককে নিঃশেষ করেনি, বরং তাঁকে করেছে আরও ব্যাপৃত, প্রশস্ত। মুজিবের জীবন ও আদর্শ আজ গবেষকের উপজীব্য, অপার বিস্ময়ের আধার।
মুজিব আজও অন্ধকারে আমাদের পথ দেখায়। মুজিব আমাদের অনির্বাণ প্রেরণার উৎস। মুজিব বাংলার, বাংলা মুজিবের। পিতার অধিষ্ঠান বাঙ্গালির হৃদয়ে, বাংলাদেশের গোটা মানচিত্র জুড়ে।
লেখক: অধ্যক্ষ, ফকিরহাট ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়।
E-mail: principalffmmc@gmail.com