সুপ্রিয় সুধী,
প্রায় এক বছর আটমাস আগে যেদিন আমাকে এই জেলায় পদায়ন করা হয়, সত্যি বলতে কি ‘প্রশাসক’ হিসেবে আমি বাগেরহাটে আসিনি। আমি এইখানে এসেছিলাম আপনাদের একজন ‘সেবক’ হয়ে। আমার বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক। গ্রামের সাধারণ একটা পরিবারে আমার বেড়ে উঠা। আমার শিক্ষক পিতার আদর্শকে বুকে ধরে আমি বাগেরহাটের সাধারণ জনগণকে আমার পরিবারের অংশ ভেবেছি।
আমার চিন্তায়, চেতনায় কায়মনোবাক্যে আপনাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না। আপনারা আমার ব্যর্থতাকে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
দীর্ঘ এই দায়িত্ব পালনে অনেকের প্রতি রুঢ় আচরণ করতে হয়েছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অনেকের প্রতি কঠোর হতে হয়েছে। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে আমাকে এই পথে হাঁটতে হয়েছে। দিনশেষে বাসায় ফিরে বালিশে মাথা রেখে ব্যক্তি জাহাংগীর আলম আপনাদের সমবেদনায় কতটা কাতর ছিল তা আপনাদের অগোচরেই রয়ে গেছে। একজন সহকর্মীর ডিসপোজাল অর্ডারে সাইন করা কতটা বেদনার তা আমি আপনাদের বোঝাতে পারব না। আপনারা আমার অপরাগতাকে ক্ষমা করবেন। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না।
আপনারা আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। আমার সন্তানদের জন্য দোয়া করবেন। আর আমার জন্য দোয়া করবেন যেন একজন মানুষ হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে পারি। অমানুষের মরণ আমি প্রচন্ড ঘৃণা করি।
ডিসি হিসেবে বাগেরহাট আমার পোস্টিং।মানুষের প্রথম প্রেমের মতই প্রথম পোস্টিং ভুলে যাওয়ার মত নয়। বাগেরহাট সে কারণে আমার মনের মণিকোঠায় অম্লান হয়ে থাকবে। তাই বিদায় দিয়ে আপনারা আমাকে যেভাবে পর করে দিচ্ছেন আমি আপনাদেরকে ততটা পর করছি না। আমি আপনাদেরই একজন হয়ে থাকতে চাই।
‘আমার নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমাদেরই লোক’
রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের শেষাংশ দিয়ে আজকের বক্তব্য শেষ করতে চাচ্ছি। পোস্টমাস্টারের গ্রাম হতে বিদায় নেওয়ার মুহুর্তটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এইভাবে-
‘যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন— একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, ‘ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি’— কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে— এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’
আজকে আমি যেন সেই বিদায়ী পোস্টমাস্টার।
অব্যাহত সহযোগিতার জন্য আপনারা আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। আপনারা হয়ত জানেন এখান হতে দায়িত্ব হস্তান্তরের পর আমি কুমিল্লার জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করব। কুমিল্লার মত একটি সুপ্রাচীন জেলার দায়িত্ব প্রদান করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার উপর যে আস্থা রেখেছেন তার যেন যোগ্য প্রতিদান দিতে পারি সে জন্য দোয়া করবেন।
সবাই ভাল থাকবেন।
– মো. জাহাংগীর আলম, জেলা প্রশাসক (ডিসি), বাগেরহাট।
(উপজেলা প্রশাসন এবং বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস, বাগেরহাট জেলা শাখা কর্তৃক আয়োজিত জেলা প্রশাসক মো. জাহাংগীর আলম-কে দেওয়া বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্যের অনুলিখন। জেলা প্রশাসন, বাগেরহাটের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে ….)
এসআইএইচ/বিআই/১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬