জ্ঞান বিজ্ঞানের যেরকম অগ্রগতি হয়েছে তা দেখে ও জেনে আজকাল অনেকেই জানতে চান ক্যান্সার রোগ হিসেবে এখন আর কতোটা ভয়াবহ? এই রোগ চিকিৎসাযোগ্য কী না বা নিরাময়যোগ্য কী না! এই লেখায় আমরা এরকম ভাবনার কিছু উত্তর খুঁজে দেখবো কিন্তু তার আগে আমাদের জানা দরকার ক্যান্সার কি?
আমরা সবাই জানি যে কোন প্রানীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের মাধ্যমে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায়। এই পুরনো কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারনভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। যখন এই কোষগুলো ‘কোন কারণে’ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। একেই টিউমার বলে। এই টিউমার বেনাইন (নির্দোষ) বা ম্যালিগন্যান্ট (ক্ষতিকর) হতে পারে।
খুব সাধারণভাবে যদি কেউ বুঝতে চান তাহলে এই রোগ কিছুতেই আর দশটা রোগের চাইতে আলাদা কিছু নয়। শরীরের যে কোন অসুখ ক্রমান্বয়ে একজন মানুষ, প্রানী বা উদ্ভিদকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিতেই পারে। ক্যান্সার রোগকে আমরা যবে থেকে বুঝতে শুরু করেছি, সেই শুরু থেকেই, আমরা তার কারন হদিস করতে পারিনি, যেরকম হয়েছে অন্য আর সব রোগের বেলায়ও। অজানা কারন হয়তো একে দুর্বিষহ করেছে বিশেষ করে পরিবারের জন্যে, যেহেতু এর চিকিৎসায় খরচ তুলনামুলকভাবে বেশিই পড়ে।
আমাদের জানা দরকার যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক্যান্সার-কে আজকাল অন্য আর সব রোগের মতই বিবেচনা করা হয়। উন্নত বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের ৫০% ভাগই এখন নিরাময় লাভ করেন বা ক্যান্সার হয়নি এমন মানুষদের মতই গড় আয়ু পেয়ে থাকেন। আমাদের মতো গরীব দেশগুলোর অসুবিধা হলো, আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে বেশি একটা খবর রাখিনা বা পাইও না। যাদের পাওয়া উচিত (যেমন চিকিৎসক সমাজ, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী) তাঁরা এই নিয়ে বেশি একটা খোঁজ করেন না বলে তাঁদের কাছে অনেক খবর ঠিকমতো পৌঁছায় না।
ক্ষেত্র বিশেষে পৌঁছালেও ধারাবাহিক মেডিকেল জ্ঞানের অভাবে এসবের অগ্রগতির তাৎপর্য তাঁরা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। ফলে ক্যান্সার রোগের মতো যে রোগগুলো অসংক্রামক তা নিয়ে আমাদের দেশে চিকিৎসা জগতের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। আর এই সুযোগে ওষুধ কোম্পানিগুলো ঝেঁকে বসে আমাদের বেশি দামের ওষুধ কিনে নিতে বাধ্য করছে।
উন্নত বিশ্বে যা হয়, আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় একটি পরিপূর্ণ নিরীক্ষণ পরিকল্পনা নিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয়। এর জন্যে অনুসরণ করা হয় চিকিৎসার ভেদ অনুযায়ী নির্ধারিত অনুসরনিকা বা গাইড লাইন। আমাদের দেশে সেরকম উপযোগী গাইড লাইন না থাকায় ও স্থানীয় পর্যায়ের গবেষণার সুযোগ কম থাকায় নানা রকম পরীক্ষায় পাঠানো হয় রোগীদের। এর ফলে প্রচুর টাকা খরচ হয় শুধু রোগ নির্ণয় করতেই। তার সাথে হয়রানি তো আছেই।
ক্যান্সার সঠিকভাবে সনাক্ত করা গেলে এই রোগ মোটেই ভয়ের কোন অসুখ নয়। স্তনের ক্যান্সার–সহ অনেকগুলো ক্যান্সার প্রাথমিক চিকিৎসায় ভালো হয়। জরায়ুর ক্যান্সার প্রতিরোধে এখন টিকা আবিষ্কার হয়েছে এবং বাংলাদেশেও তা পাওয়া যাচ্ছে।
আমাদের বুঝতে হবে ভয় পেয়ে এই রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে নিজের ও পরিবারের দুর্ভোগ বাড়ানো উচিত নয়। আমাদের দেশে এখন অনেকগুলো চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে তৈরি হয়েছে যেখানে মোটামুটি ক্যান্সার চিকিৎসা নির্ণয়ের ব্যবস্থা আছে।
সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, ক্যান্সার এমন কোন রোগ নয় যে এর ফলেই কারও মৃত্যু অনিবার্য আর অন্য কোন রোগে মৃত্যু হবে না বা জীবন দীর্ঘস্থায়ী হবে। বরঞ্চ ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনে বাকী জীবনের অনেক পরিকল্পনা গুছিয়ে নিতে পারেন যা হৃদরোগ বা আরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হয়না। পৃথিবীতে অনেক নামি দামি মানুষ ক্যান্সারকে জয় করে যতদিন বেঁচে ছিলেন ক্রমাগত সৃষ্টিশীল কাজ করেছেন (যেমন অ্যাপল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী স্টিভ জবস বা আমাদের দেশের শহীদ জননী জাহানারা ইমাম)। ক্যান্সার আক্রান্ত অনেক নামি মানুষের অমর সব সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্ম রয়েছে যা আর সবার জন্যে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের শেষ জীবনে যেসব শারীরিক উপসর্গ হয় তাতে কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী বেশ কষ্ট পেয়ে থাকেন। বিজ্ঞানীগণ এই ব্যাথার মাত্রা নির্ণয় করে এখন সঠিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম ওষুধ মাত্রাভেদে প্রয়োগের ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছেন।
‘প্রশমন যত্ন’ হিসেবে এই সেবা এখন মোবাইল ফোনেও দেয়া হচ্ছে যাতে বাড়ি থেকেই রোগী তার ডাক্তারের কাছে ব্যথা ও অবসাদের মাত্রা জানাতে পারেন। আমাদের দেশেও এই সেবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালু হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীগন মিলে এখন উপায় বের করেছেন কী করে একজন ক্যান্সার রোগীকে বাড়ি রেখেই (পরিবারের অন্য সব সদস্যদের বিরক্ত না করেই) উপযুক্ত চিকিৎসা দেয়া যায়।
এখন বিজ্ঞানীগণ ক্যান্সারের জন্যে যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয় করেছেন যার ফলে ওষুধের মাত্রা (কেমোথেরাপি নামে পরিচিত) সঠিকভাবে অনুসরন করে প্রয়োগ করা হলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় খুব সামান্যই (যেমন চুল পড়ে যাওয়া, বমি বা অবসাদের উপসর্গ হওয়া)। শুধু আমাদের এইসব বিষয়ে কিছুটা সতর্ক জ্ঞানের দরকার।
অনেক পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক অবসাদ ও দুর্ভাবনায় ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের একটি বড় অংশ মারা যায়। যা কখনও কাম্য হতে পারে না। পরিবারের একজন সদস্যের শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকা খুব জরুরী হয় যেখানে তিনি ভুমিকা পালন করে থাকেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ এই নিয়ে অনেক কাজ করছেন এবং আশা করছি এর সুফল ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীগণ শীগগিরই পাবেন।
লেখক – রেজা সেলিম
পরিচালক, আমাদের গ্রাম
ইমেইলঃ info@amadergram.org