মা, আমার জীবনের একটি গল্প বলি তোমাকে। একবার আমার মাথায় ভূত চাপল, সিনেমা বানাব।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ক্লাসে মনোযোগ কম। নানা অকাজ কুকাজ করেই দিন পার করি। বিকেল আর সন্ধ্যেটা কাটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটিতে। অর্থাৎ টিএসসির একটি রুমে বসে আমরা হাতি-ঘোড়া মারি। বড় বড় ফিল্ম মেকারদের নাম আওড়াই আর মাঝে মাঝে দুএকটা সিনেমা দেখি। এরই মধ্যে আমরা চিন্তা করলাম একটা সিনেমা বানাবো। কিন্তু সিনেমা বানাতে তো টাকা লাগে। ২০০২ কি ২০০৩ সাল হবে তখন।
ভার্সিটিতে পড়ি, হলে থাকি, ক্যান্টিনে ১২ টাকায় ভাত-ডাল-তরকারি খাই, লোকাল বাসে চড়ে এখানে ওখানে যাই, ঈদে-পার্বণে রিকশায় চড়ি। সিনেমা বানানোর টাকা কোথায় পাব? টাকা পয়সার চিন্তা করতে করতেই আমরা সোসাইটির মেম্বাররা মিটিং-টিটিং করে একটা স্ক্রিপ্ট ঠিক করে ফেললাম। বাজেট ধরা হল পঁচিশ হাজার টাকা। যারা যারা টাকা দেবে তারাই সিনেমার ডিরেক্টর। শেষ পর্যন্ত বারো জনে মিলে জোগাড় হল ২৫ হাজার টাকা। ১২ জন ডিরেক্টর!
ওই সিনেমাটা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল। ৫ মিনিটের নির্বাক চলচ্চিত্র। নাম দেয়া হল আবর্ত। সিনেমাটা ওই বছরের ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখানো হয়। বেশ প্রশংসাও পাই আমরা। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নিয়ম সিনেমা শুরুর আগে ডায়াসে উঠে ডিরেক্টর ফিল্ম সম্পর্কে কিছু বলবেন। তো আমরা যখন বারো জন ডিরেক্টর একসাথে মঞ্চে উঠি, তখন দর্শকদের মধ্যে বেশ একটা হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল। আমাদের ওই সিনেমার মূল ক্যারেক্টার ছিল একটা মেরি-গো-রাউন্ড। প্লাস্টিকের একটা চরকা, চাবি ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলে ভোঁ ভোঁ করে ঘোরে, আর ক্যারক্যার করে শব্দ হয়, এই হল মেরি-গো-রাউন্ড। ছবির টাইটেলে ওই ভোঁ ভোঁ চরকা ঘোরার শট ছিল। আর টাইটেল মিউজিক ছিল সেই ক্যারক্যার শব্দ। এরপর অবশ্য সিনেমা-টিনেমা বানাইনি আর, তবে ওই সিনেমার চাইতেও অনেক বড় বড় ভিডিও প্রোডাকশন বানিয়েছি শত শত। কিন্তু প্রথম ওই সিনেমার মতো আনন্দ আর পাইনি কিছুতে।
মা, তোমার জন্য সেদিন প্রথম খেলনা কিনলাম আমি। কি মনে করে তের-চৌদ্দ বছর আগে বানানো আমার (আমাদের) সেই সিনেমার মূল ক্যারেক্টার মেরি-গো-রাউন্ডটিই কিনে আনলাম। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণও আছে। আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি ঘূর্ণায়মান কোনও কিছুর দিকে অপলক চেয়ে থাকো। তোমার জন্মের সময়টাতে ছিল গরমকাল। সে সময় তুমি ছাদে ঝুলানো ফ্যানের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে। তোমার মা বলে, এই স্বভাবটা একেবারেই আমার কাছ থেকে পেয়েছ তুমি।
জানো, আমিও কোনও কিছু ঘুরতে দেখলে আটকে যাই। ছেলেবেলায় আমার প্রিয় দৃশ্য ছিল কুমোর বাড়িতে হাড়ি-পাতিল বানানো দেখা। বনবন করে ঘুরতে থাকা একটা বিরাট চাকার উপর রাখা একতাল কাদা কিভাবে কুমোর-বউয়ের আঙুলের ছোঁয়ায় হয়ে উঠত দারুণ একটি কলসি কিংবা পিগি ব্যাংক! দেখে আমি একেবারে জমে যেতাম। এমন একটা দৃশ্যের সামনে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারতাম। তোমার মায়ের বক্তব্য, আমি সেটা এখনো পারি, এবং করিও।
আমার আরেকটি প্রিয় জিনিস ছিল কামারের হাপর। কামারের হাপর হল বেলুনের মতো একটি চামড়ার ব্যাগ যেটার এক প্রান্তে সুতো বেঁধে টানতে হয় আর ছাড়তে হয়, এভাবে বারবার টানা-ছাড়া টানা-ছাড়া করা হলে অপর প্রান্ত থেকে প্রচণ্ড বেগে বাতাস বেরিয়ে আসে, সেই বাতাসে সামনে থাকা কয়লার চুল্লী গনগনে হয়ে ওঠে। সেই চুল্লীতে লোহা তপ্ত করে সেটাকে পিটিয়ে দা-বটি-কুড়ুল বিভিন্ন জিনিস বানানো হয়। এই হাপর টানা আর লোহা পেটানো দারুণ একটা ছন্দময় ব্যাপার।
আমাদের গ্রামের বাজারের একমাত্র কামার-ঘর চালাত দুই ভাই। আমি স্কুল থেকে আসা-যাওয়ার ঠিক পথে পড়তো না কামার বাড়িটি। কিন্তু আমি হাপর টানা দেখতে প্রায় প্রতিদিনই বেশ খানিকটা পথ ঘুরে কামার বাড়ি হয়ে বাড়ি ফিরতাম। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে দেখতাম, বড় ভাইয়ের পায়ের আঙুলে বাঁধা দড়ি, হাপর টানার জন্য সে তালে তালে পা নাচাচ্ছে। এক হাতে ধরা ছোট্ট বেলচা দিয়ে কয়লা খোঁচাচ্ছে আরেক হাতে চিমটের মাথায় গণগণে লোহা নেহাইয়ের ওপর উল্টেপাল্টে ধরছে। অনেকটা ব্যান্ডের ড্রামারের মতো। আর উল্টো পাশে দাঁড়ানো তার ছোটভাই বিরাট এক হাতুড়ি নিয়ে দুম দুম করে সেই গনগনে লোহাটাকে ক্রমাগত পিটিয়ে যাচ্ছে।
কি আশ্চর্য, কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই লাল টকটকে লোহার টুকরোটি একটি কাস্তের আকার পেত! কোনও কোনটি হয়ে যেত লাঙলের ফলা। আমি অবাক হয়ে দেখতাম। কিভাবে সম্ভব! দু ভাই সারাদিনই খালি গায়ে কাজ করে। তাদের গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। চুল গ্রিক দেবতাদের মত কোঁকড়ানো। আর প্রতিবার হাতুড়ি চালানোর সাথে সাথে ছোট ভাইয়ের গায়ের পেশিতে অকল্পনীয় এক নাচন ওঠে। পুরো ব্যাপারটাকে আমার মনে হতে কবিতার মতো। কি দারুণ সব অন্ত্যমিল। কোনও কোনদিন কামার-খুড়ো আমাকে তাড়া লাগাত, অনেক জ্যাঠামি হয়েছে, এবার বাড়ী যাও। মা বকবে।
কামার খুড়ো একবার একটা লোহার রিং বানিয়ে দিয়েছিল আমাকে। আরেকটা লোহার আঁকশি। এর জন্য আমার কাছে তারা কোন পয়সা নেয়নি। ওই আঁকশি দিয়ে রাস্তা ধরে রিং চালানো ছিল দারুণ এক কসরতের ব্যাপার। আমার অবশ্য রপ্ত করতে সময় লাগেনি বিশেষ। তখন আমার বছর আষ্টেক বয়স হবে। বহু বছর বাদে গত বছর গ্রামের সেই কামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। দুই ভাইয়ের এখন আলাদা ব্যবসা। আলাদা আলাদা কামারঘর। এখনো তারা হাপর টানে। কথা হল। বলল, কাজ নেই তেমন। মানুষজন এখন আর ক্ষেতখামার করে না। তাই অস্ত্রপাতিও দা-কাস্তেরও চল নেই বিশেষ।
মা, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই কামারের হাপর চালানোর ব্যাপারটা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। তুমি যখন বড় হবে তখন এই কামারের হাপর বা কুমোরের চাকা বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই হয়তো থাকবে না পৃথিবীতে। তুমি বড় হয়ে আর আঁকশি দিয়ে রিং চালাতেও দেখবে না গাঁয়ের ছেলেদের। আমি এখনই দেখি না। আমাদের গ্রামের সেই কুমোর বাড়ি এখন নেই বললেই চলে। দু-তিনজন মহাজন কোনও মতে টিকে আছে। তাদের বাড়িতে চাকা ঘোরে না। একরকম মেশিন নিয়ে এসেছে কোথা থেকে যেন। সেই মেশিনে মাটির তাল ঢুকিয়ে চাপ দিলে টালি বেরিয়ে আসে। ধনী লোকেরা শখ করে এই টালি দিয়ে ঘরের ছাদ বানায়।
তুমি হয়তো মা গ্রামই দেখবে না আর। তোমার দাদু বাড়ির সামনের রাস্তায় এখন ট্রাক চলে। ঘরে টিভি ফ্রিজ সবই আছে। ইন্টারনেট-ডিশের লাইনও আছে পাড়ায়। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যেবেলায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে সুর করে ধারাপাত পড়তাম আমরা।
তুমি মনে হয় ধারাপাতও দেখবে না। কিংবা বর্ণপরিচয়। আর আদর্শলিপি।
আমি চেষ্টা করব তোমার জন্য বই তিনটি জোগাড় করবার। কি জানি পাওয়া গেলেও হয়তো প্লাস্টিকের বই পাওয়া যাবে। দুই টাকা দামের সেই লালচে নিউজপ্রিন্টে ছাপা বই কি এখন আর পাব? নরম নিউজপ্রিন্ট। একটা বই দু’দিনও যেত না। প্রতি হাটে নতুন একখান করে এনে দিতে হত আমাকে। কুপি জ্বালিয়ে সেই বর্ণপরিচয় সুর করে পড়তাম “অ-তে- অজগর আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে”। পাশের সুপারি বাগান থেকে ভেসে আসতো ঝিঁঝির ডাক। পুকুরের উপর থেকে এদিক-ওদিক করত জোনাকির চাদর। এশার আজান দিতে না দিতে আমাদের চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু করতো। বর্ষাকালে এঁটেল মাটির রাস্তায় কোমর সমান কাঁদা পেরিয়ে স্কুলে যেতে হতো। সেইসব ঘটনা আরও চমকপ্রদ। আরেকদিনের জন্য তুলে রাখলাম।
ইতি
তোমার বাবা
পুনশ্চ ১: তুমি ঝিঁঝি পোকা আর জোনাকি পোকাও সম্ভবত আর দেখবে না। গ্রামে গিয়ে শেষবার আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তুমি বড় হতে হতে এই পৃথিবী থেকে কি কি হারিয়ে যাবে তার একটা তালিকা আমাকে করতে হবে। যাতে এগুলো সম্পর্কে তোমার জন্য বিশদ লিখে রেখে যেতে পারি।
পুনশ্চ ২:ও হ্যাঁ, তুমি এখন বাইরের খাবার খাচ্ছ। সেদিন তোমাকে প্রথম মিছরি দিয়ে সুজি রান্না করে খাওয়ালাম। তুমি দারুণ খেলে। এই একটা ব্যাপার এখনো বদলায়নি। যদিও নানারকম কৌটোর খাবার আছে বাজারে। কিন্তু আমি আর তোমার মা চেয়েছি, আমরা যেটা খেয়ে আমাদের জীবন শুরু করেছিলাম, সেটা খাইয়েই তোমার জীবনটাও শুরু করি। এই ইচ্ছেটা পূরণ হওয়ায় খুব ভাল লাগল।
আহরার হোসেনের ব্লগ থেকে…