[বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭০ বছর পূর্তিতে ৩-৫ সেপ্টেম্বর, তিন দিনব্যাপী প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনী উৎসব উপলক্ষে রচিত।]
• প্রশান্ত মৃধা
১৯৮১ সালের শেষ দিকে, বাবা আমাকে বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরআগে এই স্কুলের ভিতরটা দেখার সুযোগ হয়নি। খুলনা থেকে ট্রেনে বাগেরহাটে আসার সময়ে বাইরে থেকে দেখেছি। কলেজ স্টেশনের পরে ট্রেনটা যখন অজ্ঞাত কারণে গতি বাড়িয়ে দিত। তখন বাঁ-দিকের জানালায় বসলে স্কুলের মাঠ, তারপর সরুই থেকে দশানিমুখী রাস্তার লেভেল ক্রসিং, সেখানে পারের অপেক্ষায় রিকশা ও সাইকেল আরোহী ট্রেনের জানালায় তাকিয়ে আছে। এরপর পগারের ওপাশে কয়েকটা বাড়ি আর এক চিলতে ফাঁকা মাঠের পরে স্কুল-বিল্ডিঙের খানজাহান আলীর রোডের দিকের গেট একেবারে রেললাইন সমান্তরাল।
সেখানে দোতলার ঝুলবান্দার গায়ে বড়ো সাইনবোর্ডে লেখা : বাগেরহাট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, নিচে, স্থাপিত : ১৯৬৭। কিন্তু মুখে মুখে কখনও : নুরুল আমিন স্কুল; কখনও : সরকারি স্কুল!
এটা যে কিছুদিনের ভিতরে আমার পরবর্তী স্কুল হতে যাচ্ছে, সে আভাস পেয়েছিলাম। বাবা তখন খুলনা জেলা স্কুলের শিক্ষক। আমি সেখানকারই ছাত্র। ১৯৬৭-তে তিনি প্রথম বাগেরহাট সরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। বাবা সামনে খুলনা থেকে বাগেরহাটে বদলি হলে এই স্কুলে আমাকে ভর্তি করাবেন, এর বেশি আর কিছু ক্লাস ফোরের ছাত্র হিসেবে আমার জানা ছিল না।
এখানে ভর্তি হওয়ার পরে আমি প্রথম প্রথম খুলনা জেলা স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতর সঙ্গে মিলিয়ে নিতাম সব। যদিও সেই বয়েসে অতীতের কিংবা কিছুদিন আগের স্মৃতি বেশি দিন টাটকা থাকে না, তাই খুব অল্প সময়ের ভিতরেই এই স্কুল আমার হয়ে গেল, তখন পিছনে পড়ে থাকল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির (পৌনে এক বছর) ছাত্র হিসেবে খুলনা জেলা স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতা। স্কুলের সঙ্গে বিশাল মাঠ। উঁচু লাল একতলা বিশাল ব্রিটিশের দালান, যেটা মনিং শিফটের; এ পাশে পুব দিকে তিনতলা ডে-শিফটের বিল্ডিং। এরপর উত্তর-দক্ষিণমুখী সোজা রাস্তা। তারপর হোস্টেলের বিশাল চৌহদ্দি একেবারে রূপসার গা-ঘেঁষে। ওই এলাকার প্রতিটি রাস্তা সোজাসুজি। স্কুলের পিছন দিক দিয়ে রাস্তা কোর্ট ও বড়ো মাঠের দিকে গেছে। সেই প্রায় দশ বছর বয়েস পর্যন্ত প্রতিদিনের ভূগোল প্রায় মুছে গেল নিজের অজান্তে!
তার তুলনায় পিছনের গেট দিয়ে ঢুকলে চারদিকে মোড়ানো প্রায় ও-সেপড বিল্ডিঙের এই চৌহদ্দি বড়ো চোখে তাকিয়ে দেখেছি! বাবা আমাকে নিয়ে এ পথেই ঢুকেছিলেন। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে অমলেন্দু স্যার, সরসারি তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁরা যে প্রাক্তন সহকর্মী এসব কিছুই জানি না। শুধু পরদিন থেকে ক্লাস ফোরে আসতে হবে আমাকে এইটুকু জানিয়ে দিলেন স্যার। পরে জেনেছি, হামিদ স্যার কিছু দিন আগে অবসর নিয়েছেন, তাই অমলেন্দু স্যার দায়িত্বে। বাবাকে পরে একবার এই স্কুলে এসেছিলেন, হামিদ স্যারের শোক সভায় বক্তব্য রাখতে, আমরা তখন ক্লাস টেনে।
ওই এক সাক্ষাৎকার কি ভাইভায় আমি এই স্কুলের ছাত্র। পরের ছয় বছরেরও বেশি সময়ের জন্যে এখানেই আমার গন্তব্য নির্ধারিত হয়ে গেল। ঝড়-বৃষ্টি জল-কাদা উজিয়ে জেলখানা রোড থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ আমার প্রতিদিনের গন্তব্য! স্কুলড্রেস একই, নেভিব্লু প্যান্ট ও সাদা শার্ট- জেলা স্কুলের সঙ্গে এইটুকু মিল বহাল ছিল।
২
ক্লাস ফোরে ক্লাসটিচার ওহাব স্যার; আমরা ডাকতাম ছোটো হুজুর স্যার। (বড়ো হুজুর ছিলেন সম্ভবত রহমান স্যার) প্রথম দিন থেকেই আমার প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর খেয়াল। এমনকি সেই বয়েসে স্কুলের কোনও আচরণ সংশোধযোগ্য হলে স্যাররা তা বলতেন, তার কিছু কিছু বাবার কান পর্যন্ত যেতে সময় লাগত না। তাতে বুঝতে পারতাম, শিক্ষকরা সবাই বাবার বন্ধু ও সহকর্মী স্থানীয়। এমনকি দপ্তরিদের ভিতরে আকবর ভাই, কাশেম ভাই, সামাদ ভাই অফিস সহকারী মজিদ ভাইর চোখেও চিহ্নিত হয়ে থাকতাম। সহপাঠীদের ভিতরে কয়েকজন স্যারদের ছেলে, তাদের যেমন কোনও অন্যায়ে রেয়াত ছিল না, আমারও।
শাহাব স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন, যতদূর মনে পড়ে ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত শাহাব স্যার আমাদের বাংলা পড়িয়েছেন, মাঝে কোনও ক্লাসে অন্য বিষয়। অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখা তাঁর, উচ্চারণ গম্ভীর যেন আকাশবাণীর ঘোষক, আর প্রতিটি বিষয় বর্ণনা করতে বিস্তারিত। আজও সহপাঠীদের কেউ কেউকে বলতে শুনি, তাঁর পড়ানোয় আমি এতটা মুগ্ধ ছিলাম যে, তাঁকে বারবার প্রশ্ন করতাম। সে মুগ্ধতা আজও কাটেনি। মাইকেল মধুসূদনের একটি কিশোরপাঠ্য কবিতার সঙ্গে সাগরদাঁড়ি, মধুকবির জন্মস্থান, বাবার সঙ্গে তাঁর মতান্তর, ইংরেজিতে এঁটে উঠতে না পেরে বাংলায় সাহিত্যচর্চার কথা বলতে বলতে মেঘনাদবধ কাব্য রচনা ও একই সময়ে তিনি কয়েকজনকে যে ডিকটেশন দিতেন- সেই বিষয়টা যেন মাইকেলীয় আচরণের তিনি বলতেন। মীর মশাররফের বিষাদ-সিন্ধু’র কারবালার কাহিনি। কাশেম যুদ্ধে যাবেন। তখন তাঁকে কাকা ইমাম হোসেন বলছেন, এই মুহূর্তে তুমি সখিনাকে বিয়ে করো। বা, কাশেম ফিরে এলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, একটু পানির জন্যে, মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে যতটুকু তৃষ্ণা নিবারণ করা যায়! এখনও শুনি স্যারের গলা, দেখতে পাই তাঁর সৌম্যকান্তি অঙ্গভঙ্গি। আবদুল্লাহ বিন জ্যায়ের একটি তির তখন কাশেমকে আহত করল। দুলদুল তাঁকে পিঠে নিয়ে ফিরে আসছে। শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ ভারি। আজও সেই আবহাওয়া কলমে এসে থমকে দেয়।
কখনও কখনও ক্লাসে আসতেন হাজি স্যার, ছাত্তার স্যারকে আমার হাজি স্যার বলতাম। বয়েসে তখন প্রবীণ। আমাদের ক্লাসে প্রায় পড়াতেই না আক্কেল স্যার। চুপচাপ বসে থাকতেন। তবু স্যারকে নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ ছিল না। নিচু গলা কথা বলা সোলায়মান স্যার আগ্রহ আর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম! মোক্তার স্যারের আন্তরিকতা, শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ববোধ অতুলনীয়। ছাত্রঅন্তপ্রাণ বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন।
ক্লাসটিচার হিসেবে পেয়েছি ওহাব স্যার, মুজিবর স্যার, নওশের স্যার, বারেক স্যার, সুনীল স্যার (দুবার এইট ও টেন), দেবাশীষ স্যারকে। (এখানে জানিয়ে রাখা দরকার, তিরিশ পঁয়তিরিশ বছর বাদে স্যারদের সবার নাম পুরো নাম সঠিকভাবে লেখা সম্ভব হচ্ছে না, তাই তাঁদের মূল নামের সঙ্গে স্যার যুক্ত করে লিখতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত প্রতিটি ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা অসম্ভব, সহপাঠীদের সাহায্য এক্ষেত্রে ভরসা)। শিক্ষকদের ভিতরে নওশের স্যার, মোক্তার স্যার, দবির স্যার, জলিল স্যার, মাহমুদুল হক স্যার- প্রত্যেকেই এইট পর্যন্ত ক্লাস নিয়েছেন। ক্লাস নাইনে পড়াকালীন এসেছিলেন দৌলতুন নাহার, আমাদের একমাত্র ম্যাডাম। তিনি বাংলা পড়াতেন। এর আগে ফাইভে পিটিআই থেকে কয়েকজন (সম্ভবত দুজন) ম্যাডাম এসেছিলেন, তাদের ট্রেনিঙের অংশ হিসেবে।
ক্লাসটিচাররা প্রত্যেকেই যেন প্রকৃত অভিভাবক। স্কুল গণ্ডির ভিতরে, কখনও কখনও বাইরেও কোনও আচরণ অসংলগ্ন হলে ক্লাসরুমে তার ফল পাওয়া যেতন। স্টেডিয়ামে শহরের বড়ো দুদলের খেলায় আবাহনী একটা পেনাল্টি পেয়েছে। আমি অন্যদের সঙ্গে উলটো দিকের গোলপোস্টে থেকে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়ে অন্য দিকের গোলপোস্টের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। পরদিন ক্লাসে শহীদুল্লাহ স্যার খুব ধমকে বলেছিলেন, ভদ্দরলোকের ছেলে খেলার মাঠের মাঝখান দিয়ে দৌড়ায় নাকি? তিনি আমাদের আদব আচরণের দিকে খুব খেয়াল দিতেন।
তখন আবাহনী মোহামেডানের ফুটবলের জোয়ার। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতে আসতেন। আমরাও আবাহনী মোহামেডানে ভাগ হয়ে খেলতাম। ছুটির পরে স্কুলের ভিতরে মাঠে, কখনও বাইরের পাশ্চিমের মাঠে, আর নিজেদের আয়োজনে ‘বড়ো’ কোনও টুর্নামেন্টের বিষয় থাকলে স্কুলের বড়ো মাঠে। বিশাল সেই মাঠ। সেই বয়েসে সবকিছু তুলনা করতে ইচ্ছে হত। কোন মাঠ বড়ো? চেনা চৌহদ্দির মাঠ তো মোটে তিনটে। স্টেডিয়াম, কলেজ মাঠ আর স্কুলের মাঠ। দশানি স্কুলের মাঠের কথা খেয়াল থাকত না। স্কুলের মাঠে খেলতে নামলে মনে হত, কলেজ মাঠ কিংবা স্টেডিয়াম এর চেয়ে ছোটো। ক্লাসের একদল আবাহনী একদল মোহামেডান। কোন কারণে, সেই তিন কাপ কি পাঁচ কাপের খেলায় (কাপ বলতে ছোটো ছোটো গোল লজেন্সভর্তি প্লাস্টিকের মুখ আটকানো পাত্র, ওই লজেন্সগুলো বলতাম টিকটিকির ডিম) দু-পক্ষের ঝগড়া পরে হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হয়ছিল। তখন ক্লাস ফাইভ। খেলা হয়েছিল স্কুলের পশ্চিম পাশের মাঠে। পরদিন সকালে ক্লাসটিচার মুজিবর স্যার এসে জুয়েলকে বললেন বেত আনতে। বেত যেখানে রাখা আছে সেখানে আগেই আতা গাছের ডাল কেটে রেখে এসেছিলেন। তারপর একে একে পুরো ক্লাস, যারা কালকের খেলায় যুক্ত ছিল, প্রত্যেককে পিটিয়ে মেঝেতে শুইয়ে ফেলেছিলেন।
আজও সেকথা সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হলে স্মরণ করি। শাহাব স্যার পাশের জনের সঙ্গে কথা বললে অব্যর্থ নিশানায় ডাস্টার ছুড়ে মারতেন। বারেক স্যার, জহুরুল হক স্যার পড়া না পারলে হাতে মেরেছেন। মাহমুদুল হক স্যারের মারার কায়দা ছিল অদ্ভুত, দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে দাঁড়াতে হত, তিনি পশ্চাৎদেশে মারতেন। একটু উপরের ক্লাসে সুনীল স্যার বার দুয়েক দুই-একজনকে আচ্ছাসে পিটিয়েছেন। যেমন ফররুখ জুয়েল ক্রিকেট-পাগল, সম্ভবত ক্লাস এইটে। দু দেশের টেস্ট চলছে। কুতুব ওর কাছে কার ক্লাস জানতে চেয়েছে। জুয়েল একটু গলা তুলে জানিয়েছে, সুনীল গাভাস্কার আউট! পাশ থেকে যে সুনীল স্যার যাচ্ছিলেন, কিংবা তিনি যে দোতলার সিঁড়ি থেকে নেমে আসতে পারেন, তা নিশ্চয় ওর জানা ছিল না, অথবা, কুতুব স্যারকে বলে দিয়েছে। স্যার জুয়েলকে কাছে পেলেন। গলাটা আঁকরে ধরে প্রথমে চড় তারপর বেত দিয়ে আচ্ছাসে পেটালেন।
তত দিনে বুঝতে শিখেছি আমাদের শিক্ষকদের কেউ কেউ তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়া ছাত্রদের কাউকে কাউকে অনেক বিষয়ে রেয়াত দিতেন। যেমন, একবার নিচের দিকের ক্লাসে, নুরুল হুজুরস্যারের কাছে ইসলাম ধর্ম শিক্ষায় বাড়তি নম্বর পাওয়ার বিষয়টা আমরা জেনে গিয়েছিলাম। একবার সহপাঠীদের একজন শুধু গণিতে, বাকিগুলোয় খুব খারাপ, প্রায় শতাংশ নম্বর পেলে যারপরনাই অবাক হই সবাই। দেখা গেল স্কুলে সদ্য আগত এবং কিছুদিন পরে চলে যাওয়া স্যারের কাছে সে প্রাইভেট পড়ত। এই সবের বাইরে প্রবল নীতিবান শিক্ষক ছিলেন প্রায় সবাই। প্রাইভেট পড়–ক কি ছাত্রটিকে এমনিতে যতই পছন্দ করুক স্যার, কোনও বিষয়ে পান থেকে চুন খসলে, অন্যায্য কিছু দেখলে চেহারা গম্ভীর করে চোখ পাকানো কি গালমন্দ করা কি হাতে বেত তুলে নিতে কোনওভাবেই দেরি করতেন না তাঁরা। তা ছাড়া, বাড়িতে বাবা-মা-বড়োভাইবোনের বাইরে শিক্ষকরাই একমাত্র বা প্রধান অভিভাবক। অভিভাববকরাও তাই মনে করতেন। তাঁদের ছাত্র, যদি কোনও ত্রুটি ঘটিয়ে ফেলি, সেটা স্যারদেরই আগে দেখার কথা, সংশোধনের দায়িত্ব তাঁদের। আচরণ আদব ইত্যাদি পারিবারিক গণ্ডির বাইরে সবটাই শেখার জায়গা স্কুল। অথবা, তখন সমাজের ধারণাটাই এমন ছিল যে, স্কুল শুধু পরীক্ষা পাশের জন্যেই পাঠানো হয় না, সেখানে এই পৃথিবীর পথে চলবার বাকি সব আয়োজনও থাকে।
স্কুলের গাণ্ডি থেকে পাড়ার রাস্তা, যতটুকু স্কুলে আসার পথ, সেই বয়েসে এর বাইরে জাতীয় কি আন্তর্জাতিক রাজনীতি কি সংস্কৃতির প্রায় কিছুই আমাদের ছুঁত না। জগৎ বলতে স্কুল কম্পাউন্ড, পাশের মাঠ, পাড়ার মাঠ আর বন্ধুরা। এর ভিতরে একদিন স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে রাষ্ট্রপতি এরশাদ যাবেন, আমাদের কাজ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে পুষ্পস্নাত করা অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের গায়ে ফুলের পাপড়ি ছোড়া। যারা স্কাউটের সদস্য ছিলাম, তাদের এইসব দিন আর ষোলোই ডিসেম্বর ছাব্বিশে মার্চের আগে ট্রেনিং দিতে আসতেন প্রাক্তন ছাত্ররা। এছাড়া অন্যান্য অনুষ্ঠানের আগেও আসতেন। তারিকভাই সোহাগভাইকে মনে আছে। যাদের উপরের ক্লাসে দেখেছি, তারপর কলেজে চলে গেছেন, তাদের ভিতরে নাহিদভাই, কালুভাই, মুরাদভাই আমাদের স্কাউটিং শেখাতেন। এমনকি যারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম : মহিউদ্দিনভাই, রোমিওভাই-সহ সহপাঠী খালিদ, রাজু-সহ অন্যদের বিতর্ক সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রাক্তন ছাত্রদের কেউ কেউ আসতেন। সেটা এক অর্থে স্কুলের প্রতি তাদের ভালোবাসার নিদর্শন আর একই সঙ্গে স্যারদের ভিতরে যারা এই বিষয়ে এই বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁরাও চাইতেন প্রাক্তন ছাত্ররাই নিক এই দায়িত্ব। এমনকি আমরা স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে যাওয়ার পরে, শিক্ষকদের এমন আহ্বানে স্কুলে গেছি।
স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, আমাদের সময়ে যে কয়েকবার অনুষ্ঠিত হয়েছে, প্রতি বছরই খুব জাঁকজমকের সঙ্গে এর পুরস্কার বিতরণী পালিত হয়েছে। তবে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হত, সেখানে আয়োজনটা প্রায় সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ত। শহরের ভালো ছাত্ররা যেমন এই স্কুলের ছাত্র, বিখ্যাত ও কৃতী ক্রীড়াবিদরাও এই স্কুলের। তুহিনভাই লাহুলভাই সাগরভাই প্রত্যেকেই নিজ-নিজ ক্ষেত্রে জাতীয় ও বিভাগীয় ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, সাগরভাই পরে অনুবাদ হিসেবে খ্যাতিমান। আমরা স্কুলে থাকতেই তুহিনভাই লাহুলভাইকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলতে দেখছি। সাঁতারে মুনির ও মুরাদদা স্কুল পর্যায়ে জাতীয়ভাবে পরিচিত ছিলেন, ডালিমভাই রনিভাই বক্সিঙে, অ্যাথলেটিক্সে মাহবুবভাই, মাহফুজভাই। সহপাঠীদের অনেকেই ভালো ফুটবল খেলত। যেমন : হায়দার, মুনির, রনি।
আমাদের নিয়ে সাংস্কৃতিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার দায়িত্ব পালন করতেন বেশিরভাগ সময়ে শাহাব স্যার আর কিরণ স্যার। শাহাব স্যার শুধু স্কুলের নয়, শহরের অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। কাজী নজরুলের বিখ্যাত ‘সিন্ধু’ দারুণ আবৃত্তি করতেন তুলুভাই। সুকান্তের ‘ছাত্রপত্রে’র আবৃত্তির রোমিওভাইর গলায় ভালো খেলত। আর সহপাঠী সুযশ ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ আবৃত্তি করার সময়ে ‘দিল্লির পতি সে তো কোন ছাড়-’ এমন করে বলত যে আজও শুনতে পাই। স্কুলে সব গানই গাইতেন, তবে ভূপেন হাজারিকার গান খুব ভালো গাইতেন মুরাদভাই। জয়ন্তদা গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত, এক ক্লাস ওপরের মেরাজভাই নজরুল গীতি গাইতেন, সুশান্ত তবলা বাজত, নৃপেন গাইত যে কোনও গান। কেউ কেউ অন্যান্য গান। প্যারোডি গান গাইত কেউ। তুফান-মামুনভাই এতে ওস্তাদ ছিলেন। যেমন তখনকার জনপ্রিয় গানের প্যারোডি : মাইন্ডে মাইন্ডে ইয়োথে লাগল ফায়ার (মনে মনে যৌবনে লাগল আগুন), এই সাইডে আই ওই সাইডে ইউ মিডেলে রিভার ওই বয়ে চলে যায় (এই কূলে আমি ওই কূলে তুমি মাঝখানে নদী), নো টেলিফোন নো পিওন হ্যাভ নো টেলিগ্রাফ (নাই টেলিফোন নাইরে পিওন নাইরে টেলিগ্রাফ) ইত্যাদি। তবে হাস্যকৌতুকে কোনও কোনও ক্লাসের দল আমাদের আনন্দ দিত। আবার চরম দুষ্টামির প্রকাশ ঘটত কখনও কখনও। যেমন তুহিনভাই কালুভাই ধলুভাই জাহাঙ্গীরভাই নহিদভাই লাবলুভাই মিলে টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ ও প্রদর্শনের মহড়া দিচ্ছিলেন। সংবাদ পাঠ করছেন একজন। এভাবে এল গামা ও নাসের ব্লু-র কুস্তি। তার পরে দুই দলে ভাগ হয়ে ধাঁধার আসর। বলা হল, (তখনকার জনপ্রিয় ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানের আদলে) কনচেন দেহি, এতার না বেতারও না, সেতারও না তাইলে কোন তার? একজন বলল, ডাক্তার। এই পর্যন্ত বলার স্যারদের একজন গোটা কৌতুক প্রদর্শনকারী দলের দিকে তেড়ে গেলেন। এর ভিতরে তাদের একজন উত্তর দিলেন, মোক্তার! এই ছিল কৌতুক। স্যারার আগেই বুঝে গেছিলেন উত্তরে মোক্তার স্যারের নাম বলা হবে। বড়োভাইদের দেখাদেখি স্কুলজীবনে এই প্রকার বাঁদরামি কিছু কিছু অবশ্য আমরাও শিখে যেতাম। কখনও কখনও কোনও কোনও স্যারের সঙ্গে তা প্রয়োগ করতাম। কিন্তু ভিতরে প্রবল ভয়ও ছিল।
শিক্ষকরাই তখন জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আমাদের কাছে সবচেয়ে ভীতিকর। জহুরুল হক স্যার, দেবাশীষ স্যার, কিরণ স্যার প্রত্যেকেই আমরা যমের মতো ভয় পেতাম। স্কুল ছুটির পরে এমন কোনও জায়গা দিয়ে যেতাম না, যেখানে আমাদের দেখলে ধমকাতে পারেন। আবার ওই বয়েসে তো অগম্য বলে যে কিছু থাকতে নেই। পিঠের চামড়া মার খেয়ে পুরু। বন্ধুদের কেউ কেউ স্কুলে ও বড়োভাইয়েরা রেল লাইনের ওপারের জমিদার বাড়িতে যেত। একবার আমি আর পীযূষ জমিদার বাড়ির পুকুরের পাড়ের ডালিম গাছে থেকে ডালিম ছিঁড়ে দশানির দিক থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। আবার কুতুব রুহুল ছোট রাজু খালিদ-সহ একবার জমিদার গিয়েছিলাম বাড়ি ঘুরতে। জমিদার কিরণবাবু আমাদের বাঘ শিকারের গল্প বলেছিলেন।
সেই ঘোরতর সামরিক শাসনের কালে, সরকারি স্কুলের চৌহদ্দির ভিতরে কখনও কখনও রাষ্ট্রের কোনও কোনও ফরমান ঢুকে পড়ত। তার সরাসরি কোনও প্রভাব না পড়লেও বড়োভাইদের বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি আর রাস্তার শ্লোগানে বুঝতে পারতাম, দেশের কোথায় কোন কোন অঞ্চলে অস্থিরতা বিরাজমান। স্যারেরা এ প্রসঙ্গে তেমন কিছু বলতেন না, তবে কোথাও কোনও পরিচিত বিষয় ইত্যাদি নিয়ে কোনও বিষয় থাকলে তা নিয়ে কখনও কখনও কথা উঠত। তাতে আমাদের সেই কৈশোরক বুদ্ধি আর অসহায় চোখে যতটুকু যা ধরা পড়ত। এর বেশি কিছু নয়। এই সময়ে মোড়েলগঞ্জ থেকে সতীশ স্যার এসেছিলে, তাঁর ছেলে জগন্নাথ হল দুর্ঘটনায় মারা যান, পড়াতে পড়াতে বইটা টেবিলে রেখে তিনি উদাস হয়ে বাইরে তাকাতেন, তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত।
শিক্ষকদের কেউ কেউ পড়ানোয় ভীষণ আন্তরিক। কেউ কেউ ক্লান্ত, হাউ তুলতেন টিফিনের পরে। এ সময়ে মাহমুদুল হক স্যার হায়দার আরিফ লালন আর মুনির-কে কুস্তি লড়তে বলতেন ক্লাসে; ওরা ক্লাসের ভিতরে সবচেয়ে বলবান। মুনিরকে ডাকতাম গামা মুনির! তবে গরমের দিনে বিকেলের ক্লাসগুলোয় আমরাও ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। দুষ্টামি কমে যেত। মাহমুদুল হক স্যার আমাকে গল্প বলার জন্যে ডেকে নিতেন। আর দুজন স্যারও একাজ করেছেন। আমি ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প বলতাম, আটকে গেলে তখনই তৈরি করে নিতাম কাহিনি। শুক্রবারে মনিং স্কুল হলে সেদিন বাড়তি আনন্দ। শনিবার পাঁচ পিরিয়ড, শেষে বই দেওয়া হত। রবিবার ছুটি, পরে শুক্রবারে। ফাইভে কি সিক্সে নজরুলের ব্যথার দান হাতে নিলে শাহাব স্যার শুধু বলেছিলেন, উ হু! অর্থাৎ এটা নিতে পারবে না। বই দেওয়ার বষিয়টা উপরের ক্লাসে উঠতে উঠতে অনিয়মিত হতে থাকে। পরে দেশ থেকেই বিষয়টা উঠে গেছে প্রায়। ধীরে ধীরে স্কুলগুলো মুখস্থবিদ্যার উজ্জ্বল সন্তানের ভারে মুখর হয়ে ওঠার সেই ছিল সূচনাকাল, এখন বিদ্যালয় আর এই ভার বইতে পারছে না, সেটার দায়িত্ব নিয়েছে কোচিং সেন্টার!
প্রাইভেট আমাদের সমেয় একেবারে দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসেনি। ক্লাসে স্যাররা চাপ্টার ধরে পড়াতেন, বুঝিও দিতেন। তারপরও ইংরেজি আর গণিত পদার্থ-রসায়ন-জীববিদ্যা হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি প্রাইভেট পড়তে হত, কিন্তু তা কোনওভাবেই সারা বছরব্যাপী নয়। তবে, ‘ভালো’ ছাত্র দুই-একজন বাদ দিলে বাকিরা অন্য বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী ছিল। শ্রেণিপাঠ্য বইয়ের বাইরে কারও কারও পড়াশোনার বহর ভালো ছিল, একটু উপরের ক্লাসে উঠলে সপ্তাহে অন্তত এক-দুই দিন ম্যাকফার্সন লাইব্রেরিতে যেত; দুই-একজনের ছাড়া বাকিদের ভালো ছাত্রত্ব কোনও জাহির করার বিষয় ছিল না।
প্রাইভেট পড়া ছাত্ররা কোনও কোনও শিক্ষকের কাছে একটু বেশি প্রশ্রয় পেতেন এটা যেমন সত্যি, বাকিরা সব ছাত্রকেই সমান চোখে দেখতেন। এখানে জেলার প্রধান সরকারি কর্মকর্তাদের ছেলেরা পড়ত। স্যারদের কাউকেই তাদের কারও জন্যে ক্লাসরুমে আলাদা আচরণ করতে দেখিনি। বরং, একটু গরিব অসহায় কিন্তু ভালো ছাত্রের প্রতি দুই-একজন স্যারের আচরণ আজও স্মরণযোগ্য।
জহুরুল হক স্যার নিচের ক্লাসে ইতিহাস পড়াতেন; উপরের ক্লাসে ইংরেজি। সর্বদাই পড়ানোর বিষয়ে তিনি ভীষণ কড়া। খুব আকর্ষণীয় আর সহজ করে বোঝাতেন। তার ভয়ে পড়ে আসতাম। স্যার ক্লাসে ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা মনে পড়ে না। পোশাকে খুব রুচিবান। তাঁর ছেলে সহপাঠী জুয়েলকে সে কথা বলতাম আমরা; জানতাম, স্যারের ডাকনাম বাদশা! উলটো দবির স্যারের ক্লাসে পড়ায় ফাঁকি দিয়েছি, আবার মারও খেয়েছি। দবির স্যার বেলি কেডস পরতেন গোড়ালির ওপর ওঠানো পাজামা আর গাঢ় রঙের পাঞ্জাবির সঙ্গে। আমাদের কেউ কেউ ক্লাসের মেঝেতে পা ঠুকে শব্দ করত, স্যারের পায়ে কেডস দেখে। স্যার বলতেন, দোমাইসনে দোমাইসে। বারেক স্যার সেভেনে গণিত পড়াতেন, পরে জীববিজ্ঞান; আন্তরিক আনন্দের সঙ্গে পড়াতেন, প্রচুর হেসেছি তার ক্লাসে আমরা। অনেককেই ডাকতেন বাবার পেশার সঙ্গে পো যুক্ত করে বরিশালের আদলে। যেমন আসাদকে ডাকতেন, ডাক্তারের পো; প্রিন্সকে প্রিন্সিপালের পো। সংস্কৃত পড়াতেন অমর পাল, ডাকতাম পণ্ডিত স্যার। আমি তার বিশ্বজিৎ তার ক্লাসে প্রচুর দুষ্টুমি করতাম। একামাত্র তিনিই ধুতি পরে আসতেন। বিমল স্যারও পড়াতেন সনাতন ধর্ম শিক্ষা, তাকেও ডাকতাম ছোটো পণ্ডিত স্যার।
সুবলকৃষ্ণ দে, যখন ক্লাস টেনে পড়ি সুবলকান্তি মণ্ডল নামে গণিতের স্যার যোগ দেয়ায় তিনি হলেন বড়ো সুবল স্যার, নতুন জন ছোটো সুবল স্যার। বড়ো সুবল স্যার পোশাকে বেশ সুচারু, মাথায় গান্ধি টুপি পরতেন, আর তাঁর পড়ানো ভীষণ রস ছিল। যেমন, ‘লণ্ডন দেখেছো? এই যে এখানে, বাড়ির কাছেই!’ বলেই দেওয়ালে টাঙানো ম্যাপে আঙুল তুলতেন। সুলতান স্যার বেশিদিন ছিলেন না। বিভিন্ন প্রসঙ্গে খুব হাসাতেন আমাদের। সে তুলনায় কিরণ স্যার, গণিতের বিভিন্ন নিয়ে ইত্যাদি শেখাতেন প্রায় টোলের মতো করে, যেন এইভাবে বললে গোটা বিষয়টা আমাদের মুখস্থ থাকবে। তরুণ স্যার অঙ্ক করাতেন। একটি অধ্যায়ের যেগুলো কঠিন মন হতে পারে, সেগুলো দ্রুত ব্ল্যাকবোর্ডে করে দিতেন। ছোট সুবল স্যার যখন এলেন, তখন আমরা একেবারের উপরের দিকে। টেনে নাইন-টেনে ইংরেজি প্রথম পত্র পড়িয়েছেন সুনীল স্যার, দ্বিতীয় পত্র জহুরুল হক স্যার। গণিত ও রসায়ন বিদ্যা পড়াতেন দেবাশীষ স্যার, বিজ্ঞানের জটিল বিষয় খুব সহজ করে বলতেন, কখন গল্পের মতো করে। বারেক স্যার চলে গেছেন, প্রাণিবিদ্যার ক্লাস কে নিয়েছেন মনে নেই, হতে পারে সে ক্লাস নিয়েছেন অরুণ স্যার। অরুণ স্যার কথা বলতেন খুব নিচু গলায়। দৌলতুন নাহার ম্যাডাম, একদিন ক্লাসে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের খাতা দেখতে দেখতে বলেছিলেন, বাবাজিরা বাংলাটা একটু ভালো করে শেখো। যা লেখো এ দিয়ে কোনও মা জননীকে চিঠি লিখলে সে পড়ে কিছু উদ্ধার করতে পারবে না।
চতুর্থ শ্রেণি থেকে এখানে পড়ায়, প্রায় আবাল্য স্যারদের আচরণের সঙ্গে পরিচিত। বদলি হতে তারা, তবে যারা আসতেন তাঁরাও বেশি দিন থাকতেন না, চলে যেতেন। শহীদুল্লাহ স্যার আমাদের শরীরচর্চা শিক্ষক, সেভেনের দিকে তিনি বদলি হন, তার জায়গায় খুলনা জেলা স্কুল থেকে আসেন শাহজাহান স্যার। তখন প্রধান শিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন একই প্রতিষ্ঠান থেকে আসা জনাব হাবিবুর রহমান। এই দুজন আমার দুই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক। এমন আর কখনও আমার ছাত্রজীবনে ঘটেনি। সেভেনে এইটে হেডস্যার এসেছিলেন সৈয়দ নুরুল হক আর ক্লাসে টেনে ওঠার পরে জনাব এনামুল হক খান। শেষজন দারুণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন, দূর থেকে দেখেই আমরা ভয়ে কাবু হতাম। এছাড়া শিক্ষকদের আসা যাওয়া তেমন ছিল না। বাগেরহাট দেশের প্রান্তে, পাশেই বড়ো শহর খুলনা, প্রথম পোস্টিং আর সাময়িক বদলিজনিত বিষয় ছাড়া এখানে সাধারণ এমন ঘটনা খুব ঘটত না। বারেক স্যার পিরোজপুর চলে গিয়েছিলেন, তাঁর ছেলে আমাদের সহপাঠী শাহজাহান, তাকে হারালাম। এটা ঘটত। সরকারি অন্যান্য অফিসের কাজে যারা আসতেন, তাদের বদলিজনিত কারণে আমাদের পাশের বেঞ্চি খালি হত। ক্লাসের দরুণ মানিকজোড় বন্ধু হতে হতে হঠাৎ পাশের বেঞ্চির একজন নেই হয়ে যেত। শামীম, সুলতান মাহমুদ, প্রিন্স, বিশ্বজিৎ, রাজু, শাহজাহান কিংবা রাজীব এই মুহূর্তে এই কয়েজনের নাম মনে পড়ছে। আর একটি বিষয় ছিল, নীরব দেশত্যাগ। হঠাৎ পাশের বেঞ্চি থেকে অথবা নিজের বেঞ্চি থেকে অথবা পিছনের বেঞ্চি থেকে নেই হয়ে যেত একজন। ও আর ক্লাসে আসছে না। যেমন : পীযূষ, মদন, কর (পদবি, নামটা মনে নেই), কানাই একদিন হঠাৎ আর ক্লাসে আসেনি। সেই বয়েসে খুব তাড়াতাড়ি সব মেনে নেওয়া যায় যেন, স্মৃতির পুরনো বলে প্রায় কিছুই থাকে না। ফলে, কাউকে খুঁজতে যাইনি আমরা, একদিন দুই দিন স্যার তার রোল ডেকে তারপর তাও বাদ দিয়েছেন, একদিন কেটে দিয়েছেন, আমরাও ফাঁকা জায়গাটা অজানতেই পূরণ করেছি, আর একদিন সেই বন্ধু-সহপাঠীকে ভুলে গেছি।
৩
শুধু ভোলা যায়নি, ভোলা যাবে না ও-সেপড এই স্কুলটাকে। যার পাশ দিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সংক্ষিপ্ততম রেলপথের ধীর গতির গাড়ি যাওয়ার সময় স্যারেরা পড়ানো বন্ধ করতেন। কিরণস্যারকে বলেছিলাম, স্যার রেল লাইন সারায়ে নিলেই হয়। স্যার বলেছিলেন, তার চেয়ে স্কুল সরানোয় সরকারের খরচ কম। এই স্কুল তার সমস্ত অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের স্মৃতি বহমান থাকবে। থাকবে মাঝখানে ছোটো মাঠ, ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডের সামনে এসমব্লিতে দাঁড়ানো, এর কোনায় পুকুরের ঘটলার পাশে শুয়ে থাকা ফাউন্ডার হেডস্যার মোকাদ্দেস হোসেন, যেন পাহারা দিচ্ছেন তাঁর স্কুল। থাকবেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী। আর হারানো বন্ধু অকালপ্রয়াত বন্ধু-সহপাঠীরা।
জুয়েল আসাদ ছোট (মাহমুদ) লালন মোনায়েম মনির রাজু মুক্তি (মাহমুদ) মাহফুজ মোস্তাফিজ খালিদ জুয়েল (ফররুখ) গোপাল জয় সুযশ কানাই মদন প্রিন্স শান্ত রুহুল পীযূষ কুতুব ফয়েজ শিকুর মাজেদ মনির মিজান আরিফ রনি সুলতান টগর (প্রায় কখনওই স্কুলে অনুপস্থিত থাকত না ও) তুষার তমাল শাহমুল শাহনেওয়াজ লনি মাহিউদ্দিন হাসিব মুনির হায়দার আসাদ মোর্শেদ রফিক মোরশেদ জাবির জাকির বিরাজ এমদাদ-সহ এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে আসছে না, সবাই। এমনই প্রতিটি ক্লাসের। তারা প্রত্যেকেই এখানে পড়ার স্মৃতি সারাজীবন বয়ে বেড়াবে। অপ্রাপ্তি নেই এর দেয়ালে, কেননা কোনও দীর্ঘশ্বাসের ভার স্কুলকে বহন করতে হয় না, আছে যা তা অতীতের দিকে তাকালেই আনন্দ দেয়। সবকিছু মিলে মিশে সেই স্মৃতি আজীবন জাগরুক থাকবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক; প্রাক্তন ছাত্র, বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। চতুর্থ থেকে দশম (১৯৮১-৮৭), ১৯৮৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী।
প্রাণের মাঝে আয়…