• মাহা মির্জা
দেশ একটা ভয়াবহ সঙ্কটে আর আপনারা আছেন তেল গ্যাস রামপাল নিয়ে। এমন প্রশ্ন উঠেছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আন্দোলনের কর্মী হিসাবে কিছুটা উত্তর দেবার চেষ্টা করছি।
এখানে বলে রাখি, যারা জঙ্গিবাদ/সাম্প্রদায়িকতা/ধর্মীয় গোড়ামি নিয়ে নিয়মিত লিখছেন, গবেষণা করছেন, নিউজ করছেন, আপনাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। আপনাদের কাজের সঙ্গে আমাদের কাজ সাংঘর্ষিক-তো নয়ই, বরং একটা আরেকটার পরিপূরক। আপনারা বলছেন এই মুহূর্তে দেশে দরকার একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই বিষয়ে আমাদেরও কোনো দ্বিমত নেই।
কিন্তু রামপালের আন্দোলন কি একটা পরিপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়? এই আন্দোলনে গান আছে, নাটক আছে, ফটোগ্রাফি আছে, ফিল্ম আছে, এনিমেশন আছে, কার্টুন আছে, স্যাটায়ার আছে, পড়াশুনা আছে, একটা বিকল্প উন্নয়নের দর্শন আছে, যুক্তির চর্চা আছে, বিজ্ঞানকে জানার বোঝার চেষ্টা আছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে বিস্তর পড়াশুনা আছে। এখানে মিছিল আছে, আবার মিছিলের পথে পথে গান, নাটক, কবিতা আছে। এখানে গ্রাম বাংলার পালস আছে, বাঘ পাখি হরিণ আছে, সুন্দরী, কেওড়া, গজারি আছে, সুন্দরবনের গভীর ইকোলজিকে বোঝার চেষ্টা আছে, পশুর নদীকে সালফারের বিষ থেকে বাঁচানোর আকুতি আছে, চার লক্ষ প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকার চিন্তা আছে। তরুণদের অংশগ্রহণ আছে। ক্ষমতাকে এবং গণবিরোধী প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো তথ্য আছে, সাহসও আছে। তুমি কয়লার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারো, মন্ত্রী মিনিস্টার হতে পারো, বিশেষজ্ঞও হতে পারো, কিন্তু আমি পাবলিক, এবং সংবিধান অনুযায়ী এই দেশের মালিক, তাই আমার কনসার্ন আমলে নিয়েই তুমি পলিসি বানাবা, এই গভীর রাজনৈতিক উপলব্ধি আছে। মা মাটি মোহনা ধ্বংস হতে দেবোনা -এমন স্লোগান আছে। এটা আমার সংস্কৃতি না? এটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন না? তাহলে কোনটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন!
আমরা সবাই বলছি আমাদের তরুণদের সামনে কোনো আদর্শ নাই। স্বপ্ন নাই। এই ভ্যাকুয়েমে জঙ্গিবাদ ঢুকে পড়েছে। তাই সামনে আদর্শ লাগবে। কিন্তু এই আদর্শটা, এই স্বপ্নটা কেমনে তৈরী হবে? এটা তো আকাশ থেকে পড়বেনা। এর জন্যে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার সেটা কেমনে হবে? স্টেইটের স্পন্সরশীপে? ট্রেইনিং দিয়ে? মানব বন্ধন করে? বিচ্ছিন্নভাবে গান বাজনা করে? কর্মসূচি দিয়ে? ধর্মকে গালমন্দ করে? এই দেশের মাটির সঙ্গে, ফসলের সঙ্গে, নদনদীর সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে, মানুষের ঘামের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরী হলেই না হয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
গত কয়েক সপ্তাহে রামপাল প্ল্যান্টের ক্ষতি নিয়ে লেখাগুলো ভাইরাল হয়েছে। প্ল্যান্টের অর্থনৈতিক ক্ষতি, কয়লার বিষ, সুন্দরবনের ক্ষতি, এই আলোচনাগুলো কিন্তু খুব সহজ না, কিন্তু তবু ছেলেমেয়েরা পড়ছে, হাজারে হাজার শেয়ার হচ্ছে। যে ছেলেটা সুন্দরবনকে বোঝার চেষ্টা করছে, কয়লার ক্ষতি বোঝার চেষ্টা করছে, পশুর নদীর জন্যে যার মন কেমন করছে, একটা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলার রূপ রস গন্ধ যার কাছে কিছুটা হলেও পৌঁছেছে, সে হতে পারবে জঙ্গি? ধর্মান্ধ?
কেউ বলছে এই আন্দোলন ভারত বিরোধী। তাই এতো পপুলার। কিছুটা সত্যতা এখানে হয়তো আছে। কিন্তু আন্দোলনের প্রতিটা পর্যায়ে একটা কথা বারবার প্রচার করা হয়েছে। আর সেটা হলো, এই আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের ভারতীয় বন্ধুরা আছে। ভারতের বিভিন্ন ফরেস্ট ইউনিয়ন, ট্রেইড ইউনিয়ন, সাইন্স ক্যাম্পেইন বরাবরই এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েচে। লং মার্চে তাদের ১২ জন হেঁটেছেন আমাদের সঙ্গে। পথে পথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। বারবার বলা হয়েছে, ভারত রাষ্ট্র আর ভারতের গণমানুষ এক না। এনটিপিসি আর আদানির কয়লা প্ল্যান্টের বিরুদ্ধে সারা ভারত জুড়ে কত যে গৌরবময় আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। ২৮ তারিখের পুলিশি হামলার পর এই বন্ধুরাই একের পর এক সলিডারিটি মেসেজ পাঠিয়েছে। কলকাতায় পর পর কয়েক দফায় গান হয়েছে, প্রতিবাদ হয়েছে, মুম্বাইয়ের আইআইটিতে ‘সেইভ সুন্দরবন’ ফটো ক্যাম্পেইন চলছে। আমাদের বন্ধু তারিণী একটা ছবি তৈরী করেছে এই আন্দোলন নিয়ে। ছবির নাম, এক হও লড়াই করো। নিজ নিজ রাষ্ট্রের গণবিরোধী প্রকল্পগুলোর সামনে ভারত বাংলাদেশের মানুষ যে এক হতে পারে, একটা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এই বুঝটাও যদি তৈরী হয় সেটা বড় অর্জন নয়? আরো কথা আছে। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বাঁশখালীতে চায়নার প্রজেক্ট, রূপপুরে রাশিয়ার প্রজেক্ট, আর বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তিগুলো বাতিলেরও দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা বিকাশের কথা উঠেছে বারবার। এই আন্দোলন তাই সবগুলো বিদেশী কোম্পানির হরিলুটের বিপক্ষে। এই আন্দোলন শুধুই বাংলাদেশ রক্ষার।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাংস্কৃতিক চেতনা এগুলোতো দীর্ঘদিনের চর্চার বিষয়। দুদিনে অর্জনের বিষয় না। এই মুহূর্তে আমরা আছি অন্ধকারে। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, দিনে দিনে আমরা সাম্প্রদায়িক হয়েছি, ধর্মের নাম অসহিষ্ণু হয়েছি, যুক্তিহীন হয়েছি, বিবেকহীনও হয়েছি। কোথাও কোনো স্বপ্ন নেই। আলো নেই।
এই সময়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এটা একটা আলোর জায়গা। সুন্দরবনকে বাঁচানোর এই আন্দোলনেই আছে আবহমান বাংলা। বাংলার নদী, মাটি, শিকড়, ফুল আর ফসল। ধর্মের নামে খুন খারাবি আর অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা ছড়ানোর দিনে এখানেই তৈরী হয়েছে একটা সিস্টেমেটিক বিজ্ঞান আর যুক্তি চর্চার প্ল্যাটফর্ম। এই আন্দোলনে অসংখ্য তরুনের সাপোর্ট, সুন্দরবনকে নিয়ে তাদের উচ্ছাস, বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের স্বপ্নেরই প্রকাশ। রামপালের আন্দোলন তাই গুটিকয়েক পরিবেশবাদীর রোমান্টিক আন্দোলন নয়। এটা একটা পূর্ণাঙ্গ সাংকৃতিক আন্দোলন। এটা একটা বিজ্ঞানমনস্ক আন্দোলনও। এটুকু বিশ্বাস করি, এমন একটা আন্দোলনের স্পিরিট এবং এনার্জি যত ছড়াবে, এই দেশে তরুণদের জঙ্গি হবার সম্ভাবনা ততই মলিন হবে।
লেখক: গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট।
এসআইএইচ/বিআই/০২ জুলাই, ২০১৬