জয় বাংলা রোগ
১. ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগ মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে মুক্তিযোদ্ধারা ভুগেছেন, ভুগেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। পাকি বাহিনীর ভোগান্তিটা একটু বেশী ছিল, কারণ তারা এই রোগের সাথে পরিচিত ছিল না। অনাকাঙ্খিত এই মহামারি কোন কোন ক্ষেত্রে ট্যাকটিকালি গেরিলা যোদ্ধাদের কিছুটা সুবিধা এনে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা চোখ ওঠা রোগকে মজা করে বলতেন ‘জয় বাংলা রোগ’। এমনকি সীমান্তের ওপারে যেসব অস্থায়ী হাসপাতালে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া হত, সেখানকার ডাক্তাররাও কনজাংটিভাইটিসকে বলতেন জয় বাংলা রোগ।
২. একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীকে ‘জয় বাংলা’ নামে নামকরণের একটি ফ্যাশন শুরু হয়েছিল। আহমদ ছফা তার অলাতচক্র উপন্যাসে লিখেছেন, “শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের নাম জয়বাংলা স্যান্ডেল। এক হপ্তার মধ্যে যে গেঞ্জি শরীরের মায়া ত্যাগ করে তার নাম জয়বাংলা গেঞ্জি। জয়বাংলা সাবান, জয়বাংলা ছাতা কতকিছু জিনিস বাজারে বাজারে ছেড়েছে কলকাতার ব্যবসায়ীরা। দামে সস্তা, টেকার বেলায়ও তেমন। বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের ট্যাঁকের দিকে নজর রেখে এ সকল পণ্য বাজারে ছাড়া হয়েছে।”
৩. তিন দিন ধরে জয় বাংলা রোগে ভুগছি। যতদূর মনে করতে পারি, ছোটবেলায় একবার হয়েছিল। বড় বিশ্রী এই রোগ। ছোঁয়াচে। এই তিনটে দিন ঘরের এক কোনে অস্পৃশ্যের মত পড়ে রয়েছি। ছোট্ট মেয়েটার কাছে যেতে পারছি না। মাঝে মাঝে দুএকবার সামনে পড়ে গেলে ভারী বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। সানগ্লাস পরে থাকি বলে আরিয়া অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে আমাকে সে চিনতে পারছে না। কখনো সখনো গাড়ি চালানোর সময় আমি সানগ্লাস পরি। পাশে মায়ের কোলে বসে থাকে আরিয়া। তখনো খেয়াল করেছি, সানগ্লাস চোখে পরার সাথে সাথে সে উত্তেজিত হয়ে যায়। হাতপা ছুড়তে থাকে। মনে হয় যেন ওর হার্ডওয়ারে গোলমাল লেগে গেছে। সানগ্লাস না খোলা পর্যন্ত থামে না।
৪. আরিয়া এখন আর আমাকে দেখে লাফিয়ে কোলে আসতে চাইছে না। আমাকে দেখে ভুবন ভোলানো হাসি দিচ্ছে না। ও যেন আমাকে চিনছেই না। এই তিনদিনকে বাপকে ভুলেই গেল না কি!
৫. জয় বাংলা-য় ভুগে এবার একটা উপকার হয়েছে। আমি এখন নিজেই চোখের ড্রপ দিতে পারি।
ঢাকা, ১৭ই মে ২০০৬