লাবনী বয়স ১৫। সার্টিফিকেটের বয়স ১৫ হলেও বাবা মার কথা আরও বেশী হবে। ঐ পোড়ামুখে স্যারেরা লাবনীকে দেখতে পারত না তাই তার বয়স কমিয়ে দিয়েছে। পাত্রর আব্বা বলে উঠেন বয়সটা আরও একটু কম হলে ভাল হত। কেননা তার ছেলের বয়স এই ৩৫ পেরিয়ে ৩৬ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাত্র পক্ষ পছন্দ করে পাত্রর ফোনে বিকাশ করে মটর সাইকেলের টাকা পাঠানর শর্তে।
পাত্রর মামার কথা আমরা যৌতুক প্রথার বিরোধী শুধু মাত্র সোবাহানের একটা মটর সাইকেলের শখ। লাবনীর বাবা হাঁসি মুখে বলে বাবাজির শখ পূরণ না করলে কি হয়?
লাবনী জানে থাকার মধ্যে আছে বিলের ২ বিঘা জমি। যা দিয়ে বছরের ৩ মাসের খাবার হয়। বাবা কোথা দিয়ে কি করে সব কিছুর জোগাড় করে লাবনীকে জামাই বাড়ি পাঠানর ব্যবস্থা করেন। লাবনীর মা হাসি মুখে সবাইকে আসতে বললেও বিয়ের পরের দিন কি খাবেন তাই নিয়ে চিন্তা করেন। পাত্র যেদিন দেখতে এসেছিল তার সাথে ছিল কয়েক জন বন্ধু তারা নাকি গিয়ে বলেছে মেয়ে বড়ই কাবু।
পাত্রর পিসিমা ফোন দিয়ে বলেন “মা বিয়ের তো আরও মাস খানেক দেরী আছে তোমার বাবাকে বলে কিছু ভিটামিন টিটামিন খাও। মেয়ের গায়ে যদি মাংস না থাকে মানুষ কি বলে বোঝ না? লম্বায় তো অনেক বেড়েছ সাথে অন্য গুলোও বাড়াতে হবে।” লাবনী বুঝতে পারে পাত্র্রর পিসিমার কথা। যদি পারত মুখের উপর বলেই দিত এমন বিয়ে করব না। কিন্তু বাবার দিকে তাকিয়ে বলতে পারে না।
বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে মা তার কাছে শোয়। রাতে মার গলা জড়িয়ে পাত্রর পিসিমার কথা গুলি মাকে বলে। মা বলেন তোর বাবাকে জানানর দরকার নেই। কাল ওপাড়ার কৃষ্ণ কাকার কাছে গেলে হবে। সকালে ছোট ভাইকে স্কুলে পাঠিয়ে লাবনী তার মায়ের সাথে কৃষ্ণ কাকার বাড়ি যায়। কৃষ্ণ কাকা গ্রাম্য ডাক্তার। খুবই নাম ডাক। বেশ কয়েকজন রোগীর পর লাবনীর ডাক পরে।
লাবনীর মা ডাক্তারকে সব বলায় কৃষ্ণ কাকা হেসেই শেষ। বলে এ কোন ব্যাপার নাকি। সে নাকি যে মায়ের দুধের অভাবে বাচ্চা কাঁধে তাকে এক ঔষুধেই ঠিক করে দেয়। তার ঔষুধ খাওয়ার পর নাকি এত দুধ হয় সন্তান আর খেয়েই পারে না। কৃষ্ণ কাকা কয়েকটি ঔষুধ দিয়ে বলেন মা এগুলো ঠিকমত খাও জামাই বিয়ের দিন দেখে আর চিন্তেই পারবে না।
কৃষ্ণ কাকার হাতে একশ টাকা গুজে দিয়ে বাইরে থেকে ঔষধ নিয়ে ফেরে মা মেয়ে। ঔষধ খেয়ে আসলেই শরীরের পরিবর্তন আসে, খিদেও তৈরী হয়, শরীরে গোস্তও কিছুটা লাগে। বিয়ের দিনে সরঞ্জাম দেখতে দেখতে পিসি বলে সোবাহানের বন্ধু গুলো গাধা এই মেয়েকে বলে কিনা ঢ্যাঙা। বিয়ের আসরে পাত্রর এক দূর সম্পর্কের চাচা সালাত ঠিক মত না পেয়ে রাগ করে উঠে যায়। এছাড়া সবই ঠিক মত হয়।
ছেলের এক বন্ধু মেয়ে পক্ষের হয়ে কথা না বলেই বিয়ে হয়ত বন্ধই হয়ে যেত। ঐ টেবিলে বসা ছেলের এক বন্ধু বলে চাচা তো সবই খেয়েছে আবার রাগ কিসের?
বাড়ির সবাইকে কাঁদিয়ে লাবনী জামাই বাড়িতে যায়। লাবনীর বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলে যাক একটা ভাল পাত্রর হাতে দিতে পারলাম। প্রতিবেশীরা বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে একসময় তারাও বিদায় নেয়। সকাল হতে হতে না হলে বেয়াই সাহেবের ফোন “আপনারা এখনই আমার বাড়িতে আসেন কি এক মেয়ে দিয়েছেন?” লাবনীর বাবা বুঝতেই পারে না কি এমন হল একরাতেই। যে এরকম ফোন। মেয়ের মাকে সত্যি না বলে লাবনীর বাবা তার ছোট ভাইকে নিয়ে রওনা হল বেয়াই বাড়িতে।
বেয়াই বাড়ির অবস্থা আসলেই খারাপ। তারা যেতেই সবাই যেন মারতে পারলে বাঁচে। লাবনীর বাবা কিছুই বুঝতে পারে না। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে জামাইয়ের ফুফার কথায় “কি মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন? বাচ্চা খালাশ করেছেন কোথা থেকে?”
লাবনীর বাবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বুঝতেই পারছে অন্দর মহলে তার মেয়ের কি অবস্থা। দুই একটা কথা চাচা বলতে গেলেও পাত্র পক্ষর শব্দে সেগুলো মুখেই থেকে যায়। ফুফা থামাথামির লোক না সে বলতেই থাকে “লাবনীর স্তনে নাকি দুধ পাওয়া গেছে” লাবনীর মাথায় পৃথবী ভেঙ্গে পড়ে এ কি করে সম্ভব। তার মেয়েকে সে যতদূর চেনে কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক তো দূরে থাক চোখ তুলেও তাকাত না। “আপনার মেয়ের চরিত্র ঠিক নাই। কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল তার সাথে নিয়ে বিয়ে দেন” আজকে, এখনই আমাদের এখান থেকে আপনাদের মেয়েকে নিয়ে আমাদের পাপ থেকে মুক্তি দেন। দুই একটা কথা বলার চেষ্টা করেও লাবনীর বাবা বুঝতে পারে কোন কাজ হবে না।
মেয়েকে নিয়ে দুই ভাই বাড়ি ফিরে আসে। মেয়ে বাড়িতে আসবে কত আনন্দ। পুকুরে কয়েকটা মাছ ছিল তা ধরতে হবে। মেয়ে জামাই প্রথমবার বাড়িতে আসবে মেয়ের মা কয়েকটা মুরগী রেখেছে, মেয়ে মুরগী পোলাও ভাল খায়। মেয়ের আবার ঝাল খাওয়ার বড়ই শখ। ছোট ভাই বাজার থেকে ফুচকা এনে দেবে এও বিয়ের আগে লাবনীর সাথে কথা হয়েছিল। লাবনী ফিরে এল। চারি দিকে কানা ঘুষা। লাবনীকে নাকি তাড়িয়ে দিয়েছে। লাবনী নাকি অসতি। বাচ্চা নষ্ট করে তার পর বিয়ে হয়েছে। প্রতিবেশীর সামছুর মা সাক্ষীও দিয়েছে এ কৃষ্ণ ডাক্তারের কাজ। বিয়ের কিছুদিন আগে মা মেয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ ডাক্তারের কাছে। মেয়ে নাকি খুব ভাল কারও দিকে তাকায় না। বাড়িতে সোমত্ত মেয়ে তার আবার লেয়া পড়া। মাষ্টের ঘরের মধ্যি নিয়ে ফষ্টি নষ্টি করে আর মা পাহাড়া দেয়। সবাই জানে কত ভাল মেয়ে।
সব কথা কানে না নিয়ে লাবনীর মা লাবনীকে নিয়ে যায় সদর হাসপাতালে। ডাক্তার আপা অনেকক্ষণ দেখে বলে এর আগের প্রেসক্রিপশন এনেছে। লাবনীর মা তার ব্যাগ থেকে বের করে সেই প্রেসক্রিপশন যে ঔষধ খেয়ে লাবনী সুস্থ হয়েছিল। ডাক্তার খানিক্ষণ তাকিয়ে বলে আপনাদের আর কি বলব আমাদের দেশটা এমন দূর্দশা। ঔষধ না জেনেই ডাক্তার লেখে প্রেসক্রিপশনে, হাত দিয়ে ডাক্তার আপা বলে এই যে ঔষধটা এটা আমরা সন্তান হওয়ার পর মায়েদের দিই। যাতে সন্তান তার খাবার পায়। এটা কোন অবিবাহিত মেয়ের জন্য নয়। এ সমস্যা শুধুমাত্র ঐ ঔষধ থেকেই হয়েছে।
লাবনীর মা হাসপাতাল থেকে বেড়িয়েই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেধে ফেলে আমিও না তোকে কত ভুল বুঝেছি। দরকার নেই তোর সংসারের। তোর বাপ যা আয় করে তা দিয়েই আমাদের চলবে। লাবনীকে নিয়ে তার মা ফুচকার দোকানে ঢোকে। নিজে কোন দিন দোকানে গিয়ে ফুচকা খায় নি। মেয়ের পালায় পড়ে বাড়িতে দু’একটি মুখে দিয়েছে। টেবিলে সামনে ফুচকা একটা মুখে দিয়েই লাবনী কেঁদে ফেলে, তারই সাথে সাথে তার মা। ফুচকা প্লেটেই ধরা পড়ে থাকে খানিক্ষণ কেঁদে শান্ত হয়ে বেড়িয়ে বাড়ির পথ ধরে। …
একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত।
স্বত্ব ও দায় লেখকের…