ডাকাতি নয়, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। প্রথমে জাহাজের মাস্টারকে হত্যা, পরে ধরা পড়ার ভয়ে বাকি সবাইকে হত্যার করতে চেষ্টা করে আকাশ।
বিশেষ প্রতিনিধি, বাগেরহাট ইনফো ডটকম
চাঁদপুরের মেঘনায় সার বোঝাই জাহাজে চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের ঘটনায় আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান নামে এক ব্যক্তিকে বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
মঙ্গলবার দিনগত রাতে চিতলমারী উপজেলার বাকেরগঞ্জ এলাকা থেকে র্যাব-১১ (কুমিল্লা) তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল আরিফ।
গ্রেপ্তার আকাশ মণ্ডলের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর এলাকায়।
২৩ ডিসেম্বর দুপুরে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করা ‘এম ভি আল-বাখেরা’ নামের একটি সারবাহী নৌযান থেকে ৫ জনের রক্তাক্ত মরদেহসহ ৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুজনের মৃত্যু হয়। ওই সাত খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আকাশ মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। নৌযানটিতে নিহতদের সঙ্গে আকাশও ছিলেন বলে জানিয়েছেন নৌ পুলিশ।
আহত জুয়েলের লিখে দেওয়া তথ্যে ইরফান গ্রেপ্তার
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাতে হাইমচর থানায় মামলা ‘অজ্ঞাত ডাকাত দলকে’ আসামি করে মামলা করেন জাহাজের মালিক মাহাবুব মোর্শেদ। ওই মামলার এজাহারে জাহাজ মালিক নবম ব্যক্তি হিসেবে ঠিকানাবিহীন জনৈক ইরফান নামের ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন। এজাহারে জাহাজ মালিক উল্লেখ করেন, আহত জুয়েল তার সঙ্গে থাকা ৯ জনের মধ্যে ইরফান ছিল বলে হাতে লিখে জানান। সে সুস্থ হলে ডাকাতদের দেখলে চিনবে বলে ইশারায় জানিয়েছেন।
মামলার বাদী এজাহারে জাহাজে থাকা সাত জন খুন ও এক আহতের কথা উল্লেখ করেন। খুন হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, গ্রিজার সজিবুল ইসলাম, লস্কর মাজেদুল ইসলাম, শেখ সবুজ, আমিনুর মুন্সী, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিন ও বাবুর্চি রানা কাজী। এ ছাড়া আহত ব্যক্তি হলেন- সুকানি জুয়েল (২৮)। তিনি ফরিদপুর সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের সেকান্দর প্রকাশ সেকেন্ড খালাসীর ছেলে।
ঘটনার পর পুলিশ ওই জাহাজ পরিদর্শনকালে একটি রক্তাক্ত চাইনিজ কুড়াল, একটি ফোল্ডিং চাকু, দুটি স্মার্টফোন, দুটি বাটন ফোন, একটি মানিব্যাগ, নগদ ৮ হাজার টাকা, একটি বাংলা খাতা, একটি সিল, একটি হেডফোন, এক মুঠো ভাত ও এক টেবিল চা চামচ তরকারি জব্দ করে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
নৌপুলিশ জানিয়েছে, আহত জুয়েল বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
নৌ-পুলিশের চাঁদপুরের অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, এটি কোনো ডাকাতি না। সব মিলিয়ে আমাদের ধারণা হয়ে ছিল এটা পরিকল্পিত হত্যা। কারণ যে ভাবে কক্ষে কক্ষে রেখে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, আর ওই জাহাজে আরও একজনের থাকার বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার কারণে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
ক্ষোভ থেকে প্রথমে জাহাজের মাস্টারকে, পরে ধরা পড়ার ভয়ে বাকিদের হত্যা
জাহাজে ৭ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফান (২৬) ক্ষোভ প্রথমে থেকে জাহাজের মাস্টারকে হত্যা করেন। পরে ধরা পড়ার ভয়ে অন্যদের হত্যার পরিকল্পনা করেন। তিনি একাই এর সঙ্গে যুক্ত। গ্রেপ্তারের পর বুধবার দুপুরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে র্যাবের পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
র্যাবের ভাষ্য, নিয়মিত বেতন-ভাতা ও ছুটি না পাওয়ার জেরে এমভি আল-বাখেরা জাহাজের মাস্টারের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন আকাশ। ঘটনার সময় খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে প্রথমে মাস্টারকে হত্যা করেন তিনি। এরপর চিন্তা করেন, অন্যরা জীবিত থাকলে তিনি সহজেই ধরা পড়ে যাবেন। তখন জাহাজে থাকা বাকি সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। জাহাজে থাকা অন্য সাতজনকে আঘাত করেন। এর মধ্যে একজন বেঁচে যান।
গ্রেপ্তারের সময় আকাশের কাছ থেকে একটি হ্যান্ড গ্লাভস, একটি ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহত ব্যক্তিদের ব্যবহৃত পাঁচটি ও আকাশের ব্যবহৃত দুটিসহ মোট সাতটি মুঠোফোন এবং বিভিন্ন জায়গায় রক্ত মাখানো নীল রঙের একটি জিনস প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
র্যাব-১১-এর সিপিসি-২ কুমিল্লা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তায় গতকাল রাতে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য দেন।
আকাশ র্যাবকে বলেছেন, তিনি প্রায় আট মাস ধরে এই জাহাজে চাকরি করছেন। জাহাজের কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময়মতো পেতেন না। বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া একাই ভোগ করতেন। এ ছাড়া জাহাজের মাস্টার কর্মচারীদের সঙ্গে রাগারাগি করতেন। কারও ওপর নাখোশ হলে তাঁকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতেন। তাদের বকেয়া বেতনও দিতেন না। এসব নিয়ে তিনি মাস্টারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
সে অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর আকাশ তিন পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রেখে দেন। ২২ ডিসেম্বর সকাল আটটায় তাঁরা মোট ৯ জন জাহাজে ৭২০ টন ইউরিয়া সার নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। ওই রাতে খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে প্রথমে তিনি মাস্টারকে হত্যা করেন। পরে একে একে অন্যদের কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন। সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সব জাহাজ তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেলে আকাশ নিজে জাহাজ চালাতে থাকেন। জাহাজটি একপর্যায়ে ইশানবালা খালের মুখে মাঝিরচরে আটকা পড়ে। তিনি জাহাজটি নোঙর করে পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রলারে বাজার করার কথা বলে উঠে পালিয়ে যান।
এসআই/আইএইচ/বিআই/২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪/আপডেট