• পলাশ কুমার পাল
অনেক সাফল্যের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ বর্তমান অবস্থায় এসে দাড়িয়েছে। এই সাফল্য গাঁথয় অবদান আছে সরকারের, বিরোধী দলের, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের, সর্বপরী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের।
নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগনের অসীম সাহস ও ঈর্ষণীয় সাফল্য এবং বৈশ্বিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগামী অবস্থান আমাদের সবাইকে আপ্লুত ও আনন্দিত করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এই সাফল্যকে ম্লান করছে কিছুটা।
পত্র পত্রিকায়, টেলিভিশন, অনলাইন মিডিয়ায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও এসব নিয়ে হচ্ছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। প্রায় সকলেই বলছেন রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতার, জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের কথা। রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারহীনতার কথা, সমন্বয়হীনতার কথা বলতে শুনেছি অনেকের মুখেই। কিন্তু আমাকে খুবই উদ্বিগ্ন, চিন্তিত ও ব্যথিত করে সামাজিক অবক্ষয়, মানুষের অমানবিক আচরন ও মানবীয় গুলাবলী নি:শ্বেষ হয়ে যাওয়ায় এই নিরব ধারা বা প্রক্রিয়া।
আমি জড়সড়, স্থবির, নিশ্চুপ হয়ে পড়ি যখন আমি সংবাদপত্রে দেখি বাবার হাতে সন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, ভাই ভাই খুনাখুনি, ৭ বছরের শিশু ধর্ষিত, স্বামী স্ত্রী সংঘাত। আমি আতঙ্কিত হই এবং লজ্জা পাই পুরুষ হিসেবে যখন দেখি বা শুনি আমার পাশেই একজন বলছেন এই ধর্ষণ করার পেছনে মেয়েদের চলাফেরা, পোষাক-আশাক নাকি অনেকাংশেই দায়ী। ৭, ৮, ৯ বা ১০ বছরের শিশুর চলাফেরা, পোশাক আশাকের কি দায় আমি বুঝতে পারি না।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের দায় আমরা সরকারের বা বিরোধীদলের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারলেও, সামাজিক বা মনস্তাত্তিক এই যে অস্থিতিশীল পরিবেশের দায় ভার তো আমাদের নিতেই হবে। মানবীয় গুনাবলীর চর্চা ও অর্জন তো আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। এই চর্চা শুরু করতে হবে আমাদের পরিবারের ভেতর থেকেই। আমাদের পরিবার গুলোতে জ্ঞানের চর্চা, সংস্কৃতিক চর্চা, সুরুচির চর্চা অনেক খানি বাড়াতে হবে।
আমার খারাপ লাগে যখন দেখি আমাদের মায়েরা ও বোনেরা পরম আগ্রহে ও ভালোবাসায় ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিরিয়াল গুলো অনেক রাত জেগে দেখেন। এই ধরনের বিনোদনে ভালোটা শেখার থেকে খারাপটা শেখার সুযোগটা অনেক বেশি। এই সকল অনুষ্ঠান সমাজে এবং আমাদের মন জগতে খারাপ প্রভাব ফেলছে। আমরা বোধহয় তা বুঝতে পারলেও বুঝতে চাইছি না। এই অবস্থান থেকে উত্তরনে আমাদের মত যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা বাড়ির সবাই মিলে একটা ভালো সিনেমা দেখতে পারি, গান শুনতে আর গানের আসর বসাতে পারি পরিবারের সবাইকে নিয়ে, কোন ভাল বই নিয়ে কথা বলতে পারি অথবা পড়ে শোনাতে পারি, সবাই মিলে ঘুরে আসতে পারি কোন দর্শনীয় স্থানে। আমরা পারি এমন অনেক কিছু করতে।
মা-বাবা বা পরিবারের বয়জেষ্ঠরাও এই প্রক্রিয়ার একটি প্রধান অংশ। তাদেরকেও ছোট বেলা থেকে সন্তানদের মনে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সততা, ভালোবাসা, মমতা ও স্নেহের বীজ বপন করতে হবে, তাহলেই সন্তানেরা একদিন দেশের সম্পদ হবে। বাবা মায়েরা তো পারেন শতব্যস্ততার মধ্যেও সন্তানের সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে যখন তারা সন্তানদের ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝানোর প্রয়াস করতে পারেন।
অভিবাবকদের কাছে অনুরোধ জানাব পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি সন্তানদের ভাল বই কিনে দিতে এবং পড়ার উৎসাহ জাগাতে। ওরা যেন মন খুলে পড়তে পারে। ভাল বই সন্তানদের শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত ও সফল মানুষই বানাবে না, সাথে সাথে হৃদয়বান, মানবীয় গুনাবলী সম্পন্ন মানুষে পরিনত করবে। পাঠ্য পুস্তকের পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস সময় বা অর্থ অপচয় একেবারেই নয়, দিনে দিনে সুবিবেচক মানুষে পরিণত হওয়ার একটা উপায়। আর যেন কোন সন্তানকে পাঠ্য পুস্তকের মাঝে গল্পের বই রেখে লুকিয়ে পড়তে না হয় সেই আশাবাদই ব্যক্ত করব।
সন্তানের পছন্দ অনুযায়ী সুকুমার বৃত্তিগুলো প্রষ্ফুটিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে অভিবাবক এবং চারপাশের মানুষদেরকে। গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি, বাগান করা, খেলাধুলা, ছবি আঁকা, মঞ্চ নাটকে অভিনয় করা এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে সব সময় উৎসাহিত করতে হবে সকলকেই কারন এগুলো মানুষকে অন্যায় থেকে, নিষ্ঠুরতা থেকে একটু একটু করে দুরে নিয়ে যাবে।
জানি সব ক্ষেত্রে এটা করা হয়তো সহজ নয়। কিন্তু আমাদের করতেই হবে। শুধু আমাদের জন্য নয়। আমাদের দেশের জন্যও বটে। আজকাল আমরা তরুণ সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই ফেসবুক, ভাইবার, ওয়াটসঅ্যাপ, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে বুদ হয়ে পড়ে থাকি। আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাইরেও একটা সত্যিকার দুনিয়া আছে। যেখানে অনেক কিছু করার আছে তরুনদের।
মোবাইল ফোনের ছোট পর্দায় জীবনটাকে বন্দী হতে দিয়েছি আমরা নিজেরাই। এগুলো হয়তো জীবনের খুব ছোট একটা পার্ট হতে পারে, কিন্তু জীবন তো নয়। তাহলে কেন আমরা বন্দী হব। আমরাতো এই দেশের এই পৃথিবীর। দেশের জন্য, পৃথিবীর জন্য আমাদের কাজ করতে হবে, হতে পারে সেই কাজটা খুবই সাধারন, সামান্য কিন্ত এই পথ চলা আমাদের অসামান্যে পৌঁছে দেবে।
আমরা যদি একজন মানুষের মুখেও হাসি ফোঁটাতে পারি, সুবিধা বঞ্চিত একটাও শিশুর মনে যদি আশা আর আনন্দের সঞ্চার করতে পারি, একজন অত্যাচারিতকে যদি অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে পারি, একজন মাকেও যদি হিন্দি সিরিয়াল দেখা থেকে সরিয়ে আনতে পারি, তাহলেই বা কম কিসে।
আমরা তো পারি সন্ধ্যা বেলা বাসার ছাদে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে বাসার সবাইকে শোনাতে, যেমন খুশি তেমন গল্প বলার আনন্দে সবাইকে অনেক বেশি হাঁসাতে। আমাদের পারতেই হবে। আমাদের সামাজিক মানুষ হিসাবে, মানবীয় গুনাবলী সম্পন্ন মানুষ হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য অবিরাম চর্চা করতে হবে। এই চর্চা তো চিরন্তন। তাহলে সমাজে অপরাধ প্রবনতা অনেক খানি কমবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি সর্বস্তরের সকলের বিশেষ করে যাদের মিডিয়াতে কথা বলার সুযোগ আছে তাদের কাছে বিনীত ভাবে অনুরোধ জানাবো তারা যেন এই সামাজিক এবং মনস্তাত্তিক বিপর্যয়ের কথা ও মানবীয় গুনাবলীর পুনঃগঠনের কথা বলেন সকলের সামনে।
মানুষকে মানবীয় গুলাবলী সম্পন্ন মানুষে পরিণত করার পথ নির্দেশনা দেন। শারীরিক অসুস্থতার সাথে সাথে মানসিক সুস্থতার ব্যাপারেও আমাদের সচেতন হতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিপর্যয়ের সাথে সাথে সামাজিক, মানবিক ও মনস্তাত্তিক বিপর্যয়কেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের জন্য আমাদের মত তরুনদের অনেক কিছু করনীয় আছে, সেই কাজগুলো আমাদের অবশ্যই করতে হবে।
দেশটা তো আমাদেরই, আমাদেরকেই তো ভাবতে হবে…………………। আমার বিশ্বাস আমরা অবশ্যই ভাববো।