মা, তুমি এই প্রথম একটা ইংরেজি নতুন বছর দেখলে। তুমি যেদিন পৃথিবীতে এলে তখন বছরটা এরই মধ্যে পুরনো জিরজিরে হয়ে গেছে। কিন্তু আজকের ক্যালেন্ডারে বছরটা মাত্র দুদিন বয়েসী। তোমার যেদিন দুদিন বয়েস ছিল, সেদিন তোমাকে আর তোমার মাকে হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ থেকে কেবিনে দেয়া হয়েছিল। সেই প্রথম আমি তোমার খুব কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। কেবিনে যাওয়ার পথে আমি আমার একটি আঙুল তোমার মুঠোর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলাম। আর তুমি খপ করে সেটাকে ধরে ফেলেছিলে। কেবিনে পৌঁছানো পর্যন্ত ছাড়নি তুমি। তখনো আমি তোমাকে কোলে নিতে শিখে উঠিনি। নার্স তোমাকে হাতের মধ্যে তুলে দিয়েছিল। কাপড়ে পেঁচানো ছোট্ট এক পুটুলি তুমি। আর আজ তুমি কত বড়।
আজ তুমি তিন মাস এগার দিন। তোমার চোখ দুটি ভারি উৎসুক। প্রথমদিন যখন তুমি চোখ মেলেছিলে, সেদিন তুমি যেমন একবারে সারা পৃথিবীটা দেখে ফেলতে চেয়েছিলে। আজও তেমনটি আছ তুমি। তোমার চোখ সারাক্ষণ ঘুরছে। তুমি ইতিউতি দেখছ। অবাক হচ্ছ, হাসছ, প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছ। তোমার চোখ থেমে নেই। কিন্তু একটা ব্যাপার যখন ঘটে তখন তোমার চোখ থেমে যায়। তুমি থেমে যাও। নিষ্পলক হয়ে যাও। সেটা ঘটে যখন তোমার মা তোমার সামনে নাচে। তোমার মা প্রায় প্রতি সন্ধ্যেতেই তোমাকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে একটা গান চালিয়ে তোমার সামনে নৃত্য করে। পুরো সময়টা তুমি অপলক থাক। তুমি মুখে আঙুল দিতে ভুলে যাও। অবশ্য তোমার মায়ের নাচের সৌন্দর্য তুমি কতটা অনুধাবন করতে পার তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ আমি নাচলেও তুমি অপলক থাক। কিন্তু তোমার মায়ের নাচ আর আমার নাচের মধ্যে ঠিক ততটাই তফাৎ যতটা তফাৎ কিন্নরী আর দানবের মাঝে। কিন্তু এটা বুঝতে পারি, নৃত্যে আর সঙ্গীতে তোমার স্বভাবজাত আগ্রহ আছে।
তুমি জানো, তোমার মা কত বড় একজন নাচিয়ে? আফসোস, আমিও জানতাম না! বিয়ের আগে জানতাম তোমার মা একজন শিল্পী এবং বণিক। একই মানুষের এই দ্বৈত সত্ত্বা আমাকে দারুণ অবাক করতো। আজও করে। তার কৃতিত্বের প্রকাশ পরিধেয় সজ্জায় আর বিপণনে। কিন্তু তোমার মায়ের মুখে যেটা শুনিনি, সেটা শুনেছি তোমার নানুবাড়ির আত্মীয়দের মুখে। তোমার মা ছিল নৃত্যশিল্পী। ধ্রুপদী নৃত্যে তাঁর দখল শৈশব থেকেই। আমাদের ছোটবেলায় যখন একটামাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল বাংলাদেশে, তখন সেখানে প্রায়ই ডাক পড়তো তোমার মায়ের। নৃত্যজীবনের শেষ দিকে শিক্ষকতাও করেছে কিছুদিন। তোমার মায়ের সেই নাচ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল তাঁর সাথে গাঁটছড়া বাঁধার চার বছর পর। আর এখন তুমি প্রতি সন্ধ্যেতেই তাঁর নাচ দেখ।
আমি আর তোমার মা কখনো চাইনি তোমার ভবিষ্যৎ একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে আটকে দিতে। ভবিষ্যতেও চাইব না বলে আশা রাখি। আমরা চাই তুমি হেসেখেলে যেমন খুশী তেমনি বড় হবে। তোমাকে কোথাও ফার্স্ট হতে হবে না। তোমাকে নানা এক্সট্রা কারিকুলামের বিধিনিষেধ দিয়ে শিল্প-সাহিত্যকে তোমার কাছে তেতো করে তোলা হবে না। কিন্তু একটা লক্ষ্য হয়তো তোমার পিছু ছাড়বে না। তোমার মায়ের ভারী ইচ্ছে, তুমিও তাঁর মতো নাচিয়ে হও। তোমার জন্মের বেশ আগেই একজোড়া তোমার জন্য ছোট্ট একজোড়া ঘুঙুরও কিনেছে তোমার মা। কোনও সন্দেহ নেই, তোমার নাচের প্রথম শিক্ষক হবে সে। কে জানে, হয়তো তুমি হাঁটতে শেখার সাথে সাথে নাচতেও শিখবে! আামিও সে দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।
তোমার বাবা
২রা জানুয়ারি, ২০১৬