• শিমুল সালাহ্উদ্দিন
সর্বমানুষের মুক্তি চেতনার কবি মোহাম্মদ রফিক। কবিতায় সারা জীবনই তুলে আনতে চেয়েছেন নদী, জল, কাদা-মাটির সঙ্গে যুক্ত জীবনযাপনের চিত্র।
পাকিস্তান আমলে ছাত্র আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাব্য রসদ যুগিয়েছেন ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান এ কবি। কীর্তিনাশা, কপিলা, গাওদিয়া, খোলা কবিতা, বিষখালী সন্ধ্যা বা কালাপানি, অশ্রুময়ীর শব বা নোনাঝাউ— বাংলা কবিতায় তার অনন্য সংযোজন।
‘সব শালা কবি হবে’—সামরিক শাসন ও শাসকের তথাকথিত কবি হওয়ার অভিলাষের বিরুদ্ধে তাঁর রচিত বহুবিশ্রুত পঙক্তি। আধুনিক বাংলা কাব্যসম্ভারে তাঁর রচিত ‘কপিলা’ (১৯৮৩) মহাকাব্যোপম এক সৃষ্টি।
পেশাগত জীবনে কবি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। ২০০৯ সালের জুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে তুমুল এক সৃজন-সময় পার করছেন কবি।
বেসরকারি টেলিভিশন (টিভি) ইনডিপেনডেন্ট টিভির শিল্প, সংস্কৃতি ও বিনোদন বিভাগের প্রধান শিমুল সালাহ্উদ্দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘কবি মোহাম্মদ রফিক’ কথা বলেছেন বিভিন্ন বিয়য়ে।
{আলাপ শুরুর সময় ৩১ মে, ২০১৫, রবিবার, সকাল ১১.১০, উত্তরা}
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: (গাওদিয়া’র প্রথম সংস্করণের একটি বই দেখিয়ে) স্যার, এটা আছে আপনার কাছে?
মোহাম্মদ রফিক : (অবাক হয়ে) না, এটা কোথায় পেলে তুমি?
স্যার, নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে। ছান্দসিক আবদুল কাদিরের সংগ্রহের বই থেকে। আপনি উনাকে স্বাক্ষর করে উপহার দিয়েছিলেন। শিল্পী কামরুল হাসানের প্রচ্ছদ। বিশ টাকায় কিনেছি।
মোহাম্মদ রফিক : তুমি তো অদ্ভুত জিনিস মনে করিয়ে দিলে। আমি কী কাজে যেন বাংলা একাডেমি গেছি একদিন। গিয়ে দেখি যে এক বয়স্ক লোক। খুব কষ্ট করে একটা কী প্রবন্ধের প্রুফ দেখছেন। একজন প্রৌঢ় লোক। আমার একটু মনে হলো সাহায্য করি। আমি বললাম উনাকে যে, আমি আপনাকে সাহায্য করি। উনি বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারো’। আমি সাহায্য করলাম। করে, আমি প্রুফ দেখে বেরিয়ে এসেছি। বাইরে শিশির দত্তরা আড্ডা দিচ্ছে, ওখানে দাঁড়িয়েছি, আমিও ওদের সাথে গল্প করছি। একটু পর শামসুজ্জামান খান বেরিয়ে আসলেন ঐ প্রৌঢ় মানুষটিকে নিয়ে। আমাকে বললেন, মোহাম্মদ রফিক, উনি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান। উনি আমাকে বললেন, যে তুমি বললে কোন ক্ষতি নেই তো! আমি বললাম, না, আমি আপনার ছেলের বয়সী হবো। বললেন, তুমি কীর্তিনাশা লিখেছ? আমি বললাম যে, জ্বি। উনি বললেন, তুমি অনেক বড় কবি। আমি তো তখনই (বিব্রত) হয়ে গেছি। গাঁধার মত হাসছি। উনি বললেন, ‘তুমি মনে করেছ যে, আমি আধুনিক কবিতা বুঝি না! কিন্তু ছন্দ তো বুঝি। তুমি অনেক বড় কবি।’
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: (হাসির পর) কবিতার ছন্দের ব্যাপারে বাংলা সাহিত্যে উনি কিন্তু বড় অথরিটি স্যার! ছান্দসিক আবদুল কাদিরের ঐ বড় কবি অভিধা খুব ছোট করে দেখার কিছু নাই।
মোহাম্মদ রফিক : আমি তখন উনাকে চিনিই না। আর প্রশংসা শুনে আমি তো আরো গাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি বলছেন যে, “তোমার ছন্দের যে হাত আর কোন কবির এই হাত আমি দেখি নাই’’। এই বলে রাগান্বিত ভাবে গটগট করে চলে গেলেন। শামসুজ্জামান খান বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমিও তার দিকে। শামসুজ্জামান খান বললেন, আপনি উনাকে চেনেন? আমি বললাম, ‘না তো’। উনি বললেন, আবদুল কাদির। তো আমি গিয়ে যে উনাকে বলবো যে আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, ঐটুকু তখন আমার হয়নি, এক ধরনের ঔদ্ধত্য ও অহমিকা ছিলো, আমি গিয়ে আবার আড্ডা দিতে শুরু করেছি ওদের সাথে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: ‘গাওদিয়া’র এই কপিটা স্যার আমি পেয়েছি নীলক্ষেতে। ছান্দসিক আবদুল কাদিরের সংগ্রহের অনেকগুলো বইয়ের সাথে। উনার বাড়ির কোন লোক বোধহয় সব একসাথে বিক্রি করে দিয়েছিল। আপনার নিজের স্বাক্ষর করা এবং লেখা, শ্রদ্ধাভাজনেষু, আবদুল কাদির, করকমলে। আমার খুবই ভাল লাগলো আপনার সিগনেচার দেখে এবং আমি কিনলাম। আপনার কাছে কি এই সংস্করণের কোন কপি আছে?
মোহাম্মদ রফিক : না, নাই।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এই বইটা দিয়া শুরু করার কারণ স্যার, গাওদিয়ার শুরুতে, প্রারম্ভপত্রে আপনি লিখেছেন, “গাওদিয়া, হতে পারে একটি গ্রাম,/ শহর কিংবা গঞ্জ,/এমনকি সারাটা বাংলাদেশ”। ১৯৪৩ সালে আপনার জন্ম, এখন পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ের কাব্যচর্চায় আপনি বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, কষ্ট, বেদনা… এগুলো আসলে আপনার কবিতায় অনেক বেশি মূর্ত হয়ে উঠেছে। এবং তার চেয়ে বেশি শক্তিশালীভাবে উঠে এসেছে এই অঞ্চলের মানুষের অদম্য চেতনা বা স্পিরিটের গল্প। একভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার গল্পও। তো স্যার, জানতে চাই, আপনার যে পোয়েটিক ফিলসফি বা কাব্যদর্শন তা দাঁড়ালো কিভাবে?
মোহাম্মদ রফিক : শোন, তুমি যে প্রশ্ন তুললে এর উত্তর দেয়া এত সহজ নয়। কারণ, যখন আমি কাজ শুরু করেছি, তখন আমি এত কিছু চিন্তা করি নাই।
যেকোন কবিই যে কাজ করে তা তার বেড়ে ওঠার সাথে, জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সাযুজ্যপূর্ণ। কতগুলি ব্যাপার আমার মধ্যে খুব প্রভাব রেখেছে, প্রভাবিত করেছে, এখন আমি বুঝি, যখন আমি ফিরে তাকাবার চেষ্টা করি, যে আমি যে এখানে দাঁড়ালাম, কিভাবে দাঁড়ালাম! যা হয়ে উঠলাম, কিভাবে হয়ে উঠলাম! আমার উপর একটা বিরাট প্রভাব পড়েছে আমার দাদার। আমার দাদা খুব শিক্ষিত মানুষ ছিলেন না, কিন্তু স্বশিক্ষিত ছিলেন।
সেই আমলে তিনি সিক্স পর্যন্ত পড়েছিলেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষা তখন একটা মানদণ্ড। তিনি সেটা দিতে পারেন নাই। তিনি আমাদের অঞ্চলে একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা কি স্যার নাইনটিন থার্টির দিকে?
মোহাম্মদ রফিক : না, এটা তারও আগে। উনিশশো বিশটিশ থেকে শুরু। তার আগ থেকেও হতে পারে। তবে তিনি রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিকভাবে খুব সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে সুভাষ বোসের শিষ্য ছিলেন। তখন সমগ্র বাংলাই সুভাষ বোসে মুগ্ধ। এবং কংগ্রেস করতেন। ধর্মীয়ভাবেও তিনি খুব সচেতন ছিলেন। তিনি নামাজ পড়তেন, প্রতিদিন কোরান শরীফ পড়তেন, হাদীস পড়তেন এবং শুধুই পড়তেন না, জেনে বুঝে পড়তেন। প্রতিটা শব্দের অর্থ তিনি জানতেন একথা তিনি আমাকে বলেছেন। কিন্তু তিনি খুব ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সে সময়ই মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন!
মোহাম্মদ রফিক : হ্যাঁ। উদার ছিলেন। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন, তিরিশটা রোজা রাখতেন, কিন্তু তিনি আমাকে বলেছেন,
“দ্যাখ, ধর্ম আমাকে শিখিয়েছে- আমার ধর্ম করার অধিকার যেমন আমার, ঠিক তেমনি আমার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী, সে যদি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও হয় তাহলে তারও নিজের ধর্ম পালন করার একই অধিকার আছে। সে অধিকার যেনো রক্ষিত হয় সেটা দেখাও আমারই দায়িত্ব। এটা আমার ধর্মই আমাকে শিক্ষা দিয়েছে।”
“তুই আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারিস, তাহলে কেন আমি এত ধর্মপালন করি। তার উত্তর হচ্ছে, আমি একটা ধর্মপালনকারী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, ধর্ম পালন করা আমার উপরে দায়িত্ব হিসেবে বর্তেছে। আমার সংস্কৃতির অংশ হিসেবে। সেটা রক্ষা করাটাও তাই আমার দায়িত্ব। এবং অতি শৈশবকাল থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র নিয়ে আমার মনে একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে।”
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সেটা কীরকম?
মোহাম্মদ রফিক : আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে ১৯৪৭ এ বা ৪৮ এ যখন পাকিস্তান হলো, তখন আমার দাদা ঐ অঞ্চলের ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। আমাদের ওখানে যে স্থানীয় স্কুল আছে, সেখানে সেদিন প্রথম পাকিস্তানী পতাকা তোলা হবে। পতাকা উত্তোলন উৎসব। সব লোক সেজেগুজে যাচ্ছে। কিন্তু আমার দাদা বসে আছেন। তিনি যাবেন না। তো আমার বাবা তখন তাগড়া যুবক। পাকিস্তান বিষয়ে তারও উৎসাহ আছে। তিনিও যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন। দাদাকে বলছেন, বাপজান চলেন চলেন।
দাদা বললেন, যেতে হলে তোমরা যাও। একটা জালেম রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে এই পাকিস্তান। আমি গেলাম বটে সেই উৎসব দেখতে, কিন্তু আমার মনে দাদার ঐ দৃঢ় মুখ আর কথাটা কোথায় যেনো গেঁথে রইলো। এটা একটা আর দ্বিতীয়ত তোমরা সে সময় দেখনি, আমাদের গ্রামে মূলত হিন্দু এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বসবাস করতো। নদীর ধার ঘেঁষে তাদের পাড়া প্রথমে, তারপর মুসলমানদের বাড়িঘর ছিলো। ছেলেবেলা থেকে আমার বন্ধুত্ব ছিল ঐ হিন্দু পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। তারাই কিন্তু তখন লেখাপড়া করতো, বই আদান-প্রদান করতো। আমি বাংলা উপন্যাস, বাংলা কবিতার বই, ইংরেজী উপন্যাস, ইংরেজী কবিতা, এসবের সাথে যোগাযোগ আমার শৈশবে ঐ হিন্দুপরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্য দিয়েই হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, ঢাকা কলেজে আসার আগ পর্যন্ত আমি মুসলমান ছেলেরা কেমন হয় আমি জানতাম না। আমার প্রথম বাঙালি মুসলমান বন্ধু হচ্ছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রয়াত প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক। এবং বলা যায় এখন পর্যন্ত সেই আমার একমাত্র বন্ধু, কারণ তার সঙ্গে আমার দীর্ঘজীবন, মানে যতদিন সে বেঁচে ছিলো এবং আমরা একসঙ্গে থেকেছি, আমাদের শিল্পসাহিত্য চেতনার আদান-প্রদান, হাসি ঠাট্টা, মদ্যপান এসব আমরা, সবটা করেছি। এবং আমি খুব অল্পবয়সেই বামপন্থী রাজনীতির প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ বোধ করেছি, ফলে সম্পৃক্ত হয়েছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সম্পৃক্ত হলেন কীভাবে?
মোহাম্মদ রফিক : সেটাও মজার ঘটনা। আমি কিন্তু মার্কস লেলিন পড়ে বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হইনি। আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম দস্তয়ভস্কির উপন্যাস পড়ে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এবং দস্তয়ভস্কি আপনার প্রিয়তম লেখক!
মোহাম্মদ রফিক: হ্যাঁ, অন্যতম, প্রিয় লেখকদের একজন। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। দস্তয়ভস্কির ‘লাঞ্ছিত এবং নিপীড়িত’ উপন্যাসটি আমি খুলনা থেকে কিনে এনেছিলাম। এই উপন্যাসটি পড়ার পর থেকে আমার মধ্যে কেনো যেনো বামপন্থার প্রতি এক ধরনের দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি হয়। এবং যতদিন আমি সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেছি, আমি আমার জায়গা থেকে নড়িনি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এখনো কী নড়েছেন স্যার?
মোহাম্মদ রফিক : এখনো যে নড়েছি, তা না। আমি তো আদর্শের রাজনীতি করেছি। ঐ আদর্শে আমি বিশ্বাস করি। এবং এর প্রতি দুর্বলতা আমার আছে, থাকবেও। আমার কবিতায়ও ঐ আদর্শের প্রভাব রয়েছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার কবিতার কথা জানতে চেয়েছিলাম স্যার, কবির দর্শন-
মোহাম্মদ রফিক : আমি যে আমাদের সমাজ, বোধ, জীবন, বেদনা, সমাজ জীবন নিয়ে কাজ করেছি, আপাতভাবে যা দেখা যায়, এসবই কেবল দানা বেঁধেছে, এটাই শুধুমাত্র নয় কিন্তু। কিছু জিনিস আমি কবিতায় খুব সচেতনভাবে করতে চেয়েছি। তুমি তাকিয়ে দেখো, ইয়োরোপীয় সভ্যতা, যা দিয়ে আমরা খানিকটা মোহাচ্ছন্ন বলবো, এই ইয়োরোপীয় সভ্যতা কিন্তু মূলত গড়ে উঠেছে গ্রীক পুরাণের উপর নির্ভর করে। এই পুরাণটা, মিথ’টা কিন্তু একটা জাতির মেরুদণ্ড গঠন করার জন্যে খুব প্রয়োজন। তুমি নৃবিজ্ঞানের ছাত্র, তুমি বুঝবে, একটা কথা আছে প্রত্নতত্ত্ব প্রতিভা।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: প্রত্মপ্রতিভা, স্যার!
মোহাম্মদ রফিক : আমি ইংরেজিতে বলি আর্ক জিনিয়াস (Ark-genius)। আমি যদি বঙ্গবন্ধুর কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখো বাঙালিদের এমন অনেক লোকের চেহারা কিন্তু ভেসে ওঠে। আমার মনে ভেসে ওঠে, বাঙালি ভাবলেই যাদের চেহারা তার মধ্যে তিনি অন্যতম। তোমার সামনেও ভেসে উঠতে বাধ্য, কারণ কোন লোক, শুধু শেকড় না, তার মাটি থেকে বিচ্যুত হয় না। মাটির সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়েই সে বেড়ে ওঠে কিন্তু। আমি সচেতনভাবে যেটা ভেবেছি, আমাদের, বাঙালির, একদম বাঙালির, একটা নিজস্ব পুরাণ গ্রহণীয়। এবং তুমি দেখবে, আমি কিন্তু সচেতনভাবে আমার কবিতায় সেটা করার চেষ্টা করেছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হ্যাঁ স্যার, চরিত্র হিসেবে আপনার কপিলায় তো এদেশের মাঠ ঘাটের মানুষই মিথ হয়ে উঠেছে। ঈশা খাঁ এর বংশের বধূ না পলাইতাম আমি কিংবা ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া মলুয়ার চরিত্র যেখানে কবিতায় উঠে এসেছে। কিংবা গাওদিয়ার কথা যদি বলি!
মোহাম্মদ রফিক : কোত্থেকে নিয়েছি যদি বলো, আমি নিয়েছি বাঙালি লোকগাঁথা, লোককাহিনী এমনকি বাংলা উপন্যাসকেও আমি ব্যবহার করেছি। যেমন তুমি নিজেই মঞ্চের জন্য কপিলা নির্দেশনা দিয়েছো।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: জি স্যার। শুধু তো কপিলায় না স্যার, আপনার অন্য সব রচনাবলীতেও আঞ্চলিক বিবিধ মিথের উপস্থিতি রয়েছে। এবং এই পুরাণপ্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ বিস্তার নিয়ে আপনার কবিতায়।
মোহাম্মদ রফিক : তা বলতে পারো। শুধু কপিলায়ই নয়, মহুয়া, বেহুলা, দামোদর এই চরিত্রগুলো পুরাণ থেকেই আমার কবিতায় আমি তুলে আনতে চেষ্টা করেছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এই সমস্ত কিছুর বাইরে, আপনি যা যা কিছু গ্রন্থিত করেছেন কবিতায় উপাদান হিসেবে, তার বাইরে আপনার কবিতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতো বিশুদ্ধতার এক ধরনের প্রচেষ্টা আছে। একজন কবির এই যে প্রকল্প, এটা আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মোহাম্মদ রফিক : এটা হয়তো আমার পঠনপাঠনের একটা প্রক্রিয়া। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটাকে আমরা বলি ধ্রুপদী সাহিত্য, তার প্রতি আমার একটা মারাত্মক আকর্ষণ আছে। ছেলেবেলা থেকেই মহাকাব্যের প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা ছিলো। মহাকাব্য হয়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি। কপিলাকে অনেকেই সার্থক মহাকাব্য বলেছেও। অরুণ সেন বলেছেন। শুনছি সুধীর চক্রবর্তীও নাকি লিখেছেন। আমি এখনো, হোমার বলো, ভার্জিল বলো, ঈনিড বলো, দান্তে বলো, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার কবিতা বলো, বা আমাদের রামায়ণ, মহাভারত বলো, কিংবা আমাদের সাহিত্যের মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ বলো, এদের প্রতি আমার ভীষণ প্রেম রয়েছে। ষাটের দশকে যখন আমি লিখতে শুরু করি, তখন কিন্তু আমি মূলত রবীন্দ্রনাথের বলয়েরই ছিলাম। এখনো আমি মনে করি যে আমি রবীন্দ্রনাথের বলয়েরই লোক। বাংলা কবিতার ছন্দ আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে।
যে একজন গায়ক, সে যদি তাল লয় ভুল করে, তাহলে আমরা তাকে কখনোই গায়ক স্বীকৃতি দেবো না। হয়তো তার গান শুনতে পারি, কিন্তু শিল্পীর কাতারে তাকে কখনোই স্থান দেবো না।
কবি যদি হতে চায় কেউ, বা টিকে থাকতে চায় কবি হিসেবে এবং একটা লেখা লিখে ভাবে এটা কবিতা পদবাচ্য কী না, তাহলে অবশ্যই তাকে বাংলা ছন্দের ওপরে অধিকার অর্জন করতে হবে। এবং সেই ছন্দটাকে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই যেনো সে ব্যবহার করতে পারে।
এটা প্রথমত, দ্বিতীয়ত যেটা আমি বলি, পুরনো কবিতা ধরো, চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, গীতিকা, মধ্যযুগের কবিতা, আমি সবটাই পড়েছি। আমি একটা কথা বলতে পারি যে, ২০০৩ বিসি থেকে শুরু করে, ৩০০০ বিসি থেকে শুরু করে পৃথিবীতে যত উল্লেখযোগ্য কবিতা লেখা হয়েছে, যেখানেই লেখা হোক, যেগুলো প্রকাশিত হয়নি বা আমার কাছে আসেনি সেগুলো আলাদা কথা, যেগুলো হয়েছে, অনূদিত, প্রকাশিত তার সাথে আমার যোগাযোগ নেই সেটা হতে পারে না। পৃথিবীর মোটামুটি সব অঞ্চলের ছোট-বড় সব কবিরই কিছু না কিছু কবিতা আমি পড়েছি। এবং তার একটা অনুরণন নিশ্চয়ই আমার মধ্যে আছে। আমি যখন লিখতে বসি, তখন আপনা আপনিই আমার কবিতা বিষয়ে অর্জিত যে ধারণা, তা ভেতরে কাজ করতে থাকে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার, এটা বলা হয়ে থাকে যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের একটা বড় ধরনের হাহাকার ছিলো। কপিলা যেটা একভাবে অবসিত করেছে বলে আমি মনে করি। কপিলা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে, শঙ্কর সাঁওজালের সেটনির্মাণ সহযোগিতা নিয়ে আমি কাজ করেছিলাম, তার বাইরে লেখালেখিও হয়েছে প্রচুর। কপিলার যে মূল শক্তির জায়গা এটা আপনার পরবর্তী প্রজন্ম একভাবে আবিষ্কার করেছে। আপনি যখন কপিলা লেখা শুরু করেন, সেই প্রস্তুতির সময়টা যদি বলেন আমাদেরকে।
মোহাম্মদ রফিক : আমার যেটা ধারণা যে,
আমি মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাস করি। অবশ্যই আমি মানুষের অর্থনৈতিক সাম্যে বিশ্বাস করি। আমি মনে করি, প্রত্যেক মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। শুধু তাই না নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এবং নারীশক্তি যতটা বিকশিত হবে, একটা সমাজ ততটা বিকশিত হবে।
এটা আমার ভিতরের বিশ্বাস।
আমি কপিলাতে গিয়ে সেই নারীশক্তির বিষয়টাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। তুমি দেখবে যে ঐখানে কিন্তু প্রতিমা হয়ে আসছে বারবার কপিলা, কপিলার ভূমিকায় নারী। এরকমই আমি ইদানিংকালে, আরেকটা বই আমার লেখার প্রস্তুতি, প্রস্তুতি বলা ঠিক হচ্ছে না, লেখা হয়ে যাচ্ছে, মানে প্রকাশের পথে, সেটা হলো বেহুলার অপর পরিচয়। এবং আরেকটা লেখায় আমি হাত দিয়েছি সেটা হচ্ছে মহুয়াকে নিয়ে আমি একটা দীর্ঘকাব্য- প্রায় আশি পৃষ্ঠার বেশি। এবং তোমার মনে আছে কী না যে কপিলাও কিন্তু আশি পৃষ্ঠা।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার ত্রয়ীতে ৬২ পৃষ্ঠা, প্রথম সংস্করণে খুব সম্ভবত ৮৪ পৃষ্ঠা।
মোহাম্মদ রফিক : হ্যাঁ, কপিলা, মহুয়া এবং বেহুলা এই তিনটাকে নিয়ে আমি একটা জগৎ তৈরি করতে চাই। যে জগতে এই নারীশক্তির বিকাশকে অন্তত আমি আমার জায়গা থেকে পূর্ণমাত্রায় অবলোকন করতে পারব। আমাদের সমাজে নারী যতটা বিকশিত হবে, নারী যতটা এগিয়ে আসবে, নারী যতটা হাল ধরতে পারবে, আধুনিক অর্থে নয়, একজন বা দুইজন নয়, সমস্ত নারীরা যখন এগিয়ে আসবে, তখন আমাদের সমাজে ভিতর থেকে একটা অবশ্য পরিবর্তন হবে। এবং সেই পরিবর্তনের জন্য আমি অপেক্ষা করছি।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: স্যার, গত কয়েকটা বইমেলায় আপনার যে বইগুলো বেরিয়েছে, প্রথমা থেকে অশ্রুময়ীর শব, শুদ্ধস্বর থেকে ঘোরলাগা অপরাহ্ণ, রূপসীবাংলা থেকে বন্ধু তুমি প্রসন্ন অবেলায়, বেঙ্গল থেকে কালের মান্দাস, শুদ্ধস্বর থেকে দোমাটির মুখ-
মোহাম্মদ রফিক : এই গুলি তো আমি আমার এখনকার বই ধরিই না। এখন আমার সামনের যে বইমেলা, আশা করছি দুটো নতুন কবিতার বই বেরুহবে। সবমিলিয়ে আমার মোটামুটি পাঁচটা বই প্রকাশিত হবার পথে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: বাহ্। প্রচুর লিখছেন স্যার। আমার প্রশ্নটা ছিলো স্যার, যে বইগুলোর নাম করলাম সবগুলো বইয়ের শিরোনামই কেমন মৃত্যুগন্ধী! এটা কেন স্যার?
মোহাম্মদ রফিক : খুব ভালো প্রশ্ন করেছো। এই প্রশ্নেই বোঝা যায় আমার কবিতার প্রতি খুব মনোযোগ আছে তোমার। গত কয়েক বছরে আমি হঠাৎ করে করে কয়েকবার অসুস্থ হয়েছি। গত চার পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় পাঁচ ছবার আমি হাসপাতালে গেছি। আমার মাতৃবিয়োগ ঘটেছে। দীর্ঘদিনের ভালোবাসার কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে এসেছি।
কবিতা তো যাপন থেকে আলাদা কিছু না।
এটা একটা কারণ ছিলো। দ্বিতীয়ত মনে হয়েছে যে, যাবার বেলায় একটা নিজস্ব কথা উচ্চারণ করে যাওয়া ভালো। তবে, এটা কিন্তু আমার পুরো কথা নয়। এখন আমি নিজের ভেতর এক ধরনের উজ্জীবন অনুভব করছি। আমি মনে করি, এই উজ্জীবনের নেশাটা আমি রেখে যেতে চাই। ইদানিংকার একটা কবিতায় আমি লিখেছি, মৃত্যুকে জয় করাই হচ্ছে জীবনের, বেঁচে থাকার মূল অনুষঙ্গ। তোমাকে তো বললাম, আমার ভেতরে মানবমুক্তির, সর্বমানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবার একটা তাড়না আমার ভেতরে আছে।
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হ্যাঁ স্যার, কালাপানির কবিতায় তো আপনি লিখেছেন, ‘শীত শীত/ দু’ হাঁটুতে সিঁধিয়েছে মৃত্যুভীতি/ মনে লয়/ আসন্ন বিলয় / সর্বমানুষের/ দ্যাখ, ন্যাড়া কঞ্চিতে ধরেছে ফুল/ পূর্ণিমার। আপনি সবসময়ই সর্বমানুষের হতে চেয়েছেন। সর্বমানুষের আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতিফলনের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয় আপনার এ কবিতা। সর্বমানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা থেকেই কি আপনার কবিতা মুদ্রিত হয় আপনার শাদা খাতার পাতায়? এবং আপনার কবিতার চরিত্ররা যেনো সুলতানের আঁকা ছবির সেই দৃঢ়, ঋজু, পেশীবহুল মানুষগুলো, এইখানে স্যার আমি জানতে চাই, সুলতানের যে চিত্রকলার জগৎ, সেটার সাথে আপনার কবিতার জগতের একটা অস্পষ্ট মিল যেন আছে-
মোহাম্মদ রফিক : তুমি খুব ভালো একটা প্রসঙ্গ তুলেছো। আমি আশির দশকের শুরুতে, তখন বোধহয় আমার কীর্তিনাশা বেরিয়েছে, কপিলা বোধহয় লেখা হয়েছে, খোলা কবিতা লেখার আগে আগে, আমি একবার যশোর গেলাম। যাওয়ার পর আমার খুব ইচ্ছে হলো যে আমি, নড়াইল যাবো, সুলতান ভাইকে দেখে আসবো। তখন কিন্তু আমি উনাকে চিনি না। নাম শুনেছি, কিংবদন্তি শুনেছি, প্রচুর কল্পকাহিনী শুনেছি। তো আমার ইচ্ছে হলো যে আমি যাবোই যাবো। উনাকে চাক্ষুস দেখবো। তো আমি যশোর থেকে দুটা ছেলেকে বললাম যে আমি নড়াইল যাবো। তখন কিন্তু যাওয়ার পথ অত সুগম ছিলো না। এবং তখন ঐ ঝরঝরে বাসে যেতে হতো। বহুপথ হেঁটে আর নৌকায় যেতে হতো।
একদিন সকালবেলা যশোর থেকে রওনা দিলাম আমরা তিনজন। দশটা এগারোটা নাগাদ সুলতান ভাইয়ের ভাঙা বাড়িতে গিয়ে আমরা হাজির হলাম। সুলতান ভাই তখন একা থাকেন এবং সঙ্গে তার একজন মহিলা থাকেন, যিনি রান্না বান্না করে দেন। বাঁশের একটা মাচার উপর খাঁচার ভিতরে একটা বেজি, সাপ, শকুন এসব পালেন তিনি। এবং মাচার নিচে ঐ ডাম্প জায়গায় গাদা মারা তার ছবি।
আমাদের মনে হলো সেই সকালবেলাতেই, তিনি গঞ্জিকা ছাড়া আর কিছু সেবন করেন না। তো এর মধ্যেই কথাবার্তা চলছে। হঠাৎ করে তিনি বললেন, এই আপনারা কিন্তু দুপুর বেলা আমার এখানে খেয়ে যাবেন। আমরা কিছুতেই রাজি হচ্ছি না। তিনি জোর করছেন। বলছেন, না, খেয়ে যেতেই হবে। তখন যে মহিলা সুলতান ভাইয়ের সাথে থাকতেন, তিনি আমাদের ডেকে নিয়ে বললেন, যে উনি যে আপনাদের খেয়ে যেতে বলছেন, বাড়িতে তো কিছুই নেই। চালও নেই। কী খাবেন?
আমি আস্তে আস্তে তাঁকে বললাম, ভাববেন না, উনি বলে ফেলেছেন, আমরা ব্যবস্থা করছি। আমি গিয়ে তখন অশোক সেন নামে আমার সাথে যে দুজন গেছেন তাদের একজন, তাকে টাকা দিয়ে বললাম যে বাজারে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসো। তো সে, দ্রুত গিয়ে মাছ, শাকসব্জি এসব নিয়ে আসলো। আসার পরে ঐ মহিলা রান্নাবান্না করলো। সুলতান ভাইসহ আমরা খেলাম। সুস্বাদু রান্না অবশ্যই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সুলতান ভাই একবার জিজ্ঞেসও করলেন না, এই খাবার কোত্থেকে আসলো, অথচ প্রসন্নচিত্তে খেয়ে নিলেন!
সুলতান ভাই এমনই সরল ও জগৎ সংসারের ভাবনাহীন মানুষ ছিলেন।
তো সন্ধ্যায় সেই অজপাড়াগায়ে অন্ধকার নামলে আমরা চলে এলাম। দেখলাম যে সুলতান ভাইয়ের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নাই। আমি মনে করলাম যে এটা আমার দায়িত্ব। আমি জেলাপ্রশাসকের সাথে দেখা করে তাকে বললাম, আপনি আর্থিকভাবে না পারেন, অন্তত তাঁর বাড়িটাতে একটু বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন। তাতে অন্তত এই তীব্র শীতে একটু উষ্ণতা এই বাড়িতে তৈরি হবে। পরে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, উনি সেটা করেছিলেন। (চলবে)
এইচ/এসআই/বিআই/২৩ অক্টোবর, ২০১৬
পরের অংশ পড়তে ক্লিক করুন