• নাজমুল আহসান
[পূর্ব প্রকাশের পর] ৩
সৃজনশীলতা :
একজন নবীন শিক্ষার্থী আবৃত্তি কর্মশালা কিংবা ক্রমাগত অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে বাচিক শিল্প চর্চায় যেমন মনোনিবেশ করেন; উৎকর্ষ সাধনে ব্যাপৃত থাকেন, সাথে সাথে তার মনোজগতে, ব্যক্তি জীবনে, মগ্নতায় সৃজনশীলতার ফুল ফুটতে থাকে। আবৃত্তি একান্তই ধ্বনি নির্ভর, বাক্ সর্বস্ব। স্বর প্রক্ষেপণের পরিকল্পনা, আবেগ, কন্ঠের মীড় শ্রোতার উপলদ্ধিতে আরো বেশী সার্থক করে তোলে সৃজনশীলতার ছোঁয়া।
‘সৃজনশীলতা হলো ক্রিয়াশীল, সাংগঠনিক মনের একধরনের শক্তি যা চিন্তা (সৃজনশীল) ধারন এবং বিশ্লেষণে সক্ষম। আর এই ধারণ, বিশ্লেষণ হয়ে থাকে ইন্দ্রিয়াদির সমন্বয়ে প্রাপ্ত কল্পমূর্তির সাহায্যে। চোখ যার অন্ধ নয়, তিনি দেখতে পান, কান যার বধির নয়, তিনি শুনতে পান। কিন্তু শুধু সৃজনশীল ব্যক্তিই তার মনের চোখে দেখতে পান, মনের কানে শুনতে পান। এমনকি তাকে কল্পমূর্তি তৈরি করতে কোন নতুন বা স্মৃত উদ্দীপনার সহায়তা নিতে হয় না।… দক্ষ আবৃত্তির জন্য সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর প্রয়োজন সহজেই অনুমেয়।
সৃজনশীলতা ছাড়া কবিতার ভাব, নির্মাণ কাঠামো, চিত্রকল্প আবৃত্তিকারের কাছে পরিস্ফুট হবে না। আর সেটা না হলে যথার্থ আবৃত্তি হবে না। একজন আবৃত্তিকারের সঙ্গে অন্য আবৃত্তিকারের পার্থক্য সূচিত হয় সৃজনশীল ক্ষমতায়।
আবৃত্তির একটি পর্যায়ে (শুদ্ধ উচ্চারণ, স্বরমান, ছন্দজ্ঞান ইত্যাদি) সব আবৃত্তিকারের মান একই রকমের থাকে। সৃজনশীলতা বিকাশের সাথে সাথে পার্থক্য শুরু হয়ে যায়। আর যার সৃজনশীল ক্ষমতা যত বেশী আবৃত্তিকার হিসাবে তার অবস্থানও তত উঁচুতে নির্ধারিত হয়।’
মঞ্চে উপস্থাপন :
দর্শক শ্রোতারা আয়নার প্রতিবিম্বের মতো মঞ্চে উপবিষ্ট শিল্পীকে পর্যবেক্ষণ করেন, খুটিনাটি কোন কিছুই চোখ এড়ায় না তার। একজন কন্ঠশিল্পী, অভিনেতা, নৃত্য শিল্পী মঞ্চে একক প্রচেষ্টায় মোহবিস্তার করেন না, তার সংগে থাকে একদল যন্ত্রীর সুর মূর্ছনা, আবহ সংগীত, আলোর বিন্যাস, উপযোগী মঞ্চ সজ্জা ইত্যাদি।
সব কিছুর সামগ্রিক উপস্থাপনাই তার পরিবেশনা। কিন্তু একজন বাচিক শিল্পী আবৃত্তিকার এতগুলো অনুসংগের সাহায্য ব্যতিরেকে স্বরপ্রক্ষেণের পরিকল্পনায়, কন্ঠের খেলায় কবিতার অবগুন্ঠিত চিত্রকল্পকে দর্শক শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করেন যা অত্যন্ত দুরূহ কাজই বটে। মঞ্চ, আলো, অল্পবিস্তর আবহ সংগীত যা আবৃত্তির জন্য অত্যাবশ্যক নয় তবে আবহ সৃষ্টিতে কালেভদ্রে ব্যবহৃত হয়, উপযোগী মাইক্রোফোন এ নিয়েই আবৃত্তির পরিবেশনা।
একজন কুশলী আবৃত্তিকারকে এ ভাবেই অনুশীলনে নিবিষ্ঠ থেকে পরিমিতবোধ ধারন করে কবিতার শরীরে আকেঁন কন্ঠের কারুকাজ। শিল্পের প্রতি গভীর ভালোবাসা, সৃজনশীলতা, মেধা, বোধ নিষ্ঠাবান আবৃত্তিকারকে শ্রোতার সামনে নিয়ে যায় আত্মবিশ্বাসের সাথে, উপস্থাপনা হয়ে ওঠে সাবলিল এবং প্রাঞ্জল।
আবৃত্তির জন্য অনুষ্ঠান উপযোগী কবিতা নির্বাচন খুবই জরুরী, অত্যন্ত সংবেদনশীল মাইক্রোফোন যন্ত্রটি ব্যবহারে অধিক সচেতন থাকা প্রয়োজন। শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ, ধপ ধপ আওয়াজ, স্বর ফেটে যাওয়া, ঠোঁট খোলার শব্দ শ্রোতার মনযোগে বিঘ্ন ঘটায়, বিরক্তির উদ্রেক করে। মঞ্চে দাঁড়াবার সময় হাত দুটি কই রাখি – নবীনদের জন্য এ আর এক বিড়ম্বনা। কিংবা দাঁড়ানোর স্টাইলটাই বা কেমন হবে।
গুরুত্বপূর্ণ হলো দাঁড়ানোর ভংগি যেন মোটেই দৃষ্টিকটু না হয়, বসার ভংগিও যেন হয় দৃষ্টিনন্দন, সামগ্রিকভাবে স্বভাবিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সপ্রতিভ এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত। অনেক অনুষ্ঠানে চোখে ভীষন বিসাদৃশ্যপূর্ণ ঠেকে দলীয় পরিবেশনায় মঞ্চে প্রবেশ, অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চ থেকে বের হয়ে আসা, নানান জনের নানান পোশাক, পায়ে চপ্পল, কেডস কিংবা জুতা, মঞ্চের উয়িংসের ফাঁক গলিয়ে অনুষ্ঠান বা দর্শক দেখার জন্য অনুষ্ঠান আয়োজকদের কারো গলা বাড়িয়ে দেয়া, অনুষ্ঠানের মধ্যেই মাইক্রোফোন ঠিক করা যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। সামগ্রিক অনুষ্ঠান আয়োজনে খুঁটিনাটি কোন বিষয়কে ছোট করে দেখার অবকাশ নাই। মঞ্চ সজ্জা, অলোক বিন্যাস, ব্যাক ড্রপ, আবহ সংগীত, মাইক্রোফোনের বিন্যাস, আবৃত্তিকারের পোশাক, মিলনায়তন ব্যবস্থাপনা এ সমস্ত বিষয়ে আয়োজকদের আরো বেশী সর্তক, সচেতন ও আন্তরিক থাকা প্রয়োজন যা অনুষ্ঠানটিকে সামগ্রিক ভাবে শিল্পোত্তীর্ন ও সফল হতে সাহায্য করে ।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, আবৃত্তিজন নাজিম মাহমুদের আবৃত্তি বিষয়ক একটি লেখার কিছু অংশ তুলে ধরে ইতি টানছি এ লেখার। ‘শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ’- রবীন্দ্রনাথের এই সতর্ক উচ্চারণ শিল্পচর্চার যে কোন ক্ষেত্রে বারবার স্মরণ আবশ্যক।
যদিও আমাদের আবৃত্তিকাররা এতটা দায়িত্বের কথা স্মরণ রাখেন না। তারা প্রচলিত কিছু ছক অনুযায়ী আবৃত্তি করে থাকেন। তাতে করে মাঝে-মধ্যে শ্রোতাদের করতালি জুটলেও তা শ্রোতাকে অন্তর্মুখী অন্মেষণে চালিত করার মতো মুগ্ধ করতে পারছে না। যে কারণে শিল্পের এই নতুন মাধ্যমটির পায়ের নিচে মাটি দাঁড়াচ্ছে না। এই প্রয়াসে আবৃত্তিকারের কবিতার সঙ্গে নিরন্তর সম্পর্কের প্রয়োজন। কবির ভাবনার অংশীদার যে আবৃত্তিকার, কবিতার ভাবের বদল ঘটানো তার পক্ষে সম্ভব কেবল কবিতার সঙ্গে ঐ প্রবল সম্পর্কের দ্বারা। শব্দের জগতে কবিতার এক অপ্রকাশিত রূপকে শ্রোতার সামনে উপস্থিত করেন আবৃত্তিকার। সামান্য অমনোযোগ গোটা সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট।
আবৃত্তিকারকে তাই প্রথমেই বুঝে নিতে হয় কবিতাটি। যে কবিতার ভাবার্থ অনুধাবনে অক্ষম তার পক্ষে আবৃত্তির শর্ত মেটানো সম্ভব নয়। কবিতাটি বোঝা যদি আবৃত্তিকারের প্রথম কাজ হয়, তবে দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে স্বরক্ষেপণের বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেই অনুযায়ী ক্লান্তিহীন চর্চা। স্বরক্ষেপণের পরিকল্পনা তখনই বিজ্ঞানসম্মত হবে যখন তা বিষয়ের ভাবানুগত হবে। কবি প্রত্যেক শব্দে, বাক্যে, চরণে যে ভাব সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, আবৃত্তিকার সেই ভাবানুযায়ী স্বরভঙ্গি গ্রহণ করবেন।
এই গোটা ব্যাপারটাই নির্ভর করছে বস্তুত আবৃত্তিকারের আন্তরিকতায় উপর। তিনি যদি তার আবৃত্তিকে শিল্পের সম্মান দিতে চান তাহলে ঐ কাজগুলো করতেই হবে। কবিতার সঙ্গে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যার কোনো বিকল্প নেই।”
তথ্য সূত্র :
আবৃত্তিকোষ – নীরোদবরণ হাজরা
আবৃত্তিকলা – খসরু চৌধুরী
প্রবন্ধ : দর্শক শ্রোতার মনোরঞ্জন- নাজিম মাহমুদ
শিশুতোষ আবৃত্তিকোষ-সম্পাদনা মানর্দ্ধন পাল, জামিল ফোরকান
লেখক: আবৃত্তিকার।
e-mail: nazmulnewage@gmail.com