• মেহেদী হাসান সোহেল
আজ মহান মে দিবস। তথাকথিত শ্রমিক নেতারা গত এক মাস ধরে রিহার্সাল দিয়েছে আজ তা মঞ্চস্থ হচ্ছে। আবার সেখানে শ্রমিকদের নেওয়া হয়েছে হাততালি দেবার জন্য। নেতারা সবকিছু দুহাতে নিয়ে যাবে তার এসি গাড়িতে করে।
আক্কাস (জনসভায় আসা এক শ্রমিক) ভাবে কিছু পেলাম না দুঃখ নাই, কিন্তু ছুটিটা কবে নিজের মত করে ভোগ করব কবে। সে ভাবে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য সেদিন আমাদের পূর্বসূরিরা জীবন দিয়েছিল। কিন্তু আজ সেই জীবনেরই দামই নাই শাসকগোষ্ঠীর বা রাজনৈতিক দলের কাছে। তাই প্রাণ দিয়ে কোন অধিকার প্রতিষ্ঠার উপায় নাই।
ভাবে আর সামনে এগিয়ে যায় হঠাৎ মনে পড়ে ছোট বেলায় বেলায় বাবার হাত ধরে সার্কাসের কথা। কত আনন্দে কাটিয়েছি সেই দিনগুলি। হাতে হাওয়াই মিঠা নিয়ে দেখত পুতুল নাচ। কখন যে সময় কেটে যেত তা বুজতে পারত না। কিন্তু সেই আনন্দের দিনগুলোতে কখনো ভাবেনি সে হবে পুতুল নাচের পুতুল। আর তার জীবনটা হবে হাওয়াই মিঠার মত মিথ্যা আশ্বাসে ভরপুর আর প্রাপ্তি তলানিতে। হতাশা নিয়ে সমাবেশস্থল থেকে সামনে এগিয়ে চায়ের দোকানে, বসে এক কাপ চা পান করার জন্য।
দোকানির কাছে চা চেয়ে চোখ পড়ল টিভির পর্দায়। শিশুশ্রম নিয়ে প্রতিবেদনে এক সরকারি কর্মকর্তা সাক্ষাৎকার দিচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার ছেলেবেলার কথা। কত পরিশ্রমই না করতে হয়েছিল তাকে। কোন এক পহেলা মে’ -তে সাংবাদিকরা তাদের গ্রামে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টরি করে ছিল।
কিন্তু তাদের মিথ্যা আশ্বাসে আক্কাস তার পেশা ছেড়ে দেয় নি। সাথে কষ্ট করে চালিয়েছিল পড়াশুনা। ভাল কোন বিষয়ে পড়াশুনা করতে পারি নি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর গার্মেন্টস চাকরী নেয়। তখন পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া তার জন্য রীতিমত সংগ্রামে পরিণত হয়। কতবার চাকরী ছেড়েছে পড়াশুনার জন্য তবু চাকরী ছাড়েনি। যার বদৌলতে শ্রমিক থেকে আজ সহকারী ব্যবস্থাপক কিন্তু তবু ভুলে যায়নি শ্রমিক জীবনের কষ্টের কথা।
এর মধ্যে দোকানী চা দেওয়ায় স্বপ্নের ঘোর কেটে চোখ পড়ল আবার টিভির পর্দায়।
কর্মকর্তা বলছে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে শিশুদেরকে এই অমানুষিক পরিশ্রমের হাত থেকে বাচানো যাবে। আক্কাস মনে মনে ভাবে এই কর্মকর্তারা যদি তাদের ঘুষে প্রাপ্ত অর্থের সিকিভাগ যদি মানব উন্নয়নে ব্যবহার করে তাহলে আর কোন আক্কাস নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে হত না। কিন্তু সমাজপতি, রাজনীতিবীদ, সাংবাদিকরা চায় না আক্কাসদের জীবনের উন্নতি না হোক তাহলে তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
চা পান শেষে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে থাকে। তার কানে ভেসে আসতে লাগল নানান স্লোগান। সব স্লোগানে দাবী আদায়ের বানী কিন্তু সে ভেবে পায় না আজো কেন সংগ্রাম আদায়ের এই মিছিল। এই তথাকথিত শ্রমিক নেতারা আমাদের রাজনীতি থেকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এই সব নেতাদের কোনদিন কোদাল হাতে মাটি কাটতে দেখিনি, দেখিনি গার্মেন্টস এর মেশিন ঘুরাতে কিন্তু তারা এক অদৃশ্য চাকা ঘোরায় যার ফলে তাদের সম্পত্তির পাহাড় হয় আর শ্রমিকরা পরে থাকে গোলক ধাঁদায়।
এই শ্রমিকরা ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার করে মালিক সম্প্রদায়ের সাথে আবার তারাই মঞ্চে দাঁড়িয়ে মালিকের মন্ডুপাত করে আর সহজ সরল শ্রমিক তাদের কথায় তালি দেয়। শুনেছি এই শ্রমিকরা নাকি নামে-বেনামে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। আক্কাস বড়ই অবাক হয়ে যায় যখন কমিউনিস্টরা নিজেকে শ্রমিক নেতা দাবী করে। জানেনা সে কাদের সমর্থনে এই লাল বাহিনী শ্রমিকের নেতা বনে গেল যদিও এঁদের জনসমর্থন নাই। এইসব নেতাদের না আছে পেশা না আছে সমর্থক গোষ্ঠী তাহলে তাদের ঠাটবাট চলে কোথা থেকে। তখন হঠাৎ মনে পড়ল কদিন আগে বেতন বাড়ার আন্দোলন হয়েছিল। আবার অদৃশ্যের ইচ্ছায় থেমে গেল। পরে জানা গেল হঠাৎ করে বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়িয়ে দেবার জন্য শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। কোন বেতন বৃদ্ধি ছাড়া আন্দোলন থেমে যায়। আর বাড়িওয়লারা তথাকথিত শ্রমিক নেতা, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও সরকারের সাথে বৈঠকের পরে ভাড়া বাড়াইনি।
আসল কথা হল চোরেচোরে মাসতুতো ভাই, এরা একি সুতোয় বাধা পুথির মালা। যখন মালিক পক্ষ নিয়মিত ভাগা না দেয় বা পরিবারের চাহিদায় বেড়ে যায় তখন এইসব শ্রমিক নেতারা উস্কে দিয়ে ফায়দা নেয় যার ভাগা বাড়িওয়ালা, জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন সবাই পায়। শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধি চায় না, তারা চায় যে বেতন পাবে তাতে যেন তারা সচ্ছল ভাবে থাকতে পারে। জিনিস পত্রের দাম ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে এই উপমহাদেশে ৯৬ বছর মে দিবস পালন করছে।
এটা নিয়ে রাজনীতি না করলে এটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মত একটি দিবস হত। স্লোগান হত না বরং শ্রদ্ধাভরে স্মরন হত হে মার্কেটের সেই সকল শহীদদের। আলোচনা হত মানবিক উন্নয়নের গুনগত পরিবর্তন নিয়ে। এরি মাঝে তার কানে ভেসে আসল একটি গানঃ
হাকিম হইয়া হুকুম কর
পুলিশ হইয়া ধর
সর্প হইয়া দংশন কর
ওঝা হইয়া ঝাড়।
হাটতে হাটতে বাসস্টপের কাছে চলে আসল। বাস আসল কিন্তু তিল রাখার জায়গা নাই। কন্ডাকটর দ্বিগুন ভাড়া হাকিয়েছে। তবু আক্কাস বাসে উঠল সবাই কন্ডাকটরকে ধুয়ে দিল কিন্তু আক্কাস কিছুই না বলে ভাবছে আসলে আমরা সবাই সার্কাসের পুতুল নাচ খেলার পুতুল। নইলে বাস শ্রমিক কেন অন্য শ্রমিকের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে। আর শুধু একবার মঞ্চে উঠে বলতে করছে সাংবাদিকদের ডকুমেন্টারি, কর্মকর্তাদের চাটুকদার আশ্বাসে বা তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের কথার উপর ভর করে যেন কোন শ্রমিক ভুল পথে না যায়। আর লেখাপড়াকে ছাড়বেন না যে পেশা বেছে নিন মুচি কিংবা ডোম কারন বিদ্যা আপনাকে আলোর পথ দেখাবে। হঠাৎ কন্ডাকটর তার জায়গার নাম বলায় বাস থেকে নেমে গেলে।
রাস্তার পাশের গলি ধরে সামনে এগিয়ে যায় আর ভাবে এই সার্কাস বন্ধ করতে আগে নিজেকে সার্কাসের সং সেজে মালিকের কাছাকাছি যেতে হবে। নিজের অবস্থানকে সমুন্নত করতে দক্ষতার মাধ্যমে পদন্নোতি ঘটাতে হবে। কারণ সফল না হলে মঞ্চে ওঠা যাবে না আর মঞ্চে না উঠতে পারলে ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারবে না। কিন্তু তার জন্য দরকার হাজার হাজার আক্কাসের কারন একজন-দুজন কিছুই করতে পারবে না বরং সমাজের অপধারার খরস্রোতে হারিয়ে যাবে।
এত হতাশা অপ্রাপ্তির মাঝে তবু স্বপ্ন দেখে একদিন শাসকগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলগুলোর শুভ বুদ্ধির উদয় হবে মানুষের নুন্যতম বাচার অধিকার নিশ্চত হবে। সেপথে দেশ এগোচ্ছে কিন্তু খুবই ধীর গতিতে। এরি বাসার সামনে চলে আসে।
বাসার দরজার তালা খুলতে চোখ পড়ল তার হাতে লেখা পোস্টারে দিকে যেখানে লেখা “জয় হোক মেহনতি মানুষের।”
লেখক: বেসরকরি চাকুরিজীবী।
E-mail: mehdee19@gmail.com