স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
ভাষাসৈনিক, শিক্ষক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক ড. হালিমা খাতুন আর নেই।
মঙ্গলবার (৩ জুলাই) দুপুর ১টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। দীর্ঘিদন ধরে তিনি হৃদরোগ, কিডনি জটিলতাসহ নানা জটিল রোগে ভূগছিলেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিকেশন ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান সাগুফা আনোয়ার জানান, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, রক্তদূষণের মতো নানা জটিলতা নিয়ে গত শনিবার এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮৬ বছর বয়সী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যাদের সাহসী পদক্ষেপে মায়ের ভাষা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়, স্বাধীন রাষ্ট্রের ষ্বপ্ন দেখিয়েছেন তাদেরই একজন অধ্যাপক ড. হালিমা খাতুন। গত ২১ জুন গুরুতর অসুস্থ্য হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হালিমা খাতুনের ভাইঝি শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ঈদের পর গেল ২১ জুন গুরুতর অসুস্থ হলে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে গত ২৩ জুন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার তাঁর মৃত্যু হয়।
হালিমা খাতুনের একমাত্র মেয়ে দেশের অন্যতম আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী।
তিনি বলেন, হালিমা খাতুনের মরদেহ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হবে ধানমন্ডিতে নাতনীর বাসায়। বুধবার (৪ জুলাই) সকালে ১১টায় তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বুধবার বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হবে।
বিকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন হবে হবে এই ভাষাসৈনিকের।
অধ্যাপক ড. হালিমা খাতুন ১৯৩৩ সালের ২৫ শে অগাস্ট বাগেরহাট জেলার বাদেকাড়াপাড়া গ্রামে জন্ম নেন। তার বাবা মৌলবী আবদুর রহিম শেখ এবং মা দৌলতুন নেসা। বাবা ছিলেন তৎকালীন গুরু ট্রেনিং স্কুলের (বর্তমান প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং স্কুল-পিটিআই) শিক্ষক। নিজে শিক্ষক হওয়ায় ৭ মেয়ে ও এক ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলতে কোন আপস করেননি তিনি।
হালিমা খাতুনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট শহরতলীর বাদেকাড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর মনমোহিনী গার্লস স্কুল (বর্তমান বাগেরহাট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়) থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে (বর্তমান সরকারি পিসি কলেজ)। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে বিএ পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি করেন।
১৯৫৩ সালে খুলনা করোনেশন স্কুল এবং আরকে গার্লস কলেজে শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা। কিছুদিন রাজশাহী গার্লস কলেজে শিক্ষকতার পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে। এখান থেকে অধ্যাপক হিসেবে ১৯৯৭ সালে অবসর নেন তিনি।
পর জাতিসংঘের উপদেষ্টা হিসেবে ২ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে দুই বছরের জন্য সাভার গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গণবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন ভাষা সৈনিক ড. হালিমা খাতুন।
কলেজ জীবন থেকে রাজনীতি সচেতন হালিমা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্র রাজনীতিতে; পরে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামেও তিনি জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তির হন তিনি। তখন সব বিভাগ মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ছিলেন ৪০-৫০ জন। তখনকার উইম্যান স্টুডেন্ট রেসিডেন্টটি এখন রোকেয়া হল নামে পরিচিত। এই হলে মোট ৩০ জন ছাত্রী থাকত। তাদের একজন হালিমা খাতুন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরের আমতলায় সমাবেশে তিনি ছাত্রীদের জড়ো করায় ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলা বাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম বের হয় মেয়েদের দল। তার সদস্য থাকে ৪ জন- জুলেখা, নূরী, সেতারার সঙ্গে সারিতে ছিলেন হালিমা খাতুন। বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে একে একে মেয়েদের ৩টি দল বেরিয়ে আসে। শুরু হয় লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া।
পরে ভাষা সৈনিকদের মিছিলে গুলি চালায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। রাস্তায় ভাষা শহীদের তাজা রক্ত। আহতদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য সবাই ছুটছে। রক্তে ভেজা রাস্তার মাঝে মানুষের মাথার মগজ ছিটিয়ে পড়া। সেই মিছিলে হতাহতদের ছবি তুলে রেখেছিলেন ছাত্ররা। সেই ছবিটি তারা লুকিয়ে রেখেছিলেন হলে।
সেখান থেকে সেই ছবি আনার দায়িত্ব পড়ে তাঁর উপর। অন্ধকার রাতে রাবেয়া ও হালিমা জীবনবাজি রেখে পুলিশের সামনে দিয়ে গিয়ে ওই ছবি নিয়ে আসে। পরে ছবিটা বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন হালিমা খাতুনরা।
পরদিন সেই ছবি ছাপা হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
ভাষা সংগ্রামে আহত ছাত্র-জনতার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। হালিমা খাতুন তার দল সংগঠিত করে চাঁদা তুলেছিলেন। পরে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত করার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন তিনি।
হালিমা খাতুন হলের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহরে চাঁদা তুলেছেন। লিফলেট বিলি, পোস্টার লেখা এবং মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা ছিল হালিমা খাতুনের নিত্যদিনের রুটিন কাজ। ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে এসব কাজ করে তিনি আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হালিমা খাতুন পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদের সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছেন।
ভাষা আন্দোলনে তাঁর সেই অনন্য সাহসী ভূমিকা ও সাহিত্যে স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক ভাষা সৈনিক সম্মাননা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কার, বাগেরহাট ফাইন্ডেশনের আজীবন সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।
এইচ/এসআই/বিআই/০৩ জুলাই, ২০১৮