ইনজামামুল হক | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বাগেরহাট, সুন্দরবন ঘেষা দেশের দক্ষিণের জনপদ। কেবল সুন্দরবনই নয়, ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর’ হিসেবেও সুখ্যাতি এ জেলার।
দেশে-বিদেশে বাগেরহাটের পরিচিতি ‘ষাটগম্বুজ মসজিদে’র শহর হিসেবেও।
ঐতিহাসিকদের মতে, ষাটগম্বুজ কেবল মসজিদ নয়। হযরত খানজাহান (রহ.) এর নির্মিত ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটি মসজিদের পাশাপাশি ব্যবহৃত হতো তাঁর প্রতিষ্ঠিত শহর খলিফাতাবাদের দরবার হল হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস প্রকাশিত বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি ঐতিহাসিক শহরের তালিকায় রয়েছে এ ‘খলিফাতাবাদ’ শহরের নাম। ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট’ হিসেবে খানজাহানের নির্মিত খলিফাতাবাদ শহরের টিকে থাকা নিদর্শনগুলোকে ১৯৮৫ সালে ‘সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইউনেস্কো।
বাগেরহাটের আরেক গর্ব সুন্দরবন। কেবল বাঘের জন্যই নয়, নদী বেষ্টিত এ বনে কুমির, হরিণসহ হাজারও প্রাণের বাস। জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভার সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত।
সেই হিসেবে, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা – ইউনেস্কো (UNESCO) প্রকাশিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় বাংলাদেশের যে তিনটি স্থানের নাম রয়েছে তার দুটির অবস্থানই এ জেলায়।
প্রাকৃতিকভাবে দুর্যোগ প্রবন এলাকা হিসেবে পরিচিত উপকূলীয় এ জেলার সবুজ বেষ্টনিও বলা হয় সুন্দরবনকে। এক সময় পুরো বাগেরহাট অঞ্চল ছিল সুন্দরবনের অংশ।
সম্প্রতি সরকার বাগেরহাটকে ব্র্যান্ডিং করেছে ‘সবুজ বাগেরহাট, সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার’ হিসেবে।
ধারণা করা হয়, অনার্য অর্থাৎ ভারত বর্ষের লোক এসে এ অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় আলপাইনরা আসে এ অঞ্চলে। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারত উপমহাদেশের আদিমতম অধিবাসীরা বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেন।
প্রাচীন এই জনপদে বৈদ্ধ্য সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে ইতিপূর্বে। বৈদ্ধ্য সভ্যতার কথা উল্লেখ আছে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থেও। ধারণা করা হয় ১২শ’-১৩শ’ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে বৈদ্ধ্য সভ্যতা ছিলো। পরর্তিতে বিকাশ ঘটে হিন্দু সভ্যতার।
খ্রিষ্টীয় ১৫শ’ শতকে সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে হয়রত খানজাহান (রহ.) নামে পরিচিত ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ খানজাহান এখানে খলিফাতাবাদ নগরের রাজধানী স্থাপন করেন। ষাটগম্বুজ এবং খানজাহানের এ খলিফাতাবাদকে কেন্দ্র করে বর্তমান শহর বাগেরহাটের গোড়াপত্তন।
ইংরেজদের অধিকারে আসার পর পুরো ভারত বর্ষের সাথে এই অঞ্চলও যায় ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে; পরে ব্রিটিশ শাসনে। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিসের শাসন আমলে যশোরকে (বর্তমান – যশোর) জেলায় পরিণত করা হয়। আজকের বাগেরহাট তখন ছিলো দেশের প্রাচীন এই জেলার অন্তর্গত।
১৮৪২ সালে খুলনা যশোর জেলার একটি মহকুমা হয়। তখন বাগেরহাট খুলনা মহকুমার অন্তর্গত একটি থানা। বাগেরহাট থানার অন্তরগত ‘মোরেলগঞ্জ’ নামক স্থানে ১৮৪৯ সালে মোরেল উপাধিধারী ইংরেজরা একটি বন্দর স্থাপন করেন। এর পর থেকেই মূলত প্রশাসনিক ভাবে বৃটিশ শাসকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয় বাগেরহাট।
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ নভেম্বর ‘মোরেল-রহিমুল্লাহ’ নামক এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (নীল বিদ্রোহ) হয় মোরেলগঞ্জে। সে সময় সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। এর পর প্রশাসনিক প্রয়োজনে বাগেরহাটে একটি মহকুমা স্থাপন করার সুপারিশ করেন তিনি।
এ সুপারিশের সূত্রে ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট যশোর জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমায় রূপান্তরিত হয়। ১৮৮২ সালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় খুলনা জেলা।
আর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জেলার মর্যাদা পায় বাগেরহাট।
ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ জেলা সমৃদ্ধ প্রত্নতত্ত্ব, নদী, প্রকৃতি ও কৃষিতে। বাগেরহাটের কবি আবু বকর সিদ্দিক এ জেলা নিয়ে লিখেছেন ‘‘সুন্দরবনে বাঘের বাস/ দড়াটানা ভৈরব পাশ/সবুজে শ্যামলে ভরা/নদীর বাঁকে বসতো যে হাট/-তার নাম বাগেরহাট।’’
বর্তমানে বাগেরহাটে ৯টি উপজেলা, ৩টি পৌরসভা ও ৭৫টি ইউনিয়ন। রয়েছে একটি সমুদ্র বন্দর ও একটি ইপিজেড।
১৯৫০ সালের পহেলা ডিসেম্বর জেলার মংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর। মংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে মংলা উপজেলা জুড়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প কারখানা।
১৯৫৮ সালে ১ এপ্রিল শহর বাগেরহাট পৌরসভা হয়। স্বাধীনতাত্তোরকালে সারাদেশের সঙ্গে বাগেরহাটও এগিয়েছে অনেকখানি। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় এ জেলা এখনও এগোয়নি।
বিনিয়োগের অভাবে সেই অর্থে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি সমৃদ্ধ জেলা বাগেরহাটের। হয়নি তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। বন, পরিবেশ, প্রত্নতত্ত্বকে বাঁচিয়ে রেখে শিল্পে সমৃদ্ধির জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিকল্পনা।
এক সময়ে দেশের রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে রেল যোগাযোগ নেই বাগেরহাটে। তবে আশার কথা মংলা-খুলনা রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। পদ্মা নদীতে নির্মাণ হচ্ছে সেতু। যা মংলা বন্দরকে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কৃষি, শিল্প, পর্যটন, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য ভরা বাগেরহাট এখন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। যোগাযোগ ও জ্বালনি খাতে পিছিয়ে থাক বাগেরহাটের এখন জেগে ওঠার সময়।
২৩ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট জেলা প্রতিষ্ঠার ৩৪ বছর। নীল বিদ্রোহ, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতিটি ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আজকের বাগেরহাটের নবযাত্রার সময় এখনই। প্রত্যাশা, সমৃদ্ধ বাগেরহাট হবে আগামীর বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জেলা।
এইচ/এসআই/বিআই/২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭/আপডেট ২০১৮
** ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাগেরহাট
** যেভাবে বাগেরহাট নামকরণ