• মেহেদী হাসান সোহেল
বাগেরহাট জেলার আরেক গুরুত্বপূর্ণ নদী মধুমতি; যা উত্তর-পূর্ব সীমানা দিয়ে প্রবেশ করে শালদাহ, কালীগঙ্গা ও বলেশ্বর নামে জালের মত ছড়িয়ে আছে।
মধুমতি নদীর মূল প্রবাহের নাম গড়াই নদী। এই নদীটি কুষ্টিয়া জেলার হতাশহরিপুর ইউনিয়নে প্রবহমান পদ্মা নদী হতে উৎপত্তি লাভ করে মাগুরা জেলারশ্রীপুর উপজেলার নাকোল ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে মধুমতি নদীতে পতিত হয়েছে। একসময় গড়াই নদী দিয়ে গঙ্গার প্রধান ধারা প্রবাহিত হতো, যদিও হুগলি-ভাগীরথী ছিল গঙ্গার আদি ধারা।
কুষ্টিয়া জেলার উত্তরে হার্ডিঞ্জ সেতুর ১৯ কিলোমিটার ভাটিতে তালবাড়িয়া নামক স্থানে গড়াই নদী পদ্মা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নদীটি কুষ্টিয়া জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গণেশপুর নামক স্থানে ঝিনাইদহ জেলায় প্রবেশ করেছে। অতঃপর ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়ে চাদর নামক গ্রাম দিয়ে রাজবাড়ী জেলায় প্রবেশ করেছে। এরপর ঝিনাইদহ-রাজবাড়ী জেলা, মাগুরা জেলা-রাজবাড়ী জেলা এবং মাগুরা জেলা-ফরিদপুর জেলার সীমানা বরাবর প্রবাহিত হয়ে মধুমতি নদী নামে নড়াইল ও বাগেরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
গড়াই নদী-মধুমতী নদীর গতিপথ আঁকাবাঁকা ও দীর্ঘ। গড়াই মধুমতি নদী নড়াইলের কালিয়া নামক স্থানে মধুমতি ও নবগঙ্গা নামে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে। গড়াই নামে ৮৯ কিমি, মধুমতী নামে ১৩৭ কিমি এবং বলেশ্বর, কালিগঙ্গা ও কচা (নদী) নামে ১৪৬ কিমি অর্থাৎ মোট দৈর্ঘ্য ৩৭২ কিলোমিটার।
উৎপত্তিস্থল থেকে কামারখালী পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে নৌকা ও অন্যান্য ছোট নৌযান চলাচল করে, কিন্তু শুকনো মৌসুমে এ অংশ নাব্য থাকে না। কামারখালী থেকে ভাটির অংশ মোটামুটি নাব্য, সারা বছর এখানে নৌযান চলাচল করতে পারে। নদীটির উৎসমুখ থেকে নড়াইলের গড় প্রস্থ ৪৫০ মিটার। নদীটির মোহনা থেকে উজানে কামারখালী পর্যন্ত অংশ জোয়ার-ভাটা দ্বা্রা প্রভাবিত হয়।পদ্মার সাথে সংযুক্ত হওয়ায় নৌপথে পণ্য আদান প্রদানে বিশেষ সহযোগী হিসাবে কাজ করে।
নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক জনপদ। এই সব নদীর মত্স্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে এ অঞ্চলের মানুষ। মধুমতি নদী তীরবর্তী অঞ্চল খুব উর্বর। তাই ফসল উত্পাদনের জন্য অনুকূল।
চলার পথে গড়াই-মধুমতি বহু শাখা-প্রশাখার জন্ম দিয়েছে এবং অন্যান্য অনেক নদীর সংস্পর্শে এসেছে। কুমার, কালীগঙ্গা, ডাকুয়া, বুড়ি গড়াই প্রভৃতি গড়াইয়ের শাখা নদী। চন্দনা গড়াই-এর উপনদী। নবগঙ্গা, চিত্রা, কপোতাক্ষ, খুলনা-যমুনা, গলঘাসিয়া, এলেংখালী, আঠারোবাঁকী প্রভৃতি নদী কোনো না কোনো ভাবে গড়াই-মধুমতি নদীর সংস্পর্শে এসেছে।
গড়াই-মধুমতি বাংলাদেশের অন্যতম দীর্ঘ নদী। এর অববাহিকাও বিস্তীর্ণ। নদীটি কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে এইসব এলাকার সেচ ও কৃষির উন্নতি এ নদীর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। কুমারখালি, জানিপুর, সেঁউরিয়া, গণেশপুর, কাতলাগাড়ী, খুলুমবাড়ী, লাংগলবন্দ, শচিলাপুর, নাকোল, লোহাগড়া, পাংশা, বালিয়াকান্দি, বোয়ালমারী, কাশিয়ানী, ভাটিয়াপাড়া, নাজিরপুর, পিরোজপুর, শরণখোলা, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা এবং মোরেলগঞ্জ প্রভৃতি গড়াই-মধুমতি নদীর তীরবর্তী উল্লেখযোগ্য স্থান।
নবগঙ্গা মাধ্যমে ভৈরব ও মধুমতির সংযোগ স্থাপিত কিন্তু পরবর্তীতে রুপসা নদী খনন করার পরে ধারাটি প্রধান ধারায় রূপ নিতে থাকে। গড়াই নদীতে পানি প্রবাহ কমার ফলে ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, গড়াই-মধুমতির মূল স্রোতের অধিকাংশই নবগঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা প্রকৃতির জন্য শুভকর নয়। গড়াই-আত্রাইয়ের মুলধারা পানি প্রবাহ কমে গেলে এই অঞ্চলের লবনাক্ততা বেড়ে যাবে যা আমাদের জীবন যাত্রা ব্যহত করবে এবং জীব বৈচিত্রের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে। কালবিলম্ব না করে গড়াই-আত্রাইয়ের উৎস স্থলে এখনি জলাধার খনন করা দরকার সারা বছর পানি প্রবাহ সচল রাখার নিমিত্তে।
মধুমতির অপর একটি শাখা নদী নাজিরপুরে মাটিভাঙ্গা উৎপত্তি হয়ে চিতলমারী,কচুয়া শহরের সীমানা দিয়ে ও পিরোজপুর সদরের পশ্চিম পাশ ঘেষে দক্ষিনে প্রবাহিত হয়ে জিয়ানগর (টগড়া) কঁচা নদীতে মিলিত হয়েছে। এই নদী বাগেরহাট জেলা ও পিরোজপুর জেলার সীমানা বরাবর বহমান।
এই নদীর তীরে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার স্টীমার ঘাট ছিল; যার মাধ্যমে এই অঞ্চলের ব্যবসা বানিজ্য প্রসার ঘটেছিল। কচুয়ার বলেশ্বর নদী ও ভৈরব নদের মাঝে একটি সংযোগ খাল আছে বাগেরহাট সদরের সুপারি পট্টি হয়ে তালেশ্বরের মধ্য দিয়ে কচুয়া বন্দরে মিলিত হয়েছে। ভৈরবের এই অংশটি তালেশ্বর নদী নামে পরিচিত। লোকমূখে শোনা যায়, এই নদীটিই ভৈরবের মুলধারা। তাদের মতে এই পথে বাগেরহাটের সাথে বরিশাল, ঢাকা ও অনান্য জেলায় যাতায়াত করত।
ভৈরব নদ ও বলেশ্বরের প্রচন্ড প্লাবনে পানির স্রোতধারা বর্তমান তালেশ্বর নদী মোহনা থেকে দক্ষিণ বরারর প্রবাহিত এই অঞ্চলের ছোট ছোট খালকে নদীতে পরিণত করে। যা পরবর্তীতে ভৈরবের মূলধারায় রূপ নেয়। তবে আমার দাদা তার ছেলে বেলায় মোড়েলগঞ্জের পঞ্চকরন বরাবর বড় খালের আকার ছিল এই নদী। তার এই কথা সুত্রধরে আমার মনে হয় তালেশ্বর নদী হয়তবা ভৈরবের আদি প্রবাহ।
পরিতাপের বিষয় হল এই নদী এখন মৃত অথচ আমার ছেলেবেলায় আশির দশকের শেষের দিকে এই নদী দিয়ে লঞ্চে কচুয়া-পিরোজপুর হয়ে চিংড়ীখালী গিয়েছি।
তালেশ্বর নদী সরকারের অপরিকল্পিত প্লান ও কিছু নদী খেকো প্রভাবশালীর কারনে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে ভুমিতে পরিনত হয়েছে। যার ফলে আমাদের অঞ্চলের লবনাক্ততা বেড়ে গেছে সেই সাথে ভৈরব নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করেছি আমাদের অঞ্চলের মিষ্টি প্রবাহ নিশ্চিত করছে মধুমতি-বলেশ্বর তাই এই নদীর সাথে ভৈরবের সংযোগ নদীগুলোকে ভরাট করা হলে বা পানি প্রবাহের বাধা সৃষ্টি করা হলে, ততই আমাদের অঞ্চলের লবনাক্ততা বাড়বে।
(চলবে…)
** নদীর শহর, প্রাণের শহর (প্রথম পর্ব)