নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
পৌষের সকাল, কুয়াশার চাদর মাড়িয়ে সূর্য আলো ফুটলেও শীতের আবেশ তখনো কাটেনি। এরই মাঝে দল বেঁধে বিদ্যালয়ের আসতে শুরু করেছেন নবীন-প্রবীণেরা। বেল ততক্ষণে প্রায় সাড়ে ১০টা, এসএসসি’১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী তাহুরুন নেসা সবার ভিড়ে খুঁজছিলেন তাঁর বন্ধুদের। পাশেই খেয়াল করেন বেশ প্রবীণ একজন; বয়সের পার্থক্যটা বিস্তর, তবে ’৭৩ ব্যাচের ফিরোজা নাসরিনও খুঁজ ছিলেন তাঁর বন্ধু- সহপাঠীদের।
দীর্ঘ বছর পর প্রিয় বিদ্যালয়ে পা-রেখে তাদের মত সবাই ব্যাস্ত প্রিয় বন্ধু-সহপাঠীদের খোঁজে। তাদের সঙ্গে পেয়ে কেউ বা মেতেছেন আড্ডায়, কেউ গানে, স্মৃতিকথায়। মঙ্গলবার সকালে এমন প্রাণের এই উচ্ছ্বাস দেখা গেল বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী উৎসবে। দুই দিনব্যাপী এই আয়োজন শেষ হবে বুধবার রাতে বাগেরহাট জেলা স্টেডিয়ামে আয়োজিত সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
‘ওলো সই, ওলো সই, আমার ইচ্ছে করে তোদের মতন মনের কথা কই’ স্লোগানে আয়োজিত এই উৎসবে ১৯৬২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বর্ষে বিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়া দেড় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ছাড়াও বর্তমান শিক্ষার্থীরা অংশে নিচ্ছে। স্কুল জীবনের প্রতিদিনকার সেই নিয়মিত সমাবেশের (এ্যাসেম্বিলি) মত মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা। পরে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা রং বে রং এর ফেস্টুন প্লাকার্ডে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শোভাযাত্রাটি বাগেরহাট জেলা স্টেডিয়ামে গিয়ে শেষ হয়।
পরে সেখানে স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে কথা বলেন বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। প্রবীণদের সঙ্গে পরিচয়ের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে উচ্ছ্বসিত দেখা যায় নবীনদেরও। সন্ধ্যায় বাগেরহাট জেলা স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
তাহুরুন নেসা বলছিলেন, ‘৭৩ ব্যাচের ফিরোজা নাসরিন আপুর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুব ভালো লাগলো। আজ আমি আমার পৌনে ৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছি। তিনি এসেছেন তার মেয়ের হাত ধরে। উনি অনেক কথা বললেন, এক সময় শিক্ষকতা করতেন, এখন অবসরে। আগের বারের শতবর্ষপূর্তী উৎসবেও তিনি ছিলেন। আমরা বন্ধুরা মিলে তার সঙ্গে সবাই ছবি তুলেছি।’
ষাটের দশকের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জোসনা দেবনাথ বলেন, ক্লাস থ্রিতে এই স্কুলে ভর্তি হই। পাকিস্তান আমলে আমি এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করি। স্কুল মানে আবেগ, ভালবাসা। আজ এই স্কুলে আসলাম, আমার সময়ে আমার কোন সহপাঠিকে এখানে পাচ্ছিনা। তাতে আমার দু:খ নেই। এখনকার ছোটদের কাছে পেয়ে দারুণ উপভোগ করছি। সবার মাঝে যেন আমি আমার শৈশবকে ফিরে পাচ্ছি।
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক মাসুমা রুনা বলেন, গত এক বছর ধরে এই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজনের চেষ্টা করি। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৬২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই স্কুলে পড়া দেড় হাজার শিক্ষার্থী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অগ্রীম নিববন্ধন করেন। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে তারা সবাই দারুণ আনন্দিত। নানা অনুষ্ঠানমালায় সাজানো হয়েছে এই পুনর্মিলনীর দুদিনের অনুষ্ঠান। সবাই যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে আমরা সত্যিই মুগ্ধ। এই দুদিন সবাই দারুণ আনন্দে মেতে থাকবেন।
দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান রয়েছে স্মৃতিচারণ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আড্ডা, শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় সংগীতা অনুষ্ঠান, রং উৎসব, ৭১ ও ২৪ এর শহীদদের স্মরণ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও দেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান।
১৯১৮ সালে বাগেরহাট শহরের প্রাণ কেন্দ্রে গড়ে ওঠা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বয়স এখন ১০৭ বছর। শুরুতে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করা স্কুলটি ১৯৩৮ সালে ‘মনোমোহিনী উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয়’ নাম করন করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৬৮ সালে সরকারিকরণের পর বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয় শতবর্ষী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির।
এসআই/আইএইচ/বিআই/২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪