• মাসুমা রুনা
তখন ক্লাস এইট-নাইনে পড়ি, বাইরের দুনিয়ার প্রতি জানার এক প্রবল আগ্রহ তৈরি হয় মনের ভিতর। সেই জানা হল ক্লাসে পড়ার বাইরে আর কি কি বই পড়ার আছে। বাসায় না জানিয়ে বন্ধুরা মিলে এদিক সেদিক নিরাপরাধ ঘোরাঘুরি। অচেনা কারও সঙ্গে পত্রমিতালি, স্কুল ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীর বাসায় আড্ডা দেওয়া।
বান্ধবীর জন্মদিনে সবাই মিলে রিকসায় ঘোরা। অকারনে বন্ধুদের সাথে ঘন্টা চুক্তিতে রিকসায় ঘোরাঘুরি। বান্ধবীর বাসায় গিয়ে টিভিতে হিন্দি মুভি অথবা রোম্যান্টিক গান দেখা। একটু সাজুগুজু। একটু আয়না দেখা। কিম্বা নিজেকে আরও একটু সুন্দর দেখানোর জন্য চুলটা নতুন কোন স্টাইলে বাধা।
রাস্তায় চলতি পথে কেউ আমাকে ফলো করে তা বুঝেও না বোঝার ভান করে, মনে মনে খুশিতে হাল্কা বাকবাকুম হওয়া। এসবই হয়েছে আমার জীবনে। এগুলো খুবি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, অনেকের পরিবার এগুলো নিয়েই দুনিয়া তোলপাড় করে কিংবা মেয়েটা/ছেলেটা একেবারেই গেছে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়!
কথা হচ্ছে, চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে অন্তত এটা ভেবে দেখা উচিৎ যার সম্পর্কে বলছি, সে কি কাজগুলো অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে গেছে? ওই কাজের দ্বারা কি তার পরিবার, সমাজ এবং স্বয়ং সে কি অসম্মানিত হয়েছে? ভালো করে ভেবে বলুন।
উত্তর যদি হয় না। তাহলে বলবো তাকে অভিযুক্ত করা থেকেও তাহলে বিরত থাকুন।
আর উত্তর যদি হয় হ্যাঁ, তাহলে আমার দু’টি কথা আছে। আপনি অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে শাসন করেন কিন্তু কখনও অবসরে তার সাথে, তার বন্ধুর সাথে গল্প করেন কি? নিছক অর্থহীন কথামালায় কখনও তারদের সাথে হেসে গলে পড়েন কি??? নিশ্চই না, এখান থেকেই তার সঙ্গে আপনার কোন এক ফাঁকে বিস্তর ব্যাবধান তৈরি হয়ে গেছে! অতি ধিরে ধিরে, অতি সন্তর্পণে। আপনি জানতেই পারেন নি।
আপনার গাফেলতির কারনে সন্তান আজ আপনাকে না জানিয়ে অনেক কিছুই করে বসে! প্রেম ট্রেমও করে ! আবার ছ্যাকা খায়, ছ্যাকা দেয়। নেশা টেশাও করে। কারন তার মাথায় আপনি রবীন্দ্রনাথ এর নেশা ধরান নাই, তার মাথায় রুদ্র মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ ঢুকে নাই। কারন স্কুলের পড়া আর স্কুলেরই পড়া, এর বাইরে আপনি তার মধ্যে অন্য কিছু পড়ার নেশা ঢুকান নাই।
দয়া করে নিষ্পাপ শিশুদের (১৮ বছর পর্যন্ত শিশুকাল) নিষ্পাপ থাকতে দিন। বিশিষ্ট ধোয়া তুলসি পাতা, বড় হয়ে যাওয়া বড় বড় মানুষগুলো ভুলে যাই এরকম সদ্য ভালোলাগা, নিরাপরাধী উরুউরু ভাব আমাদেরও ছিল বৈকি!
আচ্ছা কি হয় ওদের কথাগুলো বন্ধুর মত করেই জানলে? বেতের বাড়ি মেরে আসল কথা জীবনেও উদ্ধার করতে পারবেন না, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। অথবা বেশি টাকা আছে দেখে টাকার বস্তা ঢেলে দিলেও আপনার আয়ত্তে সে আসবে না।
বন্ধু হওয়া খুব সহজ আবার খুব কঠিনও।
আপনি যখন বলেন, চল বেটা দুইটা লাটাই আর দুইটা ঘুড়ি কিনে আনি ! আজ ঘুড়ি উড়াব তোর সাথে!
দেখবেন তার চোখ দুটো কতটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! কিন্তু এই কথাটা আপনি বলতে পারবেন না। কারন আপনার অভ্যাস হলো কানের কাছে ঘ্যানর-ঘ্যানর আর তা না হলে সন্তানের উপর গোয়েন্দাগিরি! আর বড়জোর এসব বিষয় না দেখে দিনের পর দিন অবহেলা আর অবজ্ঞা করে দিন শেষে পিলে চমকে ওঠা !! আর বলে ওঠা “তুই আমার সন্তান না। হইতেই পারিশ না! কেম্নে করলি এমন কাজ!! বিড়ি খাইছস? সিগ্রেট ফুকোস ? মাইয়া নিয়া রিকসাত ঘুরোস ?! মুবাইলে ফুসুরফাসুর করোস?”
এখন আর কপাল চাপড়াইয়া কি হবে !! আদর ভালোবাসা ঘষামাজা কম ছিল আপনার, বেশি ঘষামাজা করছেন খালি শাসন প্রতিষ্ঠায় !
তাই, ওর সাথে, ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতান। আপনারই তো কলিজার টুকরা ! বয়ঃসন্ধিকালে তো তার মনের মধ্যে একটু বাইরের অজানা বিষয়গুল ইতিউতি মারবেই ! এটাই তো স্বাভাবিক তাই না!
একটু ছেড়ে দেন ওকে। তবে এমন ভাবে ভালোবাসুন আর তার সম্মানটা রক্ষা করুন যেন সেও আপনাকে তার প্রতিদান সেভাবেই দেয় !!!!!
ভালো থাকুক আমাদের ছোট থেকে সবেমাত্র বড় হতে যাওয়া সোনামণিরা ! ভালো থাকুক তাদের মাথার উপরে ছায়া , তাদের বাবা-মায়েরা!