গোপাল নাপিত। এলাকার সকল লোকের অন্তরঙ্গ বন্ধু। গোপালের ভাঙ্গা চেয়ারে যে যখনই বসে, তখনই গল্পের ঝাপি খুলে নিয়ে বসে গোপাল। কোন বাড়ির বউ নাকি পাশের বাড়ির অল্প বয়সি এক ছেলের সাথে লটর পটর। একদিন নাকি তার শ্বশুরের হাতে ধরা পড়েছে। আবার কোন বাড়ির বিধবা নাকি পাশের বাড়ির ব্রাহ্মনের সাথে থাকে। ব্রাহ্মন কর্তা বাবুর বাড়িতে বউ থাকলেও বাড়ি চালায় নাকি সেই বিধবা। মাধব বাবুর এবার চেয়ারম্যান হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। আবার গতকাল ম্যাজিষ্ট্রেট মিষ্টির দোকান চেক করে নাকি দইয়ের মধ্যে ইদুর পেয়েছে। আমের মধ্যে লম্বা লম্বা সাদা পোকা। তবে একটা সুবিধা গোপাল একাই বকে যায়।
বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে তবুও পেশা থেকে সরার উপায় নাই। এক সময় ভাল অবস্থা হয়েছিল। নিজে জুয়া খেললেও তেমন ক্ষতি হয়নি। যেমন ক্ষতি করেছে তার ছেলে বাপি। গোপাল তার জুয়ার বন্ধু হাশেম দুইজনেই তাদের ছেলেদের নাম রাখে বাপি। ছেলেদের বন্ধুত্বও অনেক গাঢ়। স্কুলে প্রত্যেকদিন যায় তবে পৌছায় না। রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। কোনদিন শহরের সিনেমা হলে আবার কোনদিন বর্শি নিয়ে পুকুর পাড়ে। আবার কোনদিন কারও বাগানের ডাব। বাপিদের জুয়ার নেশা না হলেও সিগারেট আবার কখনও কখনও সিগারেটের ভিতরে গাজা ভরে নেয়। বাপিরা স্কুলে যায় না, তবে স্কুলের সামনে ঠিকই বসে। স্কুলের সামনের চায়ের দোকানে বসলে অনেক মেয়ে দেখা যায়। আবার কখনও কখনও ম্যাডামদের। সে দৃশ্য বাপিরা শুধু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। মোবাইলে হরেকরমের ভিডিও তো আছেই।
হাশেম একটু রগচটা মানুষ। গোপাল সারাদিনে দোকান খুললেই খরিদার হয়। হাশেমের আয় নেই। তাই জমির জন্য কাউকে শায়েস্তা করা দরকার, কেচের সাক্ষী দরকার অর্থাৎ সমস্যা যার সমাধান নাই হাশেম আছে। শুধু টাকাটা ঠিকমত পেলেই হয়। টাকা পেলে সে নিজের বাবাকেও মারতে দ্বিধা করবে না। বাবা মরে গিয়েই বেচে গেছে। হাশেমের আয়ের অভাব নেই। ইদানিং চিংড়ী মাছ আসায় অনেকেই ঘের দখল, মাছ চুরি হাশেম আছে। মাধব দার উপর হাশেমের এমনই ক্ষোভ। গতবার মাছ ধরা কেচে চৌকিদার দিয়ে গাছের সাথে পিটিয়েছে। আবার জুতা খুলে মারতে আসে অপমান হয় না। গতবার নির্বাচনে রাত দিন খেটে জিতিয়েছে, এমনকি জাল ভোট দিতে পিছপা হয় নি। তার জন্য না হয় টাকা দিয়েছে। টাকা দিয়ে ভোট কিনেছে বলে আজ একটু সুবিধা পাবে না। গোপাল ওর সম্প্রদায়ের লোক। গোপালকে একটা কার্ড দিয়েছে। গত মাসে থানা থেকে ধরে নিয়ে গেল তখন বৌ আর বাপি গিয়েছিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে একবার বসতে বলা তো দূরে থাক কথাও বলেনি।
গোপালের ছেলে বাপি। এখন তার শুধু মেয়ে দেখার নেশা তাদের বিরক্ত করা শুরু করেছে। এর মধ্যে একদিন কয়েকটি মেয়েকে বিরক্ত করার কারণে স্কুলে প্রধান শিক্ষক, সভাপতি ডেকে টিসি ধরিয়ে দিল। বাপির কি যায় আসে। টিসি দেওয়ার আগেও সে ক্লাসে আসত না এখনও যায় না। টিসি দেওয়ার পর থেকে হেড স্যার কেমন জানি ভয় পায়। একদিন স্বরস্বতী পূজার চাদা চাইতে বাপি তার কয়েক বন্ধুকে নিয়ে স্কুলে গেলে স্যার তো বসতে বলে বলল চা খাবে। বাপির হাসি পেল। হাসি চেপে স্যারের সামনের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট ধরাল। স্যার অফিস সহকারীকে প্রথমে ১০০ টাকা দিতে বলে পরে বলল বাপি এসেছে ৫০০ টাকা দাও। বাপি এখন এলাকার নেতা। পড়ালেখা করে কি হবে? তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় অশোক একদিন এসে বলল বাপি শিখার বাবা আমাকে দেখে নেবে বলেছে, শিখাকে কথা বলতে বারন করেছে। দিন দুই পরে শিখার বাবা বাজারে দোকানে বসা। বাপিকে দেখতে পেয়ে বলল কাছে এসে বস। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। চায়ের সাথে দোকানদার সিগারেট দিল শিখার বাবার অর্ডারে। শিখার বাবা বলল দেখ বাপি মেয়েটাকে ঠিকমত স্কুলে পাঠাতে পারি না। রাস্তায় অনেকগুলো ছেলে ডিস্টার্ব করে। বাপি বুঝতে পারল সেই অনেকগুলো ছেলের মধ্যে বাপি অশোকও আছে। বাপি শিখার বাবাকে বলল দেখেন অন্যদের আমি বলে দেব আর অশোকতো ভাল ছেলে দেখেন অশোকের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। বাপির কথায় শিখার বাবার মুখ অস্বাভাবিক বর্ণ ধারন করল কিন্তু হাসি গেল না। বলল বাবা মেয়ে যখন হয়েছে বিয়ে তো দিতেই হবে। আরেকটু লেখাপড়া করুক। এরই মধ্যে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে পাগলা বিদ্যুৎ মারল। বিচারে তাকেও ডাকা হল। লেখাপড়া না হোক টিসি দেওয়ার অপমানটা বাপির ছিল। বিচারে বড় বড় কথা বললেও বাপির চালে পাগলা বিদ্যুতের কিছুই হল না।
হাশেমের ছেলে বাপি সে তো আগামী নির্বাচনে চেয়ারম্যান। মাধবকে দেখেই নিতে হবে। চেয়ারম্যান বাপিকে বানাতে হবে। থানা চেয়ারম্যান, এম.পি সাহেব বাপির মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে বলেছেন “তোমার মত অল্প বয়স্করা রাজনীতিতে না আসলে দেশ এগোবে কি করে?” বাপি একটা জিনিষ জানে দেশ এগোলে তো ভারতে যাওয়ার জায়গা নেই আর বঙ্গোপসাগরে গেলে তো তলিয়ে যাবে। দেশকে এগোনের থেকে নিজে এগোনো ভাল। ক্ষমতাশীন দলের মূল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাহেব আবার সেই আদর্শ রাজনীতিবিদ। তিনি মানুষের কি করে ভাল হবে তাই নিয়ে পরামর্শ দেন।বাপির শুনতে গেলে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। বাপি একটাই বোঝে মানুষ ভোট দেবে কাজ নয় টাকা আর ক্ষমতায়। টাকার বেশ কয়েকটি পথ আছে। কয়েকজনই বলেছে মাধবকে হারাতে যত টাকা লাগে লাগুক।
মাধবকে শুধু হারান নয় দেশ থেকে বিদায় দিতে হবে। ইন্ডিয়ায় যাক। হাশেমকে সনাতন বেশ কিছু টাকা দিয়েছে মাধবকে দেশ থেকে তাড়ানর জন্য। দেশ থেকে তাড়াতে পারলে পরে কিছু জায়গাও পাবে। অনেকদিনের বন্ধু গোপালকে এখন পছন্দ না করলেও কিভাবে মাধবকে তাড়ানর যায় জানতে চাইল। সাইনবোর্ড দোকানে খোকনের চায়ের দোকানের সামনে অনেক দিন পরে দুইজনে বসেছে চা খেতে। গোপাল কোথায় ভাল পরামর্শ দিবে। তা না সারা দেশের গল্প দিচ্ছে। নাপিতের যেমন স্বভাব। হাশেম রাগ চেপে রাখতে পারছে না। তবু ধৈর্য ধরে বসে আছে। শেষে বলে কিনা বাপির নির্বাচনে প্রভাব পরবে। রাগ চেপে রাখতে না পেরে হাশেম ঘুষি দেয় গোপালকে। শীর্ণকায় গোপাল পড়ে যায়। সবাই ধরাধরি করে তপন বাবুর ক্লিনিকে নেয়। ডাক্তার দেখে বলে চোখে লেগেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাও। হাসপাতালে নিয়ে গেলে বহি:বিভাগ থেকে বলল আগে থানায় জানাতে হবে। দুই বাপি থানা হাসপাতাল করতে করতে বুঝতে পারল তাদের যা ক্ষমতা তা এলাকায় এখানে কিছুই না। হাসপাতালের পিওন ওদের এলাকায় বাড়ি। যার সাথে কোনদিন কথা বলেনি। তারই সাহায্যে চিকিৎসা হল। কিন্তু চোখটায় গোপাল দেখতে পায় না।
হাসপাতাল থেকে গোপাল ফিরতেই হাসেম তার বাড়িতে যায়। হাসেমের ছেলে বাপি নির্বাচনে মাধবের কাছে হেরে যায়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে মাধবের বড় ছেলের নাইনে পড়া মেয়েটি হারিয়ে যায়, শোনা যায় গোপালের ছেলে বাপি নাকি বন্ধুর হারের প্রতিশোধ নিয়েছে।
এসআইএইচ/বিআই/১১ অক্টোবর, ২০১৬