• নাজমুল আহসান
আমাদের প্রজন্ম হচ্ছে আপনাদের বাংলাদেশের গচ্ছিত স্থায়ী হিসেবের শেষ আমানত। এর পর যারা আসছে তারা শোনা কথা ছাড়া জানবে না বাংলাদেশের মাটি আমাদের কাছে কী অমূল্য ধনের তুল্য। যার সঙ্গে কোনো ঐশ্বর্যেরই বিনিময় হয় না।
আমাদের জন্য প্লেন সার্ভিসের দরকার নেই। ট্রেন সার্ভিসটা চালু করে দিন। সেই সঙ্গে নামকরণ করুণ ‘জন্মভূমি স্পেশাল’। ব্যস তারপর দেখুন। কী পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। ভাবতেও পারবেন না। “আজ থেকে অনেক দিন আগে পশ্চিম বঙ্গের সাংবাদিক, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সদ্য প্রয়াত শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এই কথাগুলো বলেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিকে। অনেক গুলো বছর কেটে গেছে কিন্তু অবস্থা এতটুকু নড়েনি, সেই একই তিমিরে। আজ ও পশ্চিম বঙ্গে মানুষ উৎসের টান খুজে ফেরে। সম্প্রতি এ রকম কিছু অভিজ্ঞতা দিয়েই লেখা শুরু করছি।
মা’ কে নিয়ে মেলা ঘুরতে ঘুরতে ঐন্দ্রিলা বাংলাদেশের স্টলে এসে আবেগে আপ্লুত হয়ে যান। এই সেই বাংলাদেশ! বাবার মুখে গল্প শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গ্যাছে তার আদ্যপান্ত। ছোট গ্রাম, সবুজ শ্যামলিয়া, নদী প্রকৃতি সে যেন দিব্যি দেখতে পায়। তার বাবা আজ নেই। আচ্ছা, বরিশালের গৌরনদীর ঐ গ্রামটি এখনো আছে তো? আমরা কি যেতে পারবো পূর্বপুরুষের ভিটায়? আপনারা কি ঐ গ্রাম আমাদের দেখাবেন? ঐ গ্রামে একটি রাত অন্তত আমি থাকতে চাই। ঐন্দ্রিয়া প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়। মা একটু আনমনা হয়ে যান। উদাস চোখে নষ্টালজিয়ায় ভেসে ওঠে সেই গ্রাম, মাঠ, প্রান্তর এক বাংলাদেশ। ৪৭-এ ছেড়ে যাওয়া সেই বাংলাদেশ। ছলছল চোখে ব্যাকুল ঐন্দ্রিলা পিতার অস্তিত্ব যেন অনুভব করেন সেখানে দাঁড়িয়ে।
অলোকেষ বাবু তার স্ত্রী এবং এক বন্ধুকে নিয়ে এবারের পূজোয় কোথায় বেড়াতে যাবেন তা ঠিক করতে পর্যটন মেলায় এসেছেন। প্রতিবছরই পূজোয় কোথাও না কোথাও পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ভারতবর্ষ দেখা প্রায় শেষ। এবার কোথায় যাবেন? নেপাল না দেশের ভেতর অন্য কোথাও। অনেকক্ষণ ধরে মেলায় হাটতে হাটতে কিছুটা ক্লান্ত তিনি। হাতের বা দিকের রো ঘুরে ভারতীয় রেলের স্টলে ডামি রেলগাড়ি দেখতে দেখতে সামনে এগোতেই চোখ আটকে যায় বড় বড় কয়েকটি অতিচেনা বাংলা হরফে। বাংলাদেশ, কোথায় যেন সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে কে নাড়া দেয়। শিহরণ জেগে ওঠে সমস্ত শরীরে। পিটপিট করে চোখ বন্ধ করেন কয়েকবার। হ্যাঁ, এই তো তার অতি চেনা সেই প্রিয় বাংলাদেশ। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যান তিনি। সিলেট যাইবাম। বাবা, ব্যবস্থা করিয়া দেন।
বাংলাদেশের মানচিত্র হাতড়ে তিনি খুঁজে ফেরেন নিজের গ্রাম। অনেক প্রশ্ন, কথকথা শেষে একটি ট্যুরের লিফলেট পরম যতেœ ভাঁজ করে রাখেন বুক পকেট। তাঁর স্ত্রী চেয়ারে বিশ্রাম নিতে নিতে স্মৃতি থেকে বলে যান হাজারো কথা, অতি দ্রুত লয়ে সিলেটি ঢংয়ে। মৃত্যুর আগে একবার যেতে চান নিজের ভিটায়, নিজের গ্রামে। পরিচিত করিয়ে দিতে চান এ প্রজন্মকে যারা বেড়ে উঠেছে, স্থায়ী নিবাস গড়েছে এ কলকাতায়। বাংলাদেশ-ভাবাবেগের এক অদৃশ্য নাড়ীর টান। অশোক মঘা নামে যিনি এখনও বাগেরহাট শহরে পরিচিত তার অগনিত বন্ধুদের কাছে। নানা কারনে যৌবনে ছাড়তে হয়েছিলো তার প্রিয় শহর বাগেরহাট। এক গহীন অন্ধকার রাতে একাকী যুবক বুকে পাথর বেঁধে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন আপন ভুবন থেকে। অত:পর দীর্ঘ নির্বাসন, অন্তপুরে এখনো ঝরে বেদনার অশ্র“। উৎসের টানে, শেকড়ের সন্ধানে হাজারো মানুষের ভীড়ে বাংলাদেশ নামক ভাবাবেগের স্টলে -মঘা দা খুঁজে ফেরেন দক্ষিণ বাংলা।
ষাটগম্বুজের ছবি, সুন্দরবনের বাংলা লিটারেচার। প্রিয় শহর এবং দড়াটানা নদীর গল্প কি মঘা দা শোনাতে চান তাঁর এদেশের প্রজন্মকে, তার সন্তানকে? বাংলাদেশের স্টলে এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষের ভিড়ে দীর্ঘ সময় ধরে তার প্রিয় শহরের এক যুবকের সাথে বলে চলেন তার সময়ের কথা, বন্ধুদের কথা। অতীতের আকুলতা ভিড় টেলে জায়গা করে নেয় বর্তমানে। সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ বিক্রমপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, বগুড়া, নোয়াখালী, বাগেরহাট, রাজশাহী, পাবনা যেন পুরো বাংলাদেশের লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কলকাতার অলিতে গলিতে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালিদের একটি বড় অংশের পূর্ব পুরুষের আবাস ছিলো বাংলাদেশ। যারা এখনো বেঁচে আছেন পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া সেই সব মানুষ যারা উৎসের টানে ভোগের এক অদ্ভুত নষ্টালজিয়ায়। আর এ প্রজন্ম, যারা পশ্চিমবঙ্গে জন্মেছেন কিন্তু আদি নিবাস পূর্ববঙ্গে তারাও এক অদৃশ্যটানে নিজের পূর্বপুরুষের ভিটা দেখতে চান জীবনে অন্তত একবার। মানুষের রক্তে উৎসের টান সম্ভবত কখনো শেষ হয় না।
বাংলাদেশের স্টলে দাঁড়িয়ে বারবার এই আবেগে ছুঁয়ে যাচ্ছিল হৃদয়মন। বাংলাদেশকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের এই আকুলতা, এই আবেগ, এই উচ্ছ্বাস, অন্তরের ভিতরের গভীর এই টান এই আগ্রহে বিস্মিত হচ্ছিলাম আমরা: অনুভূতিতে জাগছিলো নতুন এক অভিজ্ঞতা। সারাক্ষণ অনবরত, একের পর এক মানুষের সাথে আমরা কথা বলে চলেছি। নিজের দেশ নিয়ে বিদেশ ভুঁইয়ে অপরিচিত অগনিত মানুষের সাথে একই ভাষায় এক দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কথোপকথনে। সেই বহুদিন আগে ছেড়ে যাওয়া নদী-ঘাট প্রান্তর-গ্রাম-শহর তার স্মৃতিতে উঠে আসে। আজকের বাংলাদেশ তার কাছে একদম অপরিচিত। তাই এতো প্রশ্ন, দেখার এই আকুলতা।
অনেক দিন আগের কথা ২০০১ সাল। ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা বড় ট্রাভেল এবং ট্যুরিজম ফেয়ার টিটিএফ-এর আয়োজন হয়েছিলো নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। তিনদিনের জমকালো বর্নাঢ্য এই পর্যটন পণ্যের মেলায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট, ট্যুর অপারেটর, হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট এয়ার লাইন্স এবং যোগ দিয়েছিল কয়েকটি পাশ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই এবং সাউথ আফ্রিকার অংশগ্রহণ মেলাকে দিয়েছে আর্ন্তজাতিক রূপ।
পর্যটন মেলায় এত লোকের ভিড় যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। রবিবারের ছুটির দিনে যেন কলকাতার সব ভ্রমণ পিয়াসীরা একসাথে উপছে পড়েছে ইনডোর স্টেডিয়ামে। ভ্রমণকে জনপ্রিয় এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া, মানুষকে ভ্রমণের প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ট্রাভেল এবং ট্যুরিজম ফেয়ার আয়োজন করা হয় প্রতিবছর। সমগ্র ভারতের পর্যটন পণ্য নিয়ে ১৫০টির বেশী স্টলের উপস্থিতি, পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের অংশগ্রহণ, শতসহস্র মানুষের সমাবেশ, ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মনে তথা পর্যটন শিল্পে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এই মেলা।
মেলায় অধিকাংশ স্টলের সাজসজ্জা, আলোক প্রক্ষেপণ, পণ্যে উপস্থাপনা ছিলো চাকচিক্যময় মনোরম এবং আকর্ষনীয়। আর ভারতবর্ষের বাইরের দেশের উপস্থিতি ও উপস্থাপনা ছিলো আরো বেশী আকর্ষনীয় যা সবার নজর কেড়েছে। কিন্তু মেলায় এক কোনে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ম্যাড়মেড়ে নি¯প্রভ উপস্থিতি সত্যেও ভিড় লেগে ছিলো সারাক্ষণই। একদা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া প্রবীণ কিংবা এ প্রজন্মের নবীন অনেক মানুষের সম্প্রতিভ চোখ খুঁজে বেড়িয়েছে তাদের ফেলে যাওয়া স্মৃতির বাংলাদেশকে। অপ্রতুল প্রকাশনা, পোষ্টার নিয়ে পর্যটন কর্পোরেশনকে বারবার বিড়ম্বনায় পড়ে হিমসিম খেতে হয়েছে দর্শকদের কাছে।
পর্যটন কর্পোরেশন তার স্টলের দু’প্রান্তে স্থান দিয়েছিলো বাংলাদেশের বেসরকারি ট্যুর এবং ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে। তাদের প্রতিনিধিত্ব করছিলো ট্যুর অপারেটর এসাসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এবং ট্যুরিজম ডেভেলপার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিডাব)। এ দুটি সংগঠের ব্যানারে মেলায় অংশ নিয়েছিল ট্রাভেল নেট ইন্টারন্যাশনাল, জার্নি প্লাস, গ্রীন ট্যুরিজম লিমিটেড, কুশিয়ারা টুরিজম, রিভার এন্ড গ্রিন ট্যুরস, ইম্পেরিয়াল হোটেল, প্রাইম ট্যুরিজম নেটওয়ার্ক এবং সিলেট ফাতেমা ট্যুরিজম। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মান কিছুটা হলেও বাঁচিয়েছে এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। বাংলাদেশে ভ্রমণ সম্পর্কে কৌতুহলী বরং আগ্রহী দর্শকের অজস্র প্রশ্ন, বাংলাদেশ সম্পর্কে লিফলেট, প্রকাশনা নিয়ে সদা হাসোজ্জ্বল মুখে বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সর্বদাই এইসব দর্শক, পরিদর্শনকারীদের সামলেছেন দক্ষতার সাথে। এবারের মেলায় একটি বিষয় ছিলো লক্ষনীয় তাহলো কলকাতার অনেক ট্যুর অপারেটর বাংলাদেশকে দেখতে চায়, ভ্রমণে আসতে চায় বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ প্রতিবছল সড়ক ও আকাশপথে ভারতে যায়। তার সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। চিকিৎসা লেখাপড়ার জন্যও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক ভারতে যান। তীর্থস্থান যাত্রী, ব্যবসায়ীক কাজ এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করার জন্য ভারতে গমনকারীর সংখ্যাও কম নয়। তবে শুধু ভ্রমণের জন্য এখন অনেক লোক ভারতে যাচ্ছেন অবসর কাটিয়ে দিচ্ছেন বৈচিত্রময় ভারতবর্ষের কোথাও। আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ভ্রমণে দলবদ্ধভাবে ভারত ভ্রমনে রেড়িয়ে পড়ছে। প্রতি বছর ভারত ভ্রমণে যায় এ রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম করে হলেও প্রায় ৫০টি। কিস্তু ভারত থেকে বাংলাদেশে আসেন কম লোক? এ চিত্রটি বড়ই হতাশার, এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় এই সংখ্যা ৫০ থেকে ৭০ হাজারের মতো। এর মধ্যে অধিকাংশই আসেন পূর্বপরুষের ভিটা আর আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করার জন্য।
পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী এক বিরাট অংশ মানুষের আদি নিবাস ছিলো পূর্ববঙ্গে। আজকের বাংলাদেশকে তারা দেখতে চান। পরবর্তী প্রজন্মও দেখতে চায় পূর্ব পুরুষদের ভিটা। এদের মধ্যে ৯০ ভাগেরও বেশি কখনো বাংলাদেশে আসেনি। অবশ্য না আসার পিছনে একটি বড় কারণ তথ্যের অভাব এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানা। পশ্চিমঙ্গের পিয়ারলেস ট্রাভেলস মহানগরী কলকাতায় এক জরিপ করে বের করেছেন যে, এ মহানগরীর প্রায় ৫ লাখ মানুষ তার পিতৃভূমি দেখার জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে আগ্রহী। উৎসের টানে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছের দেশ বাংলাদেশ হতেপারে ভাবাববেগের পর্যটনের অন্যতম ডেস্টিনেশন। এজন্য এখনই পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন বাংলাদেশকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে পরিচিত করানোর জন্য বড় ক্যাম্পেইনের। আমাদের কাছের দেশের এই সব মানুষকে বাংলাদেশ ভ্রমণের এই ভাবাবেগ কাজে লাগাতে না পারলে আমরা হারাবো একটি বড় সুযোগ, বড় বাণিজ্য। ইতিপূর্বে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান ‘ভাবাবেগের ভ্রমণ’ নামে একটি কর্মসূচীর পরিকল্পনার কথা জানিয়ে সাহায্য চেয়েছিলো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বারীন বসু। বাংলাদেশের কিছু অঞ্চল তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বেশ কয়েক দিন ধরে। এ দেশে থাকাকালীন সময়ে প্রথম শ্রেণীর একটি দৈনিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানান, ‘বাড়ির পাশে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। এখনও তাদের ধারণা, বাংলাদেশে রাস্তাঘাট নেই, নদী-নালায় ভর্তি। এখানে থাকার ভালো হোটেল নেই, আনন্দ বিনোদনের উপকরণ নেই। অথচ বাংলাদেশের রাস্তাঘাট দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। যাতায়ত ব্যবস্থা অপূর্ব। এখানে আছে রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের মতো মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ। সিলেট এলাকাও সুন্দর বলে শুনেছি। বিশেষ করে বুড়িগঙ্গায় নৌবিহার সারাজীবন মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পের বিকাশ কিভাবে সম্ভব-এ প্রশ্নের উত্তরে বারীন বসু বলেছিলেন ‘উৎসের প্রতি মানুষের অন্তরের টান অত্যন্ত গভীর। পিতৃভূমির প্রতি মানুষের এই টান নানারকম বাঁধা-বিপত্তির কারণে শিথিল হতে পারে কিস্তু মুছে ফেলা সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশ ভ্রমণকারীর সংখ্যা বাড়াতে হলে মানুষের এই আবেগকে কাজে লাগাতে হবে, হৃদয়ের দুর্বল স্থানে নাড়া দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে ব্যপক প্রচারের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে বাংলাদেশের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা, জানাতে হবে এখানকার সুযোগ সুবিধার কথা। এছাড়া বাংলাদেশেও হিন্দুদের অনেক তীর্থস্থান রয়েছে, এগুলোকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২ কোটি লোক নিয়োজিত এই পর্যটন শিল্পে।
প্রতি বছর পয়ত্রিশ কোটি মার্কিন ডলারের অধিক অর্থ পর্যটনে বিনিয়োগ করা হচ্ছে যা বিশ্বে মোট বিনিয়োগ মূলধনের সাড়ে সাত শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অগ্রানাইজেশনের পরিসংখ্যান মতে ১৯৯৯ সালে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণকারীর সংখ্যা ছিল ৭৫ কোটি। এই অর্গানাইজেশনের ভবিষ্যত বানী অনুযায়ী ২০১০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা একশত কোটিতে বৃদ্ধি পাবে। এই উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে ভারত পর্যটন শিল্প থেকে সবচেয়ে বেশী আয় করে। পর্যটনে ভারতের উপার্জন বাৎসরিক প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। তারপর যথাক্রমে শ্রীলংকা, নেপাল এবং পাকিস্তানের অবস্থান। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত করুন। বাংলাদেশে পর্যটন থেকে কত আয় হয় তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।
আমাদের দেশে পর্যটন একটি শিল্প হিসাবে গড়ে ওঠার রয়েছে উজ্জল সম্ভবনা। কিন্তু পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও সরকারি সহযোগিতার অভাবে পর্যটন এখনো মাথা তুলে দাড়াতে পারছে না। সরকার বা পর্যটন করপোরেশনের কাজ হলো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াতের জন্য আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন এবং বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে এদেশকে বিশ্বে ব্যাপক ভাবে উপস্থাপনা করা। সরকার করবে প্রমোশন আর বাকী কাজ করবে প্রাইভেট সেক্টর। সরকারি নিয়ন্ত্রনাধীন পর্যটন কর্পোরেশনকে আরো বেশী তৎপর হতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যেক্তাদেরকে ঘনিষ্ট সহযোগিতা ও সার্বিক নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের পর্যটনকে উন্নোয়নের পথে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক – নাজমুল আহসান
ই-মেইল: nazmulnewage@gmail.com