গোপাল মাষ্টার। এক সময় স্বপ্ন ছিল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। কোনটাই হতে পারল না। মধ্যবিত্ত বাপের ছেলে, কোচিং করাতে পারেনি। তাই জায়গা হয়নি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজে পাসকোর্সে ভর্তি হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে অনার্স করে বেকার।
বাবার ১০ কাঠা জমির টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরী হল পাশের স্কুলে সমাজ বিজ্ঞান শিক্ষকের। চোখে স্বপ্ন ছাত্রদের সততা, নীতিবোধ শিখাবে। চাকরীর প্রথম দিন প্রধান শিক্ষক বললেন এমপিও করাতে হবে খরচ খরচা আছে। ব্যবস্থা করতে হবে। আর কত বাবাকে বলা যায়। বাড়ির পাশে মন্নান, যে একসময় প্রাইমারী স্কুলে পড়েছিল তার সাথে। তারপর চিংড়ী মাছের ব্যবসা আরও কত কি? শোনা যায় অনেক অনেক কাজের সাথে জড়িত। টাকায় তো আর গন্ধ নেই চড়া সুদে নিতে হল তার কাছ থেকে।
দিন যায়, রাত যায় ঐদিকে মায়ের বায়না চাকরী তো হল এবার বউমা আনলে হয়। পাশের বাড়ির দাদা মেয়ে দেখতে যাবে তাকে যাতায়াত খরচ দিতে হবে আর মেয়ে দেখে তার সম্মান রক্ষা। তাই স্কুলের অংকের স্যারের দ্বারস্থ হল সে অনেক প্রাইভেট পড়ায়। অনেক উপদেশ দিয়ে তার সাথে মিলল কাঙ্খিত টাকা।
সোমবার হাঠবার বাবার শরীর খারাপ। শরীরের থেকে মন খারাপ সংসার তো আর চলে না। বোন না থাকলেও নিয়মিত ব্যায় আসবে কোথা থেকে? বাবা বললেন গোপাল আজ একটু বাজার করে এসো। টাকা নেই কাচা বাজার বাকি আনা যাবে চন্দনের কাছ থেকে। কিন্তু মুদি সেই মাখনের কাছে বসে তার গল্প শুনতে হবে। যে মাখন তার এক বছর নীচেয় পড়ত। পারিবারীক ব্যবসার এখন সেই মালিক। বাকি দেবে ঠিকই। কিন্তু গোপালের গল্প শুনতে বড়ই আপত্তি।
মাখন দোকানে গেলেই বসতে দেবে চাও খাওয়াবে। তারপর শুরু করবে স্কুলের সেই ইতিহাস। যে ইতিহাস মাখনের নিজেরই বানান। সে নাকি একবার ইংরেজিতে লেটার পেয়েছিল। সাক্ষী গোপাল সামনে আরও কয়েকজন। গোপালের সাক্ষী বিশ্বাস না করে গাছী রহিম, তেলি হাশেম-এর উপায় কি? মাষ্টেরও জানে মাখন কত ভাল ছাত্র।
দিনে দিনে মন্নানের লোন বাড়তে থাকে এমপিও আসে না। এর মধ্যে স্কুলের পন্ডিত স্যার বলে গোপাল জাগরনি চক্র মাসিক সুদ দেয় ওখান থেকে লোন নিয়ে শোধ কর। গোপাল পন্ডিত স্যারকে জিম্মা রেখে লোন নিয়ে মন্নানকে দেয়। এরই মধ্যে বেজে ওঠে বিয়ের বাশি। মেয়ে খুবই লক্ষ্মিমন্ত। মেয়ের বাবা বউ’ভাতের খরচও দেবে। অতএব বিয়ে করতে আর দোষ কি? গোপাল বিয়ে করে আসল। বউয়ের ভাগ্যে এমপিও আসল।
এখন গোপালের সুখের সংসার। মাস গেলে ৮২৪০ টাকা বেতন পায়। মাসিক কিস্তি ৩০০০ টাকা। মাস শেষে গোপাল আবার মাখনের দোকানে। কিছুদিন যেতেই গোপালের ঘর আলো করে আসল এক মেয়ে। মেয়ের জন্য দুধ কেনা, মাঝে মাঝে আবার ডাক্তার খরচ বাড়তে লাগল। গোপাল এখন কোচিং সেন্টারের ম্যানেজার কাম শিক্ষক। অতিরিক্ত টাকা দরকার।
একে একে আট বছর হয়ে গেল, গোপাল এখন সিনিয়র শিক্ষক, বেতন বেড়েছে। সাথে সাথে বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। গোপাল এখন ১২০০০ টাকা বেতন পায়। খরচ প্রত্যেক দিন বাড়ছে বিদ্যুৎ বিল এখন আবার বিশুদ্ধ পানি কিনতে হয়। মায়ের প্রত্যেক দিন দুইটা গ্যাসের ঔষধ আর প্রেসারের ঔষধ। নিজের আবার সকালে না খেতে খেতে এখন গ্যাসের ঔষধ খেতেই হয়।
ডাক্তার বলেছে গোপালের আবার ডায়াবেটিসের ভাব আছে। কিছু দিন ধরে মাঝায় ব্যাথা। ডাক্তার বলেছে হাড় খয়ে যাচ্ছে। আসলে যে গোপাল নিজেই ক্ষয়ে যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারে। বি.এড. টা করতে পারলে আরও কিছু বেতন বাড়ত। এখন আর সময় নেই। মেয়ের কলেজ সাথে সাথে মেয়ের জন্য পাত্র দেখা। বউয়ের পরামর্শে সেদিন চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিল গরিব ভাতা পাওয়া যায় কিনা ভাতার কার্ড তো দুরে থাকুক ১লা বৈশাখ নিয়ে তর্কে চেয়ারম্যান গল্লা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে।
চেয়ারম্যান বলে কিনা বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তির থেকেই পহেলা বৈশাখ। গোপাল যতই বলে মোঘল সম্রাট আকবের সময় থেকে এই পহেলা বৈশাখ কোন মতেই মানবে। বাঙ্গালীর ঐতিহ্য পান্তা ভাত ইলিশ নিয়ে কথা বলে গোপাল। রাজাকারকে বের করে দেওয়া হোক। গোপাল এখন অস্পৃশ্য শিক্ষক। সব শিক্ষকরাও বাকা চোখে দেখে।
প্রধান শিক্ষক ডেকে বললেন, গোপাল তুমি ঠিক করনি চেয়ারম্যান সাহেবের মুখে তর্ক করে। ক্ষমা চেয়ে নাও। মেয়ে বাড়ি গেলে বলে বাপি তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। মেয়ের মা কয়েকদিন তো কথাই নেই। পিছনে পিছনে বলছে উনি গেছেন জ্ঞান ফলাতে।
গোপাল কিছুই হবে না। গোপাল রৌদ্দুর না হতে পারে দালাল তো হতে পারে। কয়েকদিনের মধ্যে গোপাল চেয়ারম্যানের ডান হাত। এখন গোপাল হচ্ছে উপদেষ্টা সংসার ভালই চলছে। বেতনে হাত দিতে হয় না। স্কুলেই যাওয়ার সময় পায় না। বেতন ব্যাংকে জমা হয়ে যায়। গোপাল এখন দেশ উদ্ধারে ব্যাস্ত। সে সারাক্ষণ চেয়ারম্যানের গাড়িতে। যেখানে চেয়ারম্যান সেখানেই গোপাল। থানার ওসি সেদিন বলল গোপাল স্যার একটু সবধানে থাকবেন। দুদকে আপনার নামে রিপোর্ট আছে।
গোপালের মেয়ে উকিলের কাছে কিভাবে বাবাকে জামিন দেওয়াবে। চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে গিয়েছিল দেখাই করেনি। চাকরিটাও মনে হয় থাকবে না।