• সুব্রত কুমার মুখার্জী
গ্রামের নাম খাদা। চারিদিকে রনবাদ্য। কেউ মুক্তিযোদ্ধা, কেউ রাজাকার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তারা মাঝে মাঝে আসে। আর রাজাকার তারা চারিপাশে। যখন আসে তখন কেউ বলে দেশে থাকবেন কি করে? আমরাই থাকতে ভয় আর আপনারা।
গ্রামের চারিপাশে ফাঁকা বিল। বর্ষাকাল বিলে কলমি শাক। গ্রামে কয়েকটি হিন্দু পরিবার। পাশেই কয়েকটি মুসলিম পরিবার। এতদিন যারা একে অপরের সুখে দু:খে এগিয়ে আসত। হঠাৎ করে সবাই কি রকম আলাদা হয়ে গেল। সব জায়গায় ফিশ ফিশ শব্দ।
ধনী বলতে কেউই এ গ্রামে বসবাস করে না। এর মধ্যে হালদার পরিবার একটু স্বচ্ছল। সারা বছরের ধান হয় তাই গ্রামে একটু আলাদা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হালদার পরিবারের নিশিকান্ত বাড়ির সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। বাড়ির সামনে পাকা না হলেও আধপাকা একটা মন্দির। মন্দিরে দূর্গা পুজা, কালি পুজা সবই হয়। গ্রামের সব লোকই পুজার কয়েকদিন প্রসাদ পায়। মুসলমান বলে তারাও বাদ থাকে না।
আবার ঈদের সময় নিশাকান্তের দাওয়াত থাকে গ্রামের মসজিদের ঈমাম তোরাবের বাড়িতে। চেনা জানা লোকগুলোর কেউ মুক্তিযোদ্ধা, কেউ রাজাকার। গ্রামের বিরেশ্বর মজুমদার সে রাজাকার না হয়েও প্রত্যেক রাতে লুটের মাল নিয়ে আসে। বিরেশ্বর বা বিরে লুটের মাল দেখে আর হিসাব করে বছর দু’য়েক আর ফলন না হলেও চলে যাবে।
একদিন কালাম বিরেকে জিজ্ঞেস করে তুমি হিন্দু হয়ে হিন্দুদের ঘর লুট করছ কেন? বিরে উত্তরে জানায়, আমি যখন না খেয়ে থাকি ওরা হিন্দু বলে কি আমাকে দেয়, এই সুযোগ। একদিন নিশিকান্তর বাড়িতে তোরাব গিয়ে বলে, দেখ নিশি দেশের যা অবস্থা তার মধ্যে তোকে নিয়ে আমি পড়েছি এক বিপদে।
ইমাম সাহেব কখনই চান না নিশি ক্ষতি হোক কিন্তু করার কি? ঈদানিংকার পোলাপান তাকে পিস কমিটির প্রধান বানিয়েছে। মিটিং বলেছে আপনার বন্ধু বলে নিশিকে আমরা ছাড় দিব না। নিশির মেয়ের দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকাত আফসার। সেই আফসারকে গ্রামের শালিশীতে জুতার বাড়ি দেওয়া হয়েছিল। এ বিচারে নিশির কোন হাত ছিল না। বরং নিশি বলেছিল ছেড়ে দেন ভূল করেছে।
নিশির মেয়ে ইন্ডিয়াতে যাওয়ার পথে মোল্লাহাট থানায় ধরা পড়েছে। মোল্লাহাটের রাজাকাররা ধরে থানাতে দিয়েছে। তবে দেওয়ার আগে নৌকায় যা পেয়েছে তা নিয়ে নিয়েছে। নিশির মেয়ের অনুভা। নিশির মা গোলাপ। নৌকায় ছিল নিশির দুই ভাই।
অনুভার সাথে থানার দারোগা সিন্ধীর বিয়ে দেওয়ার শর্তে সবাই মুক্তি পায়। অনুভাকে রেখে রওনা হয় নৌকা। কিছুদূর যেতে রাজাকার বাহিনী আবার নৌকা থামায়। এবার আর কোন কিছু না পেয়ে পুরুষদের দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
রাজাকার সর্দার সুফি সাহেব ও তার ছেলে খুবই দয়ালু। মহিলাদের মারেন না। বরং তার বাড়িতে থাকার ব্যাবস্থা করে। অনুভাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়।
সিন্ধী দারোগার বউ হবে। মাওলানা ফজলুর রহমান বিয়ের আগে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার ব্যাবস্থা করেন। অনুভার সাথে সিন্ধী দারোগার বিয়ে হয়। বিয়েতে কনে পক্ষের সবাই উপস্থিত ছিলেন। সুফি সাহেব খুবই ভাল লোক। একটি নৌকায় করে নিজেই মেয়ের বাড়ির জীবিত সবাইকে নিয়ে হাজির হলেন থানার দারোগার বিয়েতে। আসতেই হবে সিন্ধী দারোগার বিয়ে।
দারোগার এক কথা তার বউয়ের বাড়ির লোক যে ধর্মের হোক না কেউ যেন অপমান না করে। সুফি সাহেবকে ডেকে বলে তার বাড়িতে যেন তাদের অযত্ন না হয়। বিয়ের পর অনুভার মা গোলাপ মনে শান্তি নিয়ে ফিরে আসে তবুও মেয়েটার একটা ঠিকানা হল।
নিশি মানুষের কাছে শোনে তার পরিবারের কাহিনী। প্রত্যেকটা রাত না ঘুমিয়ে কাটে। কোন দিন বাড়ির পাশের বাশ বাগানে আবার কোনদিন ডুংকুর বাগানে। এর মধ্যে একদিন রাতে দেখে তারই ঘরের সামনে সারা বছরের কামলা হানিফ একটি মেয়েকে নিয়ে আসে। তবে হানিফ একা নয় তার সাথে আরও অনেকে।
নিশি দূর থেকে বুঝতে পারে হানিফদের অত্যাচারে একসময় নিস্তেজ হয়ে যাওয়া মেয়েটির অবস্থা। হানিফরা চলে যেতে নিশি বেরিয়ে আসে মেয়েটির কাছে যায়। হাতের আলোয় মেয়েটির শরীরে পড়লে চোখ বন্ধ হয়ে যায়। পাষন্ড গুলো এভাবে মেয়েটার উপর। তার মেয়ের কথা মনে পড়ে। তবুও ভাল আছে সে। একজনের হাতে আসে।
মাজার গামছা খানা দিয়ে মেয়েটির শরীর ঢেকে দেয়। বুঝতে পারে মেয়েটি বেঁচে নেই। সকাল হতে না হতে ইমাম সাহেব আর তার সাঙ্গ পাঙ্গরা আসে। তাদের চাল চলনে যেন কিছুই হয়নি। নিশিকে বলে তুমি মুসলমান হও না হলে আমরা কিছুই করতে পারব না।
নিশি ভেবে দেখে রোজ কুকড়ে কুকড়ে মরার থেকে তাইই ভাল। ধর্ম দিয়ে কি হবে। আগে বাঁচতে হবে। ইমাম সাহেবকে বলে তাই হবে। এলাকার সবাইকে ঢেকে নিশির বাড়ির সামনের মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ করা হয়। আর নিশির নাম হয় নাসিরউদ্দিন।
নব ধর্মে দিক্ষিত হয়ে কিছুদিন পর রোজা। হিন্দু থেকেও কোনদিন উপোস করে নি নিশি। সেই নিশি রোজা থাকে। নামাজ পড়ে। ইফতার করে, সেহেরি করে। কিন্তু ঈদুল ফিতর এর কোলাকুলি আর নিশির করা হয় না।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে এক রাতের মধ্যে নিশি মারা যায়। মুসলিম রীতি অনুযায়ী নীশিকে কবর দেওয়া হয়।
অনুভা স্বামীর সাথে খুবই ভাল আছে। অনুভার প্রচেষ্টায় জীবতরা শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ায় চলে যেতে সক্ষম হয়। সিন্ধী দারোগা বেতন তুলতে খুলনায় যায়। সিন্ধী আর ফেরে না। কেউ বলতে পারে না দারোগা মারা গেছে না পালিয়ে গেছে।
অনুভার স্বামী হারিয়ে আবার পণ্য হয়। এবার চোখ পড়ে সুফি সাহেবের ছেলের। এরই মধ্যে চলে এল স্বাধীণতা। অনুভা ফিরে এল বাড়িতে। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এল অন্যরা।
কবর থেকে নিশীর লাশ তুলে হিন্দু ধর্মমতে দাহ করা হল কিন্তু অনুভার কি হবে সে যে মুসলমানের বিছানায় গেছে। কেউ তাকে ঘরে নিল না।
এসআইএইচ/বিআই/০৪ জুলাই, ২০১৬