সুব্রত কুমার মুখার্জী | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
আজ ২৩ অক্টোবর ২০১৬। ৮ কার্তিক ১৪২৩ বঙ্গাব্দ, রোববার। বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমনের জন্মদিন।
১৯২১ সালের ২৩ অক্টোবর নরসিংদী জেলার রায়পুরায় পাড়াতলী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন কবি। পিতা মুখলেসুর রহমান ও মাতা আমেনা বেগমের ১৩ সন্তানের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান চতুর্থ।
শামসুর রাহমান বলা হয় তিনি ছিলেন একজন নাগরিক কবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা খুবই জনপ্রিয়।
১৯৪৫ সালে পুরাতন ঢাকার পেগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করা কবি। এর পর ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে আই.এ পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে এখান থেকে পরীক্ষা দেওয়া হয় নাই। পরে পাসকোর্সে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ করেন।
১৯৫৭ সালে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায় কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন রেডিও পাকিস্তানে। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও থাকার পর আবার ফিরে যান তার পুরানো কর্মস্থল দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ, দায়িত্ব পালন করেন সহযোগী সম্পাদক হিসেবে।
১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে সরকারি দৈনিক পাকিস্তান-এর সহকারি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতা পরবর্তি ১৯৭৭ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার সঙ্গে। ১৯৮৭ সালে সামরিক শাসনামলে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়।
শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছন্দনাম নিয়েছেন তিনি যেগুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক।
শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান -এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীত পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন।
১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইযুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি।
১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন ‘আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে’ নামক কবিতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে।
এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন।
১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমণ্ডুক মৌলবাদীরা। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়।
তার কাব্যগ্রন্থ- ৬৬টি, অনুবাদ – ৬, উপন্যাস- ৪, প্রবন্ধগ্রন্থ- ১ ও ছড়ার বই- ১।
ব্যক্তি জীবনে ১৯৫৫ সালের ৮ই জুলাই শামসুর রাহমান জোহরা বেগমকে বিয়ে করেন। কবির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তাদের নাম সুমায়রা আমিন, ফাইয়াজ রাহমান, ফাওজিয়া সাবেরিন, ওয়াহিদুর রাহমান মতিন ও শেবা রাহমান।
কবি শামসুর ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬ টা ৩৫ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎধীন অবস্থায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে নিজ মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
এইচ/এসআই/বিআই/২৩ অক্টোবর, ২০১৬
কবি মোহাম্মদ রফিকের ৭৩তম জন্মদিন