অলীপ ঘটক, চিফ নিউজ এডিটর | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ডাকরা গ্রাম। এই গ্রামের কালিবাড়ি ছিল তৎকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় মিলনকেন্দ্র। ১৯৭১-এর গণহত্যা-নির্যাতন থেকে বাঁচতে একসাথে ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে ১১মে থেকে বাগেরহাট ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসতে শুরু করে এখানে।
কথা ছিল, কালিবাড়ির প্রধান সেবাইত নোয়াকর্তাকে নিয়ে মে মাসের ২২ তারিখ দল বেঁধে সুন্দরবন হয়ে নৌকাযোগে ভারতে রওনা হবেন সবাই। এর আগেই শহস্রাধিক মানুষ নৌকা নিয়ে জড়ো হয় মংলা নদী, মাদারতলা নদী ও কুমারখালী খালে।
১৯৭১ সালের ২১ মে এই গ্রামে রাজাকাররা হানা দেয়। গুলি ও জবাই করে ছয় শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। এটি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। কিন্তু সেখানে এখন নেই তেমন কোন স্মৃতি চিহ্ন। নদী ভাঙনে নোয়াকর্তার মন্দিরটিসহ বধ্যভূমি এলাকার উল্লেখযগ্য অংশ বিলিন হয়ে গেছে। পাশেও নেই কোনো স্মৃতিফলক।
এ ছাড়া কচুয়া উপজেলার শাঁখারীকাঠি, বাগেরহাট শহরের ডাকবাংলো ঘাট ও সদর উপজেলার কান্দাপাড়ায় রাজাকাররা নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন এসব বধ্যভূমি চিহ্নিত করে। কিন্তু এগুলো প্রায় সারা বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে।
অভিযোগ আছে, কেবল মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কোন দিবস আসলেই শুধু ওই বধ্যভূমি, স্মৃতিস্তম্ভগুলো ধুঁয়েমুছে তাতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। আর সারা বছর ধরে অযত্নন আর অবহেলায় পড়ে থাকে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের এসব স্মৃতি চিহ্নগুলো।
১৯৯৭ সালে বাগেরহাট শহরের ভৈরব নদের তীরের ডাকবাংলো বধ্যভূমি চিহ্নিত করে একটি ফলক উন্মোচন করা হয়। কিন্তু ওই ফলক উন্মোচনের ২০ বছর পার হলেও সেই জায়গাটি এখনও উন্মুক্ত পড়ে আছে। মোরেলগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের একটি বধ্যভূমি আজও চিহ্নিত হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধা মানিক লাল মজুমদার বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকাররা বাগেরহাটে নিরীহ মানুষের রক্তে বধ্যভূমি লাল করেছে। অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সরকার অনেক বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে স্তম্ভ নির্মাণ করেছে। তবে গণহত্যার সাক্ষী এসব স্থান বলতে গেলে সারা বছরই পড়ে থাকে অবহেলায়। প্রশাসনের উচিত বধ্যভূমিগুলো সারা বছর দেখভালের ব্যবস্থা করা।’
বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের ছাত্র আকাশ দাস বলেন, ‘বাগেরহাটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়েছি। ওই সময় রাজাকাররা যেসব স্থানে গণহত্যা চালিয়েছিল, সেসব জায়গা ঘুরে দেখেছি। অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, এসব জায়গা অরক্ষিত। অধিকাংশ স্থানে সীমানাপ্রাচীর নেই। যেগুলোতে সীমানাপ্রাচীর আছে, সেখানেও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ হয়ে আছে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ফররুখ হাসান বলেন, শহরের ভৈরব নদের তীরের ডাকবাংলোর বধ্যভূমিটি একাত্তরের কসাইখানা হিসেবে পরিচিত। রাজাকাররা এখানে অসংখ্য মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। পরে মরদেহ ভৈরব নদে ভাসিয়ে দেয়। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় প্রশাসন এখানে একটি ভিত্তিফলক উন্মোচন করে। এরপর ২০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু জায়গাটি আজও সংরক্ষণ করা হয়নি।
এখনও উন্মুক্ত পড়ে আছে। আগামী প্রজন্মের তরুণদের জন্য এই স্থানে অবিলম্বে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার দাবি জানান তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডার শাহীনুল আলম ছানা বলেন, ১৯৭১ সালে রাজাকাররা বাগেরহাটে অন্তত ৭০০ মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। কিন্তু এখানে প্রায় সব বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ সারা বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে। বিজয় দিবসসহ কোনো বিশেষ দিবস এলেই সেগুলো পরিষ্কার করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। স্মৃতিস্তম্ভগুলোকে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে তা সংরক্ষণ করা এবং শহরের ডাকবাংলোর বধ্যভূমিটিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা দরকার।
জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, বাগেরহাটে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষিতই রয়েছে। সরকার এসব বধ্যভূমি রক্ষার জন্য বরাদ্দ দিচ্ছে। এগুলোকে আরও ভালোভাবে দেখভাল করতে প্রশাসন উদ্যোগ নেবে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে বাগেরহাটের কেন্দ্রীয় বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত ডাকবাংলোকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে শিগগির কাজ শুরু করা হবে।
এ ছাড়া জেলার সবগুলো বধ্যভূমি সারা বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
এজি//এসআই/বিআই/০৮ ডিসেম্বর, ২০১৭