জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্ভার, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বা নোনা পানির বন আমাদের সুন্দরবন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবন বৃহত্তর খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরগুনা অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বড় একটি এলাকার রক্ষা কবজ এই বন। অথচ জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় আশ্রয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এই বন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাগেরহাটের রামপালে বাস্তবায়িত হতে চলেছে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
ফলে একইসঙ্গে বনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, কুমিরসহ নানা প্রজাতির জীব বিপন্ন হবে। ধ্বংস হবে সুন্দরবনের স্বাভাবিক পরিবেশ।
যদিও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড কর্তৃপক্ষ বলছে, রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ নির্মাণ হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।
শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থাপনকাজ উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে আমন্ত্রণ জানাতে এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে (১ আগস্ট) কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। আর এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর সারা দেশের পরিবেশবাদীসহ সুন্দরবনপ্রেমীরা।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, ভারতের স্বার্থে সুন্দরবন ধ্বংসের নিশ্চিত আয়োজন করছে সরকার।
দেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ক্ষতিকারক নানা পদার্থ নির্গমনে ক্ষতি হবে সুন্দরবনের। তবু চলছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের তোড়জোড়।
তারা বলেন, সরকার পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে বনের গাছগাছালি, পশুপাখি, মাছসহ সব ধরনের জীববৈচিত্র্যের ওপর। বিদ্যুৎকেন্দ্রের গরম পানি, কয়লা পোড়ানো ছাই ও কালো ধোঁয়া সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করবে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, রামপাল প্রকল্পের দূষণে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে থাকা নিবিড় সুন্দরবন পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই হারিয়ে যাবে। রামপালের ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়া ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড, ৮৫ টন নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, ২ হাজার ৬০০ টন ছাই সুন্দরবনের নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ প্রকল্প কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৭ লাখ টন কয়লা সুন্দরবনের গভীরতম অংশের মধ্য দিয়েই পরিবহন করা হবে। লাখ টনি বাল্ক ক্যারিয়ার আর হাজার টনি লাইটারেজ জাহাজের বছরব্যাপী আনাগোনা, তীব্র শব্দ, জাহাজ থেকে চুইয়ে পড়া তেল, কয়লার ভাঙা টুকরা, জাহাজ চলাচলের প্রচণ্ড ঢেউ সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, সুন্দরবনের আদি বিস্তৃতি ছিল ১৬ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার- যা বর্তমানে তিন-ভাগের একভাগ অবশিষ্ট আছে। বাংলাদেশে সুন্দরবনের বর্তমান বিস্তৃতি (৪০% এলাকা ভারতে) প্রায় ৪ হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার জলমহাল।
ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালের ৭ ডিসেম্বর জীববৈচিত্র্যের জন্য সুন্দরবনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ৩০ আগস্ট ১৯৯৯ অপরিকল্পিত কার্যকলাপের কারণে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকা ঘোষণা করে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ।
ওই ঘোষণার ফলে যেসব কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা হলো- ১. প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা ও আহরণ ২. সবধরনের শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা ৩. বন্যপ্রাণী ধরা ও সংগ্রহ ৪. প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস বা সৃষ্টিকারী সব প্রকার কার্যকলাপ ৫. ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট ও পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কাজ ৬. মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ৭. মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো প্রকার কার্যাবলী।
অথচ এসব বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে সুন্দরবনের কোলে গড়ে তোলা হচ্ছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র।
জানা গেছে, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এরইমধ্যে রামপালে এক হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ কেন্দ্রে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দু’টি ইউনিট থাকবে। সরকার পক্ষের আশাবাদ, ২০১৬ সালের মধ্যে এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে।
অভিযোগ রয়েছে, অধিগ্রহণের ফলে রামপালের সাপমারি কাটাখালী, কৈগরদাসকাটি, কাপাসডাংগা, বাশেরহুলা মৌজাসহ আশপাশের ৪ হাজার পরিবাকে জোরপূর্বক তাদের ভিটামাটি ছাড়া করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে গোয়ালের গরু আর জমির ধান। এই ১ হাজার ৮৩৪ একর জায়গাজুড়ে বছর প্রতি যে ১৩০০ টন ধান আর ৬০০ মেট্রিক টন মাছের উৎপাদন ছিল- তা এরইমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের কারণে হাজার জীবনের সাজানো সংসার নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তারা উদ্বাস্তু। তাদের কেউ কেউ দিনমজুরি করে অতি কষ্টে দিনানিপাত করছেন আবার কেউ শহরমুখী হয়ে বস্তির জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
বন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাতের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশেও এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দরকার। কিন্তু যদি এটা হয় বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক সুন্দরবনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনের কাছে, তাহলে বিপদের শেষ নেই।
তিনি বলেন, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণিকা, মারকারি বা পারদ, আর্সেনিক, শেলেনিয়ামসহ পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান নির্গত হয়।
কয়লা পুড়ে তৈরি হয় ছাই। আর কয়লা ধোয়ার পর পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় আরেকটি বর্জ্য কোল স্লাজ বা তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই ও স্লাজ উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত। কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। এতে মানবদেহের যেমন ক্ষতি, তেমন ক্ষতি বন ও বন্য প্রাণীরও।
তিনি আও জানান, রামপালের এই ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারতে প্রতিষ্ঠার জন্য ৭৯২ একর এক ফসলি কিংবা অনুর্বর পতিত জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। অথচ বাংলাদেশে সেই একই প্রকল্পের জন্য ১৮৩৪ একর কৃষি, মৎস্য চাষ ও আবাসিক এলাকার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে যার ৯৫ শতাংশই তিন ফসলি কৃষি জমি। যেখানে বছরে ৬২ হাজার ৩৫৩ টন ধান এবং ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৬১ টন অন্যান্য শস্য উৎপাদিত হয়।
গড়ান (ম্যানগ্রোভ) বনের সঙ্গে এ এলাকার নদী ও খালের সংযোগ থাকায় এখানে বছরে ৫ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। কয়লাভিত্তি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে প্রকল্প এলাকার ফসল ও মৎস্য সম্পদ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।
সুন্দরবন এলাকার বাতাসে ক্ষতিকারক সালফার ও নাইট্রোজেনের মাত্রা বর্তমানে প্রতি কিউবিক মিটারে ৮-১০ মাইক্রোগ্রাম রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে ঘনত্ব ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রামে গিয়ে ঠেকবে। এর পরিণতি হিসেবে বিপন্ন হয়ে পড়বে সুন্দরবনের অস্তিত্ব। তাই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে আমাদের লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সহযোগী প্রফেসর মো. ওসিউল ইসলামের মতে, রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে, তৈরি হবে অসংখ্য কয়লা ডিপো। কয়লা পোড়া সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি সুন্দরবনের জৈবিক পরিবেশ ও বায়ুমণ্ডকে বিঘিœত করবে। বায়ুমণ্ডলের সালফার ডাই অক্সাইড ও কার্বন যৌগসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রিন হাউজ গ্যাস বনের জন্য অতি মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে।
রামপাল কৃষি জমি রক্ষা কমিটির সভাপতি সুসান্ত দাস জানান, রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবন ও সংলগ্ন লোকালয়ের উপর অপূরণীয় পরিবশগত ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এলাকার মাটি, পানি ও বাতাসের দূষণসহ লবণাক্ততা ও তাপমাত্রা বাড়বে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য, কয়লা ধোঁয়া পানি, কয়লার ভেতরে থাকা সালফার, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান এবং কেন্দ্র থেকে নিঃস্বরিত কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস থেকে এ সব দূষণ সৃষ্টি হবে।
ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ এলাকার মানুষের কৃষি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবুজ বেষ্টনী। তাই সরকারকে তার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বিশ্বের কোথাও সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভারত এনটিপিসিকে মধ্যপ্রদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি দেয়নি। অথচ আমরা কেন অনুমোদন দিচ্ছি?
বিদ্যুৎ আমাদের অবশই দরকার কিন্তু আর জন্য সন্দরবন ধংস নয়। আমরা সরকারকে কাছে দাবি জানান এ তার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার।
আমরা সুন্দরবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারিনা।
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের দাবিতে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ঢাকা থেকে সুন্দরবনের (রামপালের) উদ্দেশে লংমার্চ শুরু করবে। যা ২৮ সেপ্টেম্বর রামপালে এসে শেষ হবে।
মাহবুবুর রহমান মুন্না এর লেখা থেকে….
মাহবুবুর রহমান মুন্না
সাংবাদিক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (খুলনা) বাংলানিউজ।।
সুত্র – বাংলানিউজ