আইনজীবী সমিতির ভবন নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি
প্রতিবাদ ও মামলার আইনজীবী হওয়াতে হামলা!
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বাগেরহাট জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ নুর মোহাম্মদের উপর হামলার পাঁচ দিন পার হলেও এখনও কোন মামলা হয়নি।
হামলার সাথে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন সেচ্ছাসেবকলীগের একাধিক নেতার। তবে আইনজীবী সমিতির (বার) ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ করাতেই ওই হামলা হয়েছে বলে ধারণা বারের একাধিক সদস্যের।
হামলার শিকার আইনজীবী নুর মোহাম্মদও একই অভিযোগ করেছেন।
গত শনিবার সকালে বাগেরহাট শহরের সোনাতলা এলাকায় ওই আইনজীবীর উপর হামলার ঘটনা ঘটে। হাতুড়ির আঘাতে তার ডান পা ভেঙে গেছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
অভিযোগ উঠেছে, হামলার ঘটনাটিকে আওয়ামীলীগপন্থি আইনজীবীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বলে পুলিশ ধীরগতিতে তদন্ত করছেন। এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি তারা।
পুলিশের এমন ভুমিকার জন্য সমিতির অনেক আইনজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা চাইছেন যারা এই হামলার ছক কষে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে নুর মোহম্মদের উপর হামলা করিয়েছেন পুলিশের উচিৎ দ্রুত তাদের মুখোস উন্মোচন করা।
এদিকে, আইনজীবী নুর মোহম্মদের উপর হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার (১৭ অক্টোবর) জেলা আইনজীবী সমিতি সাধারণ সভা করেছে। তবে ওই সভা শেষ হয় কেবল হামলার ঘটনায় নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়েই।
হামলার শিকার আইনজীবী নুর মোহাম্মদ বলছেন, হামলার মূল কারণ ভবন নির্মানে অনিয়মের বিরোধীতা করা। এ জন্য একাধিক বার হুমকিও দেওয়া হয়েছে তাকে।
বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির বহুতল ভবন নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকায় শুরু হওয়া কাজে অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলার আইনজীবীও তিনি। তাই ভাড়াতে লোক দিয়ে হামলা করানো হয়েছে বলে দাবি তার।
এদিকে, আর্থিক স্বচ্ছতা রাখতে সমিতির নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের কাজটি সরকারিভাবে করার দয়িত্ব নিতে অর্থমন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছেন বাগেরহাটের এক আইনজীবী। জেলা বারের সদস্য ও দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার বাদী এস এম জিন্ন ওই চিঠি দেন।
নুর মোহাম্মদের উপর হামলা ও ভবন নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থলোপাটের অভিযোগ উঠলেও জেলা আইনজীবী সমিতি এবং বারের নেতৃবৃন্দ শুরু থেকে ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
তবে নুর মোহাম্মদের দাবি, বারের বর্তমান সভাপতি এ কে আজাদ ফিরোজ টিপু ভাড়াটে সন্ত্রাসীর মাধ্যমে এই হামলা করান। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা সেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক সরদার আব্দুল কাদের। হামলার দিন তারা আমার বাড়ির কাছে হাতুড়ি নিয়ে দাড়িয়েছিল। আমি জেলা জজের বাসভবনের সামনে পৌঁছলে কাদেরের নির্দেশে তার আমার উপর হামলা চালায়। পরে মোটরসাইকেলযোগে শহরের দিকে চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে দিনের দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ১৪ অক্টোবর সকাল পৌনে ৯টার দিকে বাগেরহাট-খুলনা সড়কের সোনাতলা এলাকায় চার থেকে পাঁচটি মোটরসাইকেল এসে থামে। তাতে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী অন্তত ৮/৯ জন ছিল। তারা মোটরসাইকেল থেকে নেমে নুর মোহাম্মদের উপর হামলা চালায় এবং গালাগাল করতে থাকে। তাদের মধ্যে অন্তত্য তিন জনের হাতে লোহার হাতুড়ি ছিল।
জেলা জজের বাসভবনের সামনে ওই হামলা শুরু করে। দূর থেকে তা দেখলেও আমরা ভয়ে সেখানে যাই নি। ৭/৮ মিনিট পরই হামলাকারীরা সবাই মোটরসাইকেলে চড়ে শহরের দিকে চলে যায়।
আইনজীবী এস এম জিন্না বলেন, ‘২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। বর্তমান কমিটি ও এর সভাপতি এ কে আজাদ ফিরোজ টিপু নিয়মবহির্ভূতভাবে পুতুল ঠিকাদার নিয়োগ করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে।’
বারের দুই সদস্য জিন্ন ও খাঁন মোহম্মদ আলী বাদশা অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগ তুলে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
‘এজন্য তারা আমাদের উপর ক্ষুব্দ। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ তুলে নিতেও চাপ দিচ্ছিল তারা। কিন্তু আমরা তাতে রাজি না হওয়ায় আজাদ ফিরোজ টিপু পরিকল্পিতভাবে এ হামলা করান বলে দাবি এ্যাডভোকেট জিন্নার।
এ্যাডভোকেট মোহম্মদ আলী বাদশা বলেন, বারের সভাতে অভিযুক্ত আজাদ ফিরোজ টিপু সভাপতিত্ব করায় আমিসহ ১৮ জন ওই সভা বয়কট করি। এটি লোক দেখানো সভা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইনজীবী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের সমিতি হামলার ঘটনার ৪ দিন পর একটি সাধারণ সভা করলেও কেবল নিন্দা আর আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বাগেরহাট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে আজাদ ফিরোজ টিপু। তিনি বলেন, বারের সদস্য নুর মোহাম্মদের উপর হামলার ঘটনায় আমরা সাধারণ সভা করে তীব্রনিন্দা ও হামলাকারীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে প্রশাসনের কাছে দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তাছাড়া তার উন্নত চিকিৎসা ও মামলার সব বিষয়ে খরচ যোগাবে সমিতি।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা তথ্য প্রমান দিয়ে দেখাতে পারবো কোন দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়নি। তাদের অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।
‘আমি ও আমার পরিষদ চাই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করা হোক। তা হলেই হামলার আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।’
হামলায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা জেলা জেলা সেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সরদার আব্দুল কাদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি হামলার বিষয়ে কিছুই জানিনা। ওই দিন আমি সেখানে ছিলাম না।
পুলিশ বলছে, প্রাথমিক তদন্তে তাদের কাছে পরিস্কার আইনজীবী সমিতির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ওই হামলা হয়েছে।
বাগেরহাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাতাব উদ্দিন বলেন, হামলার শিকার আইনজীবী বর্তমানে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রয়েছেন। তিনি অসুস্থ্য থাকায় তার কাছ থেকে আমরা এখনও কোন তথ্য পাইনি। তাছাড়া এখনো মামলাও হয়নি।
তিনি মামলা করলে আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এজি//এসআই/বিআই/১৮ অক্টোবর, ২০১৭