• মো. সুরুজ খান
বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, বাগেরহাটের জনসংখ্যা ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৩১ জন। জেলার এই জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের নাম “বাগেরহাট সদর হাসপাতাল”।
আমাদের দেশে প্রেক্ষাপটে সাধারণত সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে আসেন দরিদ্র জনসাধারণ। যারা মোটা অংকের ফিস (টাকা) দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক বা প্রাইভেটভাবে গিয়ে ডাক্তার দেখাকে সমর্থ নন; তারাই নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত আসেন এখানে।
গত ৯ অক্টোবর রাতে ব্যক্তিগত কারণে গিয়েছিলাম সদর হাসপাতাল। বেরিয়ে আসার সময় চোখ আটকে যায় হাসপাতালের নারী ও শিশুদের টিকিট কাউন্টারে; কম্পিউটার কম্পোজ করে লেখা ‘অত্র হাসপাতালে কোন শিশু কনসালটেন্ট নেই -হাসপাতাল কতৃপক্ষ’। নেই শব্দের মাঝেই যেন সব দায়মুক্তি।
তবে এর মানে কি দাঁড়ায়? যে সকল শিশুর অবস্থা সংকটাপন্ন বা মারত্মক তাদের হয় প্রাইভেট ক্লিনিকে না হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু সব শ্রেণির মানুষের পক্ষে কি সম্ভব গাড়ি ভাড়া করে খুলনা বা চড়া মূল্যের ক্লিনিকে নিগে ডাক্তার দেখানো!
টিআইবি’র একটি প্রতিবেদন দেখে ছিলাম, বাংলাদেশে এক বছরে যে দুর্নীতি হয়, তা দিয়ে কয়েক হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় বা হাসপাতাল তৈরি করা সম্ভব। তাহলে অবশ্যই দুর্নীতি না হলে ঐ টাকা দিয়ে কয়েক হাজার ডাক্তারের বেতন দেওয়া অসম্ভব হতো না। অবশ্যই না!
আমাদের সিস্টেমেই কিছু সমস্যা থেকে যাচ্ছে, যা রোধ করা হচ্ছে না বা সমস্যা দূর করাকে বোঝা ভেবেই আমরা তার ধারে-কাছে যাই না।
তিন/চার বছর আগের কথা, ঈদের আগের দিন; বাড়ির পাশের এক ছেলেকে সাপে কামড়ালো। তাকে নিয়ে ছুটলাম সদর হাসপাতলে। কর্তব্যরত নার্স না দেখেই বলল, ‘সাপে কামড়ানোর পর যে ইনজেকশন দিতে হয়, তা এই হাসপাতালে নেই। ২৫০ বেড (খুমেক হাসপাতাল) যেতে হবে।’
একটু বিচলিত হলে বলেছিলাম, ‘ডিউটি ডাক্তার কই? আপনি-ই যদি সব চিকিৎসা দেন তো ডাক্তারের দরকার কি।’
পরে সাক্ষাৎ মিলে, ডাক্তার দেখে বলল, ‘বিষাক্ত সাপ না, সমস্যা নেই ভর্তি করান।’
বললাম, এখানে নাকি ইনজেকশন নাই। প্রতিউত্তরে জানান, হ্যাঁ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া থাকে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেড়িকেল কলেজ হাসপাতালগুলো হচ্ছে বড় শহর, বিশেষ করে বিভাগীয় শহরে। কিন্তু সাপের উপদ্রব কোথায় বেশি শহরে না মফস্বল বা গ্রামে???
ক’দিন আগের কথা। মাকে নিয়ে যখন খুলনা মেডিকেল হাসপাতালে ছিলাম তখন এক সাপুড়েকে দেখেছিলাম; সাতক্ষীরা থেকে রেফার করা, আনার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দিলেন। এই হলো সিস্টেম, ইনজেকশন সদর হাসপাতালে না থাকে বিভাগীয় শহরে থাকবে।
একবার শুনলাম, দাঁতের ডাক্তার জেলার সদর হাসপাতাল পায় নি, পেয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সিভিল সার্জন (সিএস) তাকে ডিপুটিশনে সদর হাসপাতালে এনেছেন। কারণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী আসে সপ্তাহে একটা। সিএস এমন না করলে, ডাক্তার হয়তো ডাক্তারি ভুলে মুরগির ফার্ম করতে চলে যেত।
বাগেরহাট সদর হাসপাতালকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নিত করা করা হয়েছে, কিন্তু লোকবল বাড়ানো হয়নি। বরং যে ডাক্তার আছে তাতে ৫০ শয্যা কেন, ২৫ শয্যার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসা সেবাও ভালো ভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। তারপর আবার নেতাদের চোখ রাঙানি তো হজম করতে হয় ডাক্তারদের।
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের এমন হাল কখনোই কল্পনা করা যায় না, যা বাস্তবে ঘটছে।
ধৈর্য্যচূত্যি ঘটাবো না, শুধু একটা ছোট্ট গল্প বলবো, গল্প না বাস্তব জানি না –মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ ক্ষমতায় থাকাকালীন অসুস্থ, চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হবে। তিনি বললেন, কেন, ডাক্তার নেই?
কর্মকর্তারা জানালেন ডাক্তার আছে, যন্ত্রপাতি নেই। বললেন, আমি সিঙ্গাপুর যাবো কিন্তু আমার দেশের সকল জনগণ কি যেতে পারবে? যন্ত্রপাতি আনাও, যদি বাঁচি তো চিকিৎসা হবে না হলে জনগণ চিকিৎসা পাবে।
আর আমার দেশের সোনার মন্ত্রীরা সর্দি লাগার আগেই বিদেশ যায়। তারা শুধু ছুতো খোঁজে বিদেশ যাওয়ার। যে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না, সে দেশে যায় দুর্যোগের প্রশিক্ষণ নিতে, শুধু তাই না, সাথে যায় স্ত্রী-সন্তানও। আর কত!!!!