কবি মোহাম্মদ রফিকের সাক্ষাৎকার: প্রথম অংশের পর
স্যার, শিল্পী সুলতান কি জাহাঙ্গীরনগরে গিয়েছিলেন?
মোহাম্মদ রফিক : কিছুদিন পরেই এ ঘটনার, আমি তখন জাহাঙ্গীরনগরে, তুমি তো জানোই প্রান্তিকের কাছে যে বাসাটায় থাকতাম, হঠাৎ করে একদিন দেখি যে সুলতান ভাই হাজির। কি ব্যাপার! বলে ভাই, আমি তো আপনার এখানে থাকতে এসেছি। এবং সুলতান ভাই প্রায় ছ’মাস আমার সাথে কাটিয়ে গেলো। এবং উনি প্রতি সকালবেলা উঠে আমার একটা ছবি আঁকতেন। বাসা বদলে আসার পর সেই ছবিগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেছে তার কোন খোঁজ নেই এখন। এঁকে এঁকে তিনি আমার খাটের ওপর বিছানার নিচে রেখে দিতেন। তখন আমিও খুব মদ্যপানে আসক্ত ছিলাম। আর আমি দেখতাম উনি সকালবেলা উঠেই গাঁজা নিয়ে বসেছেন। ফরীদি (হুমায়ুন) ছিলো আমাদের ছাত্র, আরেকজন ছিলো মেহেদী বলে নাম, দুজনেই মারা গেছে। উনি ঐ দুজনকে দিয়ে গাঁজার ব্যবস্থা করাতেন।
আমি বললাম, সুলতান ভাই, গাঁজা খেলে তো শরীর নষ্ট হয়। তো, উনি খুব ছেলে মানুষ ছিলেন, অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প করতেন! আমাকে বললেন, আচ্ছা রফিক, তো কী করি! আমি বললাম, আপনিও আমার সাথে মদ্য পান করেন। উনি রাজি হলেন। তখন আমি ফরীদিকে বললাম, ফরীদি, একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়। তো, ও ঢাকা থেকে একটা ভালো মদ জোগাড় করলো। আমরা তো বাংলা খেতাম, বুঝতেই পারো। ফরীদি, সুলতান ভাই খাবে বলে একটা ভালো, বিদেশী মদ নিয়ে এলো ক্যাম্পাসে। খুব আয়েশ করে আমি ফরীদি আর সুলতান ভাই বসলাম। একটু খেয়ে সুলতান ভাই বললনে, এটা তো জল, হা হা হা, এটা তো কিছু হয় না। এটা আমি খাবো না। হা হা হা। (দু’জনের সম্মিলিত হাসি)
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আর খেলেনই না?
মোহাম্মদ রফিক : তুমি অবাক হয়ে যাবে, উনি যে গাঁজায় একেকটা টান দিতেন, তুমি বা আমি যদি দেই ওরকম আমি নিশ্চিত আমাদের বুক ফেটে যাবে। সুলতান ভাই সকালবেলায় উঠে ঠিকমত কথা বলতে পারতো না, কিছু করতে পারতো না, কিন্তু গাঁজায় টান দেবার পরই বলতো যে, এইবার ভাল্ললাগছে। এই হচ্ছে সুলতান ভাই। তারপরে, আমার ছাত্ররা, তাদের বিদায় উপলক্ষে উৎসব করবে, তারা শিল্পী সুলতানকে উৎসব আমন্ত্রণ জানাবে, ওরা উনাকে আমন্ত্রণ করতে গেলো, বললো, যে আপনি কোথায় থাকবেন! আমাদের টিএসসিতে গেস্ট হাউস আছে, ওখানে আমরা ব্যবস্থা করতে পারি আপনি চাইলে। বললো, রফিক ভাই আছে না? ওরা বললো, হ্যাঁ আছে।
উনি বললেন, তাহলে গেস্ট হাউসে থাকবো কেন? রফিক ভাইয়ের ওখানে থাকবো। তো আমার ছাত্রদের একজন কবির এসে বললো যে স্যার, সুলতান ভাই তো বলছে আপনার এখানে থাকবে, তো আমি বললাম, ঠিক আছে, থাকবে। তখন তিনি গাঁজা টাজা ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু প্রচন্ড কাশি। এবং কিছুদিন আমার এখানে থাকলেন, জাহাঙ্গীরনগরে মুক্তমঞ্চ থেকে সম্বর্ধনা নিলেন, এরপর তো ফিরে গিয়ে মারা গেলেন। আমার ধারণা, সুলতান ভাই খুব সরল ধরনের, সাহসী লোক ছিলেন, নিজের কল্পনার জগতে বিচরণ করতেন।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনারা দুজনেই এই অঞ্চলের মানুষের যাপনের মূল সুরটা ধরেছেন, নিজেদের সৃষ্টিকর্মে প্রোথিত করেছেন।
মোহাম্মদ রফিক : করতে পেরেছি কি না জানি না, তবে আমি এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই হচ্ছে আমার সাথে সুলতান ভাইয়ের সংশ্রব। তবে আমার মনে হয় যে, সুলতান ভাইয়ের এই নেশায় থাকার সুযোগ নিয়ে এইদেশে অনেকে অনেক ব্যবসা সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছে। অনেকেই ব্যবসা করছে এই দেশে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এখনো করছে।
মোহাম্মদ রফিক : আমি তোমার সাথে একমত, এখনো করছে। আমার সময়ের দুই বড় শিল্পী সুলতান ভাই এবং কামরুল হাসান, দুজনের সাথেই আমার খুব হৃদ্যতা ছিলো। এমনকি কাইয়ুম ভাইয়ের সাথেও।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হ্যাঁ, সময়ের বড় শিল্পীরা সকলেই আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। কপিলার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ তো করেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।
মোহাম্মদ রফিক : এবং কপিলার প্রচ্ছদের তো একটা গল্প আছে। কপিলা কিন্তু আমি লিখেছিলাম মাত্র, আমার আবার হয় কী এক এক সময় তাগিদ আসে লেখার…
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা জানত চাই স্যার। এটা কী ঐশী?
মোহাম্মদ রফিক : না। তা বলবো না। হয়তো এটা দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ব্যাপার। এবং সেই প্রস্তুতি সম্বন্ধে আমি তেমন সচেতন থাকি না। হঠাৎ করে, আমার মধ্যে একটা ঘটনা বা কোন একটা টানাপোড়েন, কাছের মানুষের কোন ঘটনা, মান অভিমান বিভিন্ন ভুল বোঝাবুঝি আমার মধ্যে এক ধরনের আবেগ তৈরি করে। সেই আবেগটাই তাগিদাটা তৈরি করে। এমন হয়েছে আমি একদিনে সাতটা আটটা কবিতাও লিখেছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সম্প্রতি আর্টসে ভিডিওসহ ছাপা হওয়া কবিতাগুলোও এই মে মাসের মধ্যেই লেখা দেখলাম।
মোহাম্মদ রফিক : এবং আমি বেহুলাও লিখে ফেলেছি অনেক। তোমাকে আমি দেখাতে পারি পাণ্ডুলিপিটা, তুমি দেখলে অবাক হয়ে যাবে। এবং আমি মহুয়া যে লিখছি সেটারও একই অবস্থা।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দেখবো স্যার কথাটা শেষ করি। স্যার মহুয়া বলতেই সেলিম স্যারের কথা মনে পড়লো। আপনার বন্ধু এবং শত্রু একসাথে বলা যায়। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীদের আপনারা দু’জন দুর্দান্ত কিছু সময় ও অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছেন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তুলেছেন। আপনার শেষ সময় পর্যন্ত খুব অল্পকালের আমার যে অভিজ্ঞতা তাতেও একটা অনিন্দ্যসুন্দর সময় আপনারা দু’জনই জাহাঙ্গীরনগরকে দিয়েছেন। এবং এখন এই ২০১৫ সালে বসে বলতে পারছি, এখন বাংলাদেশে যারা খারাপ লিখছে না, ভালো লিখছে তাদের বিশাল একটা দল আপনাদের দু’জনের স্নেহছায়া পেয়ে বড় হয়েছেন। আপনারা থাকায় তাদের প্রস্তুতিটাও হয়েছে বেশ মজবুত।
মোহাম্মদ রফিক : শোন, সেলিম এবং আমি, সেলিম মনে হয় চাকরিতে যোগ দিয়েছে আমার মাস ছয়েক আগে। আমি গিয়ে দেখি যে সেলিম আছে। তার আগে থেকেই ছিল আর কী! এবং আমি থাকতে থাকতেই ও মারা গেল। ওর সাথে আমার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল। সেটা আমি –
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: ঠিক মারা যাওয়ার পর পর আপনি একটি দৈনিকের পাতায় লিখেছেন, বড় আবেগঘন সে লেখা, তার শিরোনাম-
মোহাম্মদ রফিক : আমি মনে করি যে, আমি জানি না আমাদের কাজ কতটা কী হয়েছে, কিন্তু আমি মনে করি আমাদের মধ্যে দেওয়া নেওয়াটা দুইজনকেই প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করেছে। এবং সেলিম একদিন প্রান্তিকে আমাকে বলছে যে, আপনি কী লেখেন কী পড়েন তা জানতে আমি আপনার পেছনে স্পাই লাগিয়ে রাখি। এবং এই ধরনের ঘটনা কিন্তু বাংলাদেশে আর নেই।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বিরল!
মোহাম্মদ রফিক : বিরল না শিমুল, নেই। দুইজন সৃষ্টিশীল লোক, যে মানেরই হোক, একজন তিনতলায় আরেকজন দোতলায় থাকতো শুরুতে, পরে ও দোতলায় আমি নিচতলায়, রুম থেকে বেরুলেই দু’জনের চেহারা দেখা যেতো। তার আগে একজন দোতলায় আর একজন নিচতলায় চাকরি করছে। এই যে ঘটনাটা, আমার মনে হয় না যে বাংলাদেশে, কোন সাহিত্য চর্চায় এটা আর ঘটবে! আর আমার সেই অর্থে ইলিয়াস ছাড়া কোন বন্ধু না থাকলেও আমি সেলিমকে আমার বন্ধু মনে করি। কারণ, সেলিমকে দিয়ে আমি উপকৃত হয়েছি, সেলিমও উপকৃত হয়েছে। দু’জনের চরিত্রগতভাবে কিছু অমিল ছিল। ওর চরিত্র ঠিক আমার সঙ্গে যেতো না আর কী!
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনাদের অনুসারী দলও তো ভিন্ন ছিল স্যার।
মোহাম্মদ রফিক : অনুসারীরা কখনো আসল লোক হয় না। অনুসারীরা কখনই বুঝবে না আসলে ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী ছিল! কিন্তু এমন ধরো আছে কেউ কেউ যারা দুইজনেরই অনুসারী ছিল। যেমন আমি ফরিদীর নাম বলবো। ফরিদী যেমন ধরো দু’জনের সাথেই তাল রেখে চলেছে। সুতরাং একেবারে যে আলাদা ছিল তা না। এমনকি আনু মোহাম্মদও তাই। আনুর সাথে দু’জনের সম্পর্কই খুব ভালো ছিল। যদিও আনু ঠিক সৃষ্টিশীল লেখক না, স্কলার, অন্য জগতের লোক, এরকম আরো দু-একজন আছে যাদের উভয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। তবে কবিতা কেন্দ্রিক যেসব সম্পর্ক তোমাদের সাথে, তোমাদের আমি অনুসারী মনে করিনি কখনো, তোমরা আমার সহযাত্রী। ফজল মাহমুদের কথা বলতে হয় যে মারা গেছে। ওর সাথে দুইজনেরই ভালো সম্পর্ক ছিল।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সুনীল সাইফুল্লাহ?
মোহাম্মদ রফিক : সুনীলের সাথে সেলিমের সম্পর্ক ছিল না। সবসময় নিজের ভেতরে থাকতো। আত্মমগ্ন। ওর কিছু প্রবলেমের কথা ও আমাকে বলেছিল। আমার মনে হয় শেষপর্যন্ত ওর আত্মঘাতী হবার কারণও ওটাই। সুমন (রহমান), কফিল (আহমেদ) কিংবা (মাহবুব) পিয়ালের কথা বলতে পারো, ওরা যেমন আমার সাথেই আড্ডা দিতো বেশি। শামীমের (শামীম রেজা) আবার দু’জনের সাথেই ভালো সম্পর্ক ছিলো।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তো স্যার, দীর্ঘসময় শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা আপনাকে গ্রান্ড ফেয়ারওয়েল দিয়েছে, তা বিভাগে, বিভাগের বাইরে, উভয় জায়গায়ই।
মোহাম্মদ রফিক : ঐ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা কথা তোমাকে বলে নেই, মনে পড়েছে, আমরা যখন ষাটের দশকে লিখতে শুরু করেছিলাম, এক ধরনের নির্বেদ এবং অবক্ষয়বোধ আমাদের মধ্যে কাজ করতো। সেটা কিন্তু সবার মধ্যেই ছিলো। এমনকী আমি রবীন্দ্রনাথের বলয়ে থাকলেও, আমার মধ্যেও সেটা কাজ করেছে। কিন্তু আমি সাতষট্টি সালে, আমি তখন চট্টগ্রামে চাকরি পেয়ে গেলাম। চট্টগ্রামের ভূমণ্ডল কিন্তু একটু আলাদা, পাহাড়, সমুদ্র, আমাদের দক্ষিণ বঙ্গ সেই তুলনায় সমতল।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাগেরহাট, খুলনা হয়ে চট্টগ্রাম!
মোহাম্মদ রফিক : হ্যাঁ, আমার মূল ভূমি কিন্তু দক্ষিণবাংলা, বরিশাল, বাগেরহাট এইসব জায়গা। বরিশাল বাগেরহাটের মধ্যে কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে খুব একটা পার্থক্য নেই। যেটা আছে বরিশাল ও চট্টগ্রামের মধ্যে। যা বলতে চাচ্ছিলাম, তার পরে, তো সেই পাকিস্তানী নির্বেদ ও অবক্ষয়বোধ কাটিয়ে ওঠার একটা তাগিদ, অনুভব, চেষ্টা ছিলো আমাদের মধ্যে।
আমার মধ্যে বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বক্তৃতা একটা বিরাট তোলপাড় ঘটিয়েছে। এবং এটা আমি লিখেছি একটা কবিতা, ব্যাঘ্রবিষয়ক এ। ঐ বক্তৃতা শোনার পরে আমার হঠাৎ মনে হলো আমি এতদিন শেয়াল ছিলাম, এই বক্তৃতা আমাকে বাঘে রূপান্তরিত করে দিল।
তারপরই লেখা কবিতা ব্যাঘ্রবিষয়ক। আমি যে বঙ্গবন্ধুকে বাঘ বলেছি তা না, ঐ সাতই মার্চের ভাষণ শুনে আমার ভেতরে যে অনুভূতিটা হয়েছিল সেটাকে আমি ঐভাবে ধরার চেষ্টা করেছি। সেই বক্তৃতাকে আমার মনে হয়েছিল একটা শ্রেষ্ঠ কবিতা। আমার মনে হয়, যারা শুনেছিল সেই বক্তৃতা, তারা প্রত্যেকেই-
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: শৃগাল হইতে ব্যাঘ্রে রূপান্তরিত হইয়াছিলো!
মোহাম্মদ রফিক : হ্যাঁ। যখন পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানীরা ক্র্যাকডাউনটা করলো তারপর মানুষের যে চেহারা আমি দেখেছি, এটা আমি আমার ছাত্রদেরও বলেছি, সেই চেহারা আজকে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যখন আমি শুনি যে একটা গারো মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তখন আমি অবাক হয়ে যাই, কারণ বাঙালী এমন নয়। আমি এই জাতির সবচেয়ে বড় বিপদের সময়ও তাদের যে চেহারা দেখেছি, এই চেহারা তাদের ছিলো না।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার দেখা চেহারা কেমন স্যার?
মোহাম্মদ রফিক : এটা শুনলেই বুঝতে পারবে। ক্র্যাকডাউনের পরে আমরা যখন ভারত যাচ্ছি পালিয়ে, আমাদের দলে কমসে কম দু’শ’ জন লোক ছিল। তাদের ভেতরে ৬৫ বছরের বিধবা থেকে শুরু করে, ১৬, ১৭ বছরের নারী পর্যন্ত ছিলো। আমরা টিলাময় রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ করে বৃষ্টি হলো। রাস্তা ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল হয়ে গেল। কেউ পা ফেলতে পারছে না। পা পিছলে যাচ্ছে। তখন আমাদের যে লিডার ছিলেন, তিনি বললেন, আপনারা একজন আরেকজনের মাজায় ধরেন। আমার সামনেই একজন তরুণী ছিলেন, ১৭/১৮ বছর বয়স হবে,
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার গল্পসংগ্রহে এই যাত্রা নিয়ে একটা দুর্দান্ত গল্প আছে।
মোহাম্মদ রফিক : হ্যাঁ, গল্পে আমি লিখেছি, তো, সেই তরুণী, আমি খুব ইতস্তত করছি তাকে ধরতে, সে আমাকে বললো, আপনি তো পড়ে যাবেন, আপনি আমাকে ধরেন, হ্যাঁ, এবং জানো, আমার তাকে ধরে কিছুই মনে হলো না। এবং তারপর আমরা যখন ইসে, বর্ডার পাড় হবো, লিডার বললেন, আপনারা যে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাবেন, এই কাপড়চোপড় পড়ে তো আপনারা পার হতে পারবেন না। পাহাড়ের চূড়ায় পাক আর্মির টহলচৌকি আছে, দেখলেই গুলি করে দেবে। এবং গুলি চালালে সব মারা পড়বেন। সুতরাং যেতে হলে আপনাদের সব কাপড় খুলে ফেলতে হবে। মেয়েরা শুধু ব্রা- পেন্টি রাখতে পারবে। আর ছেলেরা শুধু আন্ডারওয়্যার। আর কিচ্ছু না। সেই অবস্থায় যখন আমরা পার হচ্ছি। বৃষ্টি হচ্ছে। তখন ঐ যে ৬৫ বৎসরের বিধবা ছিলেন, তিনি পা পিছলে একেবারে কাদায় পড়ে গেলেন। আমি ধরতে গেলাম, দেখি পাঁচ ছয়টা যুবক একসাথে ধরতে এসেছে। তাদের বয়স আমার চেয়ে কম। ওরা বললো, আমরা থাকতে আপনি কেনো? আমিও যুবকই কিন্তু তখন। আমি কিন্তু তখন মাত্র ২৯।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আমার এখনকার বয়সী স্যার।
মোহাম্মদ রফিক : আমি বললাম যে ঠিক আছে, ধরেন সবাই ধরেন। সবাই ধরে তাকে প্রায় কাঁধে করে, ঘাঁড়ে করে নিয়ে গেল। এতগুলো মানুষ আমরা পার হলাম, যাওয়ার পর আমি এ কজনের মুখ কালো দেখলাম না, সবাই হাসি মুখ, কেউ বলতে পারল না যে কেউ কারো সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছে।
আমরা পঁচিশে মার্চের পরে যে বাড়িতে আশ্রয় নিলাম, সেই বাড়িতে, ছোট্ট একটা বাড়িতে বিশ্বাস করবা না, গরীব গৃহস্থের বাড়ি, সুজিত দস্তিদারের বাড়ি, ৯৯জন লোক আশ্রয় নিলাম, তাদের খাওয়াও জুটল, সবই জুটল। সারা বছরের খোরাকের গোলা খালি করে দিয়ে। কয়েকদিন পরে দেখা গেল আর কিছুই নাই। ভদ্রলোক বাড়িতে আমাদের রেখে পটিয়ায় বাজার করতে গেলেন, সেইদিন পাকিস্তানি আর্মি বম্বিং করল ঐ এলাকায়।
তার ঊরুতে স্প্লিন্টার লাগল, ঊরুতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল। আহত অবস্থায় সুজিত দস্তিদার আশ্রিতদের জন্য বাজার নিয়ে, চাল ডাল নিয়ে বাড়ি ফিরল। এবং সেইদিন আমাদের ক্যাপ্টেন হারুন ছিল, পরে তো সে মেজর জেনারেল টেনারেল হয়ে রিটায়ার করেছেন, হারুন আহত হয়ে ঐ পটিয়ায় হেল্থ কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসল। আমি দেখতে গেলাম।
সেখান থেকে ফিরছি, দেখি এক ভদ্রলোক, বুক পর্যন্ত শুভ্র শাদা বড় দাঁড়ি, কাঁদছে আর মোনাজাত করছে— “হে আল্লাহ, এই জালেম পাকিস্তান তুমি ধ্বংস করে দাও’। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি তার দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। খুব সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশের মুসলমান হবেন। তার চোখে পানি দেখে আমি দাঁড়ালাম। উনি মোনাজাত শেষ করলেন, বললেন, খোকা তুমি কে? আমি পরিচয় দিলাম। বললাম যে দস্তিদার বাড়িতে থাকছি।
উনি বাড়ির পথ বলে দিয়ে বললেন, তুমি আমার বাড়িতে যেও। সন্ধ্যা বেলায় আমি গেলাম। তখন উনি আমাকে বললেন, দেখেন, আপনি আমাকে কাঁদতে দেখে মনে হয় অবাক হয়ে গেলেন! শোনেন, এই পাকিস্তানের জন্য আমরা কী না করেছি! শুধু জান দিতে বাকী রেখেছি। আর সবই তো করেছি। কিন্তু আজকে এই পাকিস্তান একটি জালেম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেইদিনই আমি বুঝলাম যে পাকিস্তান থাকছে না। মানে, আমার মধ্যে বিশ্বাসটা বদ্ধমূল হলো, এই পাকিস্তানের ভাঙন অবশ্যাম্ভাবী।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার, সাতই মার্চে তো-
মোহাম্মদ রফিক : পাকিস্তানের মৃত্যু হয়ে গেছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আমি বলছিলাম, স্বাধীনতার ঘোষণা একভাবে চলে এলো-
মোহাম্মদ রফিক : অবশ্যই, যদি কেউ অস্বীকার করতে চায় আমি বলব তার কোন বোধ নেই।
মনে রেখো ইতিহাসের বহুকথা অব্যক্তই থেকে যায়!
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: রূপকার্থে থেকে যায়, স্যার!
মোহাম্মদ রফিক : হাঁ, রূপকার্থে থেকে যায়! সুতরাং ঐ রূপক বাস্তবের চেয়ে অধিক বাস্তব।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার, সাতই মার্চের পর শৃগাল থেকে ব্যাঘ্রতে পরিণত হলেন—
মোহাম্মদ রফিক : তুমি যদি আমার আগের লেখা পড়ো, বৈশাখী পূর্ণিমায় ও কীর্তিনাশা যদি মিলিয়ে পড়, তাহলে বুঝবে আমি নতুন জন্ম নিয়েছি। তোমাকে তো আমি বলেছি, মুক্তিযুদ্ধ নতুন আমাকে জন্ম দিয়েছে। এবং আমার পিতা শামসউদ্দীন আহমেদ, কিন্তু পুনর্জন্মের পিতা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার, আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক নম্বর সেক্টরের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং পলিটিক্যাল অফিসার হিশেবে ছিলেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে আপনি কখনোই প্রকাশ্যে বলেন নি, দেনা-পাওনার হিসেব করেন নাই। অনেক কবি সাহিত্যিকই সেটা করেছেন, সুবিধা নিয়েছেন। এই বিষয়গুলো আপনি কখনোই রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগান নাই, বা তুলে ধরেন নাই। কেন?
মোহাম্মদ রফিক : না, এটা তো আমার কাজ না। আজকে আমি তোমাকে বলি, অনেক জায়গা আমি বিভিন্নভাবে কাজ করেছি। যেমন বগুড়া, রাজশাহীতেও আমার ভূমিকা আছে, রাজশাহীতে অনার্স তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে, রাস্ট্রিকেট করা হয়েছে, আমি যে আজকে আমার এ অবস্থানে পৌঁছেছি, সেটা আমার কর্মগুণে, ভাগ্যগুণে বলব না। সেসব কথা আমাকে কখনো লিখতে হবে ভাবি নি। সে আবার আরেক ধরনের ইতিহাস। এসব কথা যে আমাকে বলতে হবে তা আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না। আমি মনে করতাম আমার ব্যক্তি কর্ম অন্তরালে থাক, আমার লেখাই সামনে আসুক।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: কিন্তু ব্যক্তির যে যাপন বা প্রভাব বলয় তা অনেক সময় লেখকের লেখায়ও ভূমিকা রাখে।
মোহাম্মদ রফিক : এখন মনে হয় রাখে। এসব আমি এখন না হয় ভবিষ্যতে যদি সময় পাই কিছু কিছু লিখব।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: মুক্তিযুদ্ধের ঐ সময়টার আপনি যে ঘটনাগুলো বললেন, আপনি গেলেন এবং ষোলই ডিসেম্বর আমরা—
মোহাম্মদ রফিক : আচ্ছা, তুমি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার কথা বলছ, আমি তখন এক নম্বর সেক্টরে কাজ করি, মেজর রফিক তখন এক নম্বর সেক্টরে ছিলেন। আমি সেখানে কাজ করতাম বেতনও পেতাম। পরে আমি সেখান থেকে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করা শুরু করি। কিন্তু এসব ব্যাপার মিলিয়ে
আমি যে মুক্তিযুদ্ধে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি, তার কাগজপত্র তো আমার কাছে ছিল। পরে আমি যখন ঢাকায় এসে নামলাম, আমার মনে হলো আমি তো এই কাগজ পত্রগুলো আমার নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু আমি মুক্তভাবে এই দেশ থেকে গিয়েছিলাম, মুক্তভাবে ফিরতে চেয়েছি। সমস্ত কাগজপত্র রানওয়েতে উড়িয়ে দিয়ে আমি দেশে প্রবেশ করেছি।
ঢুকে দেখলাম, আমি মনে হয় দেশে ফিরলাম এগারোই জানুয়ারি, ১৯৭২, তখন সেখানে আমাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে হয়েছিল বলে ফিরতে একটু দেরি হয়। ফিরে দেখি, আমার চাকরি নেই। আমি তখন নোমান সাহেবের কাছে যাই। উনি তখন শিক্ষা দপ্তরের দায়িত্বে আছেন। আমি গিয়ে বললাম, স্যার, আমার তো চাকরি নাই। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আমি জানি তুমি দেশের জন্য কী করেছ। সুতরাং তুমি যাও, তোমার চাকরি আছে। আমি গিয়ে চিটাগং এ যোগ দিলাম। যাওয়ার কিছুদিন পর—আমি আবার নোমান স্যারের প্রিয় ছাত্র, আমি, ইলিয়াস (আখতারুজ্জামান) উনার ছাত্র, মান্নান (সৈয়দ) উনার ছাত্র।
আমি ঢাকা কলেজে আসলাম। এক লোক আমার কাছে আসলেন। তিনি বললেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা। আমি তখন অবাক হলাম! কী বলেন এসব। আমি আপনাকে একুশ না জানি ছাব্বিশে ডিসেম্বর কফি হাউসে দেখেছি, আপনি তখন আমাকে বলেছেন, আপনি ঐ দিনই দেশ থেকে এখানে এসেছেন, তাহলে আপনি কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হোন! তিনি, হে হে করছেন, আমতা আমতা করছেন, আমি তো অবাক। তখন আমি তাকে বললাম, আমি তো জানি আপনি মুক্তিযোদ্ধা না। আসলে আমি এটাও জানি, এদেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযোদ্ধা, যাদের কোনো সার্টিফিকেট নেই।
আমরা করলাম কী! আমরা মুক্তিযুদ্ধের পর সকল যোদ্ধাদের অস্ত্রহীন করে গ্রামে গ্রামে, তাদের গ্রামে পাঠিয়েদিলাম, দিয়ে দেশটাকে দখল করার চেষ্টা করলাম। এখান থেকেই আমাদের বিয়োগান্তক কাহিনির শুরু। আমার কিছু গল্পে এসব ঘটনা আছে। এবং লেখার চেষ্টা করেছি। (চলবে)
এইচ/এসআই/বিআই/২৩ অক্টোবর, ২০১৬
পরের অংশ পড়তে ক্লিক করুন