– জেসমিন মলি
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাত। বাংলাদেশের উপকূলীয় ১১ জেলায় আঘাত হানে ২৪০ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিঝড় সিডর। ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারান সাড়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষ, আহত হন আরও অন্তত অর্ধলাখ।
এক রাতেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হাজার হাজার ঘরবাড়ি। প্রলয়ঙ্করী এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রত্যক্ষদর্শী আক্রান্ত অঞ্চলের শিশুরা। দুঃসহ স্মৃতির কারণে মানসিক ব্যাধি নিয়ে বড় হচ্ছে এসব শিশুর একটি অংশ।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পটুয়াখালী, বরগুনা পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলায় সিডর-পরবর্তী সময়ে বেড়ে ওঠা পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের ৪৮ শতাংশই কোনো না কোনো ধরনের মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।
‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী শিশু ও কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব’ সম্পর্কে জানতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও কুমিল্লার ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চিকিৎকদের একটি দল উপকূলের শিশুদের ওপর এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
বাগেরহাটের বাসিন্দা তারেক হাসান। সিডরের সময় তার বয়স ছিল ১১ বছর। ভয়ঙ্কর এ ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সারা দিন ঝড়-বৃষ্টি ছিল। উপকূল এলাকায় বাড়ি হওয়ায় এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত ছিলাম। সারা দিন কিছু মনে হয়নি। তবে রাতে ঝড়ের প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। আমাদের বাড়ির সব ভেসে গিয়েছিল। মা-বাবা আর ছোট বোন নিয়ে আমরা ঘরের চালা ধরে সারা রাত দাঁড়িয়ে ছিলাম।
সিডরের আঘাত থেকে আমরা কোনো রকম প্রাণে বাঁচলেও আমাদের সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। বই-খাতা সব ভেসে গিয়েছিল। বিড়ালটিকে আর পাওয়া যায়নি। সারা দিন আমি আর আমার বোন প্রিয় জিনিসগুলোর জন্য কান্নাকাটি করতাম। পড়াশোনায়ও গ্যাপ পড়ে যায়। এখনো আকাশে মেঘ করলে ও বৃষ্টি হলেই আমার মনে হয় আবার সেই রাত ফিরে আসছে। এটি এক ধরনের ঘোরের মতো হয়ে গেছে, ব্যাপারটি থেকে এখনো বের হতে পারিনি।
গবেষণার জন্য পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় হেলথ ক্যাম্প এবং পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলায় কমিউনিটি সার্ভের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। চারটি ভিন্ন ভিন্ন এলাকার পাঁচ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১৫৮ শিশুর ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্তের হার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে এ হার ৫০ শতাংশ। আর ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্তের হার ৫৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
সামগ্রিকভাবে মানুষের যেসব আচরণ মানসিক অসংলগ্নতার আওতায় পড়ে তা হলো— যেকোনো ধরনের অসামঞ্জস্য, অসংলগ্ন আবেগ, হাইপারকাইনেসিস, আচরণগত ও বিকাশের অসংলগ্নতা। গবেষণায় দেখা গেছে, সিডর আক্রান্ত এলাকায় শিশুদের মধ্যে এগুলোর হার যথাক্রমে ৮১, ৭৩ দশমিক ৪১, শূন্য দশমিক ৬৩, ৩ দশমিক ১৬ ও ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরে মানসিক রোগে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ ছেলে ও ৪৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ মেয়ে। সামগ্রিকভাবে এগুলোর মাধ্যমে আইসিডি-১০ সাইকিয়াট্রিক ডিসঅর্ডার প্রকাশ করা হয়েছে।
গ্রাম, শহর ও বস্তিতে বসবাসরত শিশু-কিশোরদের মানসিক অবস্থা নির্ণয়ে ২০০৫ সালের অন্য একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ শতাংশ শিশু মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানার পর তার প্রভাব পরবর্তী বংশধরদের মধ্যেও স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারে, যা এ গবেষণায় উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়েছে, সিডর-পরবর্তী এক থেকে চার মাস পর্যন্ত সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরা উচ্চমাত্রায় মানসিক সমস্যা ও ভারসাম্যহীনতায় ভোগে।
এ বিষয়ে গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ঝুনু শামসুন নাহার বলেন, প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট বড় ধরনের দুর্যোগের পর সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের ওপর ভীতি ও আশঙ্কার প্রভাব রয়ে যায়। শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে এটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এজন্য দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার অভিযানে একই সঙ্গে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়েও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া পরবর্তী সময়ে যাতে শিশুদের মনে এর প্রভাব দীর্ঘায়িত না হয়, সেজন্য কাউন্সেলিং ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া উচিত।
শিশুর এ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সময়ে শিশুদের ওপর এর প্রভাবের বিষয়টি। এছাড়া পারিবারিক ও সংশ্লিষ্ট এলাকার ক্ষতির পরিমাণ এবং দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধারকাজের ওপরও এটি নির্ভরশীল। এ ধরনের দুর্যোগে শারীরিক ক্ষতি হলে, দীর্ঘমেয়াদে তার প্রভাবে শিশুদের মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের সমন্বিত ও সামগ্রিক সুস্থতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া উচিত বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, পেশাদার মনোচিকিত্সকের মাধ্যমে এ চিকিৎসা দিতে হবে। এজন্য জরুরি বহুমাত্রিক (মাল্টিডিসিপ্লিনারি) দল গঠন করা যেতে পারে। এটির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে পারে সরকারি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পরিচিত পরিবেশ ওলটপালট হয়ে যায়। অনেক সময় প্রিয় মানুষ হারানোর মতো ঘটনাও ঘটে। বিশেষ করে শিশুদের খেলার সামগ্রী, সঙ্গী হারিয়ে যায়। প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনার ছাপ রেখে যায় তাদের মানসিক বৃদ্ধিতে। ফলে শিশুদের মধ্যে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসায় এসব শিশুকে স্বাভাবিক করে তোলা সম্ভব।
বণিক বার্তা প্রতিবেদন/এসআই/বিআই/১৭ নভেম্বর, ২০১৬
⇒ কাজের খোঁজে উপকূলে বাড়ছে শহরমুখীতা
⇒ সিডরের ৯ বছরেও হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ
⇒ উপকূলের বিভীষিকা সিডর !