সরদার ইনজামামুল হক | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে জাল দলিল করে এক ব্যক্তির জমি বিক্রিতে মধ্যস্থতা করার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে জমির মালিক তার পৈত্রিক জমি রক্ষায় বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া ইউনিয়নের মনিজিলা গ্রামের প্রয়াত বসন্ত মণ্ডলের ছেলে ভঞ্জণ মণ্ডল গত বুধবার (২৫ জানুয়ারি) জাল দলিল করে জমি নিয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পেতে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি আবেদন করেন।
লিখিত আবেদনে ভঞ্জণ মণ্ডল উল্লেখ করেন, চার-পাঁচ দিন আগে লোক মারফত জানতে পারি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোল্লাহাট, বাগেরহাটের মাধ্যমে একটি সংঘবদ্ধ দালাদ চক্র আমার (মুনিজিলা মৌজার হাল দাগ নং- ১৭৮৯, ১৭৯০) জমি বিক্রির জন্য দলিল প্রস্তুত করেছে। এমতবস্থায় আমার ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যের মাধ্যমে নির্বাহী অফিসার তার সাথে দেখা করতে বলেন। এ খবরে আমি ভীতসম্ভ্রস্ত হয়ে পড়ি এবং আত্বীয় স্বজনদে বলি।
“এর মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে ইউএনও স্যার আমার বাড়ি এসে প্রশ্ন করেন আপনি নাকি জমি বিক্রি করবেন? আমি উত্তরে বলি বিক্রি করব না এবং এ ব্যাপারে আমি কারো সাথে কোন আলোচনাও কারিনি।”
এর পর ইউএনও স্যার আমার ভোটার আইডি কার্ড (NID) ও ছবি চায় আমি। আমি এগুলো দেওয়ার পর ইউএনও স্যার ওনার মোবইলে ভোটার আইডি কার্ড ও ছবির ছবি তুলে নিয়ে যান।
লিখিত অভিযোগে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, আমার ভোটার আইডি কার্ড ও ছবি দিয়ে জাল দালিল হয়েছে কি না, সে জন্য আমি এবং আমার পরিবার এবং স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খুবই শঙ্কিত ও চিন্তিত।
ভঞ্জণ মণ্ডলের ওই আবেদনের সূত্র ধরে মুনিজিলা গ্রামে যায় বাগেরহাট ইনফো ডটকম। বাগেরহাট-মাওয়া মহাসড়কে মোল্লাহাট উপজেলার জয়ডিহি মোড়ে নেমে ডানের পিচ ঢালা পথ। এই পথে সামান্য এগিয়ে গেলে ডান দিকে গেছে একটি মেঠো পথ, এই পথেই যেতে হবে ভঞ্জন মণ্ডলের বাড়ি। মেঠো পথ ধরে কিছু দূর হেটে যেতে গ্রামের একটি পুকুর ঘাটে কয়েক জনের আলোচনায় থমকে দাড়াই।
দুপুরে গোসল করতে আসা গ্রামের লোকেরা কথা বলছে ভঞ্জণ মণ্ডলের বাড়ি গভীর রাতে ইউএনও আসার বিষয়ে। এক জন আর একজনকে বলছে, ‘শুনেছেন নাকি সেদিন ইউএনও স্যার আসছিলো জাল দলিল নিয়ে।’
কথার বিষয় বস্তু শুনে বুঝতে পারি তারা নিশ্চই ঘটনাটি জানেন। পুকুর ঘাটে কথা হয় গ্রামের রঞ্জণ কুমার মণ্ডলের সঙ্গে তিনি চিনিয়ে দেন প্রতিবেশি ভঞ্জণ মণ্ডদের বাড়ি।
ইউএনও’র আসর বিষয়ে কি যেন বলছিলেন, কি কোন জমি বিক্রি হয়েছে কি? এমন প্রশ্নে প্রথম তিনি তেমন কিছু বলতে রাজি নহনি। পরে তিনি বলেন, ওই রাতে গ্রামের কালি মন্দিরে একটি অনুষ্ঠান ছিলো। আমরা সবাই সেখানেই ছিলাম। মামাও (ভঞ্জণ মণ্ডল) মন্দিরেরই ছিলেন।
রাত ১০টার দিকে গাড়ির শব্দ শুনে মামা উঠে আসে। রাতে আমরা আর কিছু জানতে পারি নি। পরে সকালে এসে জানতে পরি টিএনও (ইউএনও) সাহেব এসে মামার ছবি নিছে, আইডেন্টি কার্ডে ছবি নিছে। আসলে আমরা হিন্দু মানুষ, এই নিয়ে কথা বলতে ভয় পাই।
বাড়িতে গিয়ে তারা জেলা প্রশাসকের কাছে করা আবেদনের বিষয়ে কথা হয় ভঞ্জন মণ্ডদের সাথে। বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, আমার জমি ইউএনও স্যারের মাধ্যমে জাল দালিল হচ্ছে শুনার পর থেকে আমি ভীতসম্ভ্রস্ত হয়ে পড়ি। এর মাঝে সারভেয়ার একদিন আমার বাড়ি এসে জিঞ্জেস করে আপনি কি হাইওয়ের পাশের জমি বিক্রি করতিছেন নাকি। এতে আমার ভয় আরও বাড়ে। ইউএনও স্যারও ২৪ তারিখ মেম্বারের মাধ্যমে আমাকে তার অফিসে ডাকেন। আমার শরীর কিছুটা অসুস্থ থাকায় ওই দিন আমি যেকে পারি নি।
কিন্তু রাতেই ইউএনও আমাদের বাড়িতে আসেন। এসময় আমাদের এলাকার মেম্বর, সারভেয়ার, চকিদার, বাবলা ও হাসমত নামের দুই ব্যক্তিসহ আরও কয়েকজন ইউএনও স্যারের সাথে ছিলেন।
বাড়িতে তাদের বসতে দিলে স্যার আমাকে বাইরে ডেকে এনে জিঞ্জাস করে তুমি কি জমি বিক্রি করবা। তখন আমি তাকে বলি, স্যার আমি জমি বিক্রি করবনা। আর আমি কারো কাছে বিক্রির কথা বলিও নি।
তখন স্যারের সথে থাকা বাবালা তার পকেট থেকে একটি দলিল বের করে। দলিলে এক ব্যক্তির ছবি পাশে কিছুটা তার মত দেখতে অস্পষ্ট একটি ছবি লাগানো ছিলো। ওই ছবিটা আমার কি না তা জানতে চাইলে আমি বলি এটি আমার ছবি না। পরে দলিলটা স্যারের সঙ্গে থাকা বাবলা তার পকেটে রেখে দেয়।
এর পর তারা আমার ছবি ও আডি কার্ডের ছবি তুলে নেয়। এর পর থেকে আমি বেশি পরিমানে ভয় পাচ্ছি। তারা ওই ছবি আর আইডি কার্ড দিয়ে জমির জাল দালিল করেছে কিনা তা আমি জানিনা।
ওই দিন রাতে ইউএনও’র সঙ্গে ভঞ্জণ মণ্ডলের বাড়িতে আসা এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, শুনেছি হাড়িদা গ্রামের হাসমত নামে এক দালাল ভুল বুঝিতে ভঞ্জনের ৩ বিঘা জমি ইউএনও স্যারের মাধ্যমে এক সচিব স্যারের কাছে বিক্রি করেছে। তারা ওই জমি খুলনায় দালিল করতে যায়। সেখানে হাসমত একজনকে ভঞ্জণ হিসাবে নিয়ে যায় জমিটি রেজিস্ট্রি করতে। কিন্তু ইউএনও স্যারের কাছে ধরা পড়ে যে জমি বিক্রি করতে আসছে সে অর্জিনাল ভঞ্জণ না।
হাসমতের নেতৃত্বে ওই চক্র ইউএনও স্যারের কাছ থেকে জমি বিক্রির জন্য অগ্রীম ৫ লাখ টাকা নেয়।
জাল দালিলে জমি বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে কোদালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ড সদস্য মো. আকাশ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বাগেরহাট-মাওয়া মহাসড়কের পাশে জমির মূল্য বেশি হওয়ায় স্থানীয় একটি চক্র অনেক দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার হিন্দুসম্প্রদায়ের জমি জাল করে বিক্রির চেষ্টা করে আসছে। এর আগেও এই এলাকায় হিন্দুদের একটি জমি জাল করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। হাড়িদা গ্রামের যুগল বাবুর ভাই হিমাংস গাছির জমি জাল করে বিক্রির ওই ঘটনায় বর্তমানে একটি মামলা চলমান আছে।
অব্যহত এধরনের ঘটনার কারণে এই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন যেন এই দালাল চক্রের হাত থেকে বাঁচতে পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টাদের প্রতি দাবি জানান এই জনপ্রতিনিধি।
এ ব্যাপারে মোল্লাহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ শামীম হাসান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমার এক পরিচিত ব্যক্তি ওই জমিটি কিনতে চেয়েছিলেন। পরে আমি জানতে পারি জমির মালিক ভঞ্জণ ওই বিক্রি করবে না। বিষয়টি জানতে পেরে যারা জমি বেচা-কেনা করছিলেন আমি তাদেরকে বলি বিক্রির সময় আমি কিন্তু থাকব। তখন তারা আমাকে একটি ছবি ও আইডি কার্ড দেখিয়েছিলেন। পরে বিষয়টি যাচাই করতে ওই মালিকের বাড়িতে যাই।
তিনি দাবি কারেন, আমি ছবি নিয়েছিলাম বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার জন্য। উনি হয়তো ভাবছেন কি ব্যাপার আমার ছবি নিলো কেন।
এই এলাকায় আগেও এই ধরণের ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। হিন্দুদের জমি জাল করে একটি চক্র বিক্রি করে। তাই বিষয়টি জানাতে পারে আমি ছবি ও আইডি কার্ড মিলিয়ে তা প্রতিরোধ করেছি।
এ বিষয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে আইনানুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ওই ব্যক্তিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরণের আইনি সহায়তা দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
এইচ/এসআই/বিআই/০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭