প্রচ্ছদ / লেখালেখি / দিনপঞ্জি / কন্যাকে পিতা: ছয় | আহরার হোসেন

কন্যাকে পিতা: ছয় | আহরার হোসেন

তাজ্জব ব্যাপার! তুমি ঘুম থেকে জেগেই খিলখিল করে হাসো। সারা জীবন শুনেছি শিশুরা ঘুম থেকে জেগেই এক প্রস্থ কান্না-কাটি করে। এই প্রথম কোন শিশুকে দেখলাম যে ঘুম থেকে জেগে এক প্রস্থ হেসে নেয়। আমি আর তোমার মা তোমার ঘুম ভাঙার সময়টার জন্য উদ্বেল হয়ে থাকি। তোমার দন্তহীন মুখে মুক্তোর ঝলক দেখব বলে। তুমি কাঁদো বড় কম। তুমি যখন কু্ঁই কুঁই শব্দ কর তখন অনেকেই ভাবে তুমি খেলছ। কিন্তু আমি আর তোমার মা জানি, তোমার কষ্ট হচ্ছে। আর কখনো কখনো তুমি এই কাঁদো, এই হাসো। কি বিস্ময়কর!

candle

গত কয়েক মাস ধরে আমি সুযোগ পেলেই একখানি করে চিঠি লিখি তোমাকে। এটি তোমাকে লেখা আমার ছয় নম্বর চিঠি। ছয় সংখ্যাটিকে আজ ম্যাজিকের মত লাগছে। কারণ ঠিক ছয়মাস আগে আজকের দিনে তুমি পৃথিবীতে এসেছিলে। শুভ জন্মদিন মা। আর ছয় মাস পর তোমার এক বছর বয়স হবে। এই যুগে সন্তানের প্রথম জন্মবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখতে সবারই কমবেশি চেষ্টা থাকে। সেটা বিস্তর ব্যয়সাধ্যও বটে। তাই তোমার প্রথম জন্মবার্ষিকীতে যাতে একটু হাত খুলে খরচ করতে পারি সেজন্য এরই মধ্যে আমি অর্থ সংস্থান নিয়ে ভাবছি। পরিকল্পনা বিস্তর। এ নিয়ে প্রতিনিয়তই আমার চেতন ও অবচেতন নানা সুখপরিকল্পনা আঁটছে। এক রাত্তিরে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার এই সুখস্বপ্নে বিরাট এক বালতি ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিল তোমার মা।

“বাবুর এক বছর বয়সে আমরা কোন বার্থডে পার্টি করব না”।
শীতল গলায় বলল তোমার মা। এদিকে ঝনঝন করে ভেঙে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো আমার সুখপরিকল্পনা। অবাক চোখে আমি তাকালাম তার দিকে। ভাঙা সুখপরিকল্পনার টুকরো আমার গায়ে বিঁধছে। তোমার মায়ের নজর আমার দিকে নেই। তুমি ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখে মুচকি মুচকি হাসছ। কখনো সেটা বিস্তৃত হচ্ছে আকর্ণ। তোমার মা বিগলিত হয়ে তোমার ঘুমসুধা উপভোগ করছে।
অত্যন্ত ব্যথাতুর চিত্তে কোনমতে কয়েকটি কথা বেরোয় আমার গলা দিয়ে।
“কি বললে তুমি?”
তোমার মায়ের থোড়াই কেয়ার। এবার হাসিমুখেই ফিরতি জবাব।
“বললামতো এবার বাবুর জন্মদিনের কোন পার্টি করবো না। শুধু এবার না, আগামী তিন চার বছর তার কোন বার্থডে পার্টি হবে না”।
এটা শুনে আমার ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাকের মতো হলো। সময় যেন থেমে গেছে। শেষ পর্যন্ত বাবু নামটাতেই সবাই একমত হতে পেরেছে দেখা যাচ্ছে। কারণ, তোমার নানাবাড়িতে সবাই তোমাকে বাবু ডাকছে। তোমার দাদাবাড়িতে একই অবস্থা। তোমার মাও তোমাকে বাবু ডাকছে। আমিও ডাকছি। তুমি নিশ্চয়ই এরই মধ্যে জেনে গেছ, তোমার নানাবাড়িতে সবার নামই বাবু। তোমার দুমা, মানে তোমার মায়ের বড় বোন হচ্ছেন বড় বাবু। তোমার মামারা বাবু। তোমার রাঙ্গা ভাই আর পাঙ্গা ভাইও বাবু। এরা তোমার খালাত ভাই, কিন্তু তোমরা আপন ভাইবোন জ্ঞানেই বেড়ে উঠছ। তোমার নানাবাড়ি শুধুমাত্র তোমার মা-ই একমাত্র বাবু নয়। এটাও এক বিস্ময়! এবার বহু কষ্টে তোমার মাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম:
“কেন? কেন বার্থডে পার্টি হবে না? তাহলে কি ওইদিন আমরা ঘরে বসে আঙুল চুষব?”
তোমার মায়ের জবাব: “কে বলল আঙুল চুষব? বার্থডে পার্টি করবো না মানে তুমি যেমন পার্টির প্ল্যান করছ সেরকম কিছু করব না। কিন্তু আমরা ওইদিন কেকও কাটবো। পার্টিও করবো। কিন্তু বাবু পার্টি করবে তার সেইসব ভাইবোনদের সাথে যাদের বাবা মা নেই। ও যতদিন না বড় হবে, যতদিন না ওর নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ তৈরি হবে ততদিন পর্যন্ত ও ওর জন্মদিন কাটাবে এতিমখানায়”।

তোমার মায়ের মনটা বড্ড নরম। একই সাথে নরম, আবার খুব শক্ত। আমি প্রায়ই দেখি ফেসবুকে, টিভিতে, পত্রিকায় কোনও সন্তান হারা মা বা পিতৃমাতৃহীন সন্তানের করুণ কাহিনী পড়ে সবার অলক্ষ্যে চোখ মুছছে সে। সদ্য মা হয়েছে বলে নয়, বহু বছর ধরেই তাকে এমনটি করতে দেখছি আমি। কখনো কখনো তাকে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কোন বৃদ্ধ ভিখারির সাথে নরম গলায় কথা বলতে দেখি। বিদায় নেবার সময় সবার অলক্ষ্যে তার হাতে গুজে দেয় একশো টাকার নোট। কারখানার শ্রমিক আলামীন সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ার পর তোমার মাকে দেখেছি সারারাত তার হাত ধরে পঙ্গু হাসপাতালে বসে থাকতে। প্রায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে আলামীনকে ফিরিয়ে আনতে পেছনে অজস্র অর্থ ব্যয় করেই সে ক্ষান্ত হয়নি, তার জন্য নিজের শরীরের রক্তও ঢেলে দিয়েছে। আজও তোমার মা গভীর রাতে ডুকরে কেঁদে ওঠে সেই বৃদ্ধ ‘নানী’র জন্য, সংসারের অশান্তি সইতে না পেরে যিনি গলায় দড়ি দিয়েছিলেন। একদিন তাকে দেখলাম হরতালের ঢাকায় টানা ডিউটি দিয়ে ক্লান্ত পুলিশ সদস্যদের বিরিয়ানি কিনে খাওয়াতে। তোমার মায়ের মানবিক আচরণের এরকম আরো অগুনতি ঘটনার সাক্ষী আমি।

মা, মনে রাখবে মানুষ কখনো ভাল ব্যবহার ভোলে না। মাত্র একবেলা বিরিয়ানি খাওয়া সেই পুলিশ ভাইয়েরা আজও তোমার মায়ের কুশল জানতে আসে। মাত্র একবার মিষ্টি ব্যবহার আর চা-বিস্কুট খেতে পাওয়া হিজড়া শারমীন আজও তোমার মাকে দেখে তার চিরপরিচিত বৃহন্নলাসুলভ আচরণ ভুলে যায়। তোমার মাকে আজও নিরাপদ আশ্রয় মনে করে আলামীন। সুদূর বরিশাল থেকে কলাটা-মুলোটা নিয়ে ছমাসে-নমাসে হঠাৎ হঠাৎ হাজির হয় লিমার ভাই। অথচ লিমার জন্য কিছুই করতে পারেনি তোমার মা। শুধু তার লাশটা বরিশালে পাঠানোর জোগাড়যন্ত্র করে দিয়েছিল। পেটে ব্যথা নিয়ে একা একাই হাসপাতালে গিয়েছিল লিমা। তারপর বেঁচে ছিল মোটে এক রাত।

সেই কবে এক শীতকালে ইয়াছিন এসে তোমার মাকে বলেছিল, “আপা, রাতে বড় ঠাণ্ডা লাগে, একটা মোটে পাঞ্জাবী, এটা পড়ে শীত মানে না। তলায় পড়ার জন্য একটা গেঞ্জি দেবেন?” সেই ইয়াছিনের জন্য আজো তোমার মা হাহাকার করে। আট বছরের ছোট্ট ইয়াছিন। তোমার রাঙ্গা ভাইয়ের বয়েসী। তার দেখ ঘরভর্তি খেলনা। আলমারি ভর্তি জামাকাপড়। তোমারও তাই। কিন্তু ইয়াছিনের একটা মোটে পাতলা ফিনফিনে পাঞ্জাবী। আট বছরের ছোট ইয়াছিন। তার খেলনা চাইনা, ক্রিকেট ব্যাট চাইনা, ফুটবল জার্সি চাইনা, চাই শুধু একটা গেঞ্জি। পাঞ্জাবীর নিচে পড়ার মতো একটা গেঞ্জি, যেটা পড়লে তার শীত দূর হবে। এই বয়সেই পিতামাতা হারিয়ে জীবনের সব বাস্তবতা দেখে ফেলেছে সে। এতিমখানায় আরো অনেক ইয়াছিনের সাথে তার বসবাস। সেই থেকে তোমার মা বছরে অন্তত দুবার ইয়াছিনদের সবার জন্য জামাকাপড় পাঠায়। কিন্তু এই জামাকাপড়ে কি ইয়াছিনদের দুর্দশা ঘুচবে? তারা মূলধারার বাইরে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে। এতিমখানায় তারা এমন এক শিক্ষালাভ করছে যা দিয়ে সমাজের মূলস্রোতে আর দশজনের সাথে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকতে তারা পারবে না। কিন্তু তারপরও এতিমখানার প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা। হাজার হাজার ইয়াছিনদের দায়িত্ব তারা নিয়েছে। যে ইয়াছিনরা তাদের এই জীবনটাকে বেছে নেয়নি। যাদের এমন এক দেশে জন্ম হয়েছে, যেখানে পিতৃমাতৃহীন সন্তানদের দায়িত্ব নেয়ার কোনও সুব্যবস্থা রাখেনি রাষ্ট্র।

তুমি ভাগ্যবান। তুমি আমাদের ঘরে জন্মেছ। তোমার সুখ, তোমার নিরাপত্তা, তোমার সুন্দর আগামী নিশ্চিত করতে আমি আর তোমার মা সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে তৈরি। কিন্তু ইয়াছিনের জন্য এমন কেউ নেই। তার যদি সুযোগ থাকতো, সে নিশ্চয়ই এমন জন্ম বেছে নিত না। ওর কথা যেন তুমি ভুলে যেওনা।

আহরার হোসেনের ব্লগ থেকে…

About আহরার হোসেন

আহরার হোসেন, সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা।