• এ এইচ ইরফান উদ্দিন আহমেদ
শেষবার যখন খালি পায়ে কাঁদায় হেঁটে সাড়া গায়ে মাখামাখি হয়ে বাসায় ফিরেছিলাম, আম্মা মেরেছিলেন খুব। কাঁদা মাখামাখি করার জন্য না, পড়া ফাঁকি দিয়ে খেলতে যাওয়ার জন্য। প্রায় ১৮ বছর আগের কথা। এই দীর্ঘ সময় পর আবার কাঁদায় মাখামাখি হলাম। খালি পায়ে কাঁদায় হাঁটলাম দু দফায় প্রায় ৩ কিলোমিটার।
সকালে যখন মোবাইল কোর্ট এর উদ্দেশ্য নিয়ে বাসা থেকে বের হই তখনই মেঘের দল ধরণী কাঁপিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। গন্তব্য ছিলো রামপাল।
সমাজের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের প্রবল প্রতাপে দেয়া বাঁধগুলো অপসারণ করে খাল উন্মুক্ত করতে হবে। বাঁধ অপসারণ করা নিয়ে মারামারি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। তাই মোবাইল কোর্ট নিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে উপস্থিত থাকেন। সমস্ত কার্যক্রম তদারকি করার পাশাপাশি পুরো দলের নেতৃত্বে থাকেন তিনি।
বাঁধ দেয়ার কারণে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিক গতিপথে নেমে যেতে পারছে না। জনসাধারণের বাড়িঘর জলাবদ্ধতায় ডুবে গিয়েছে। খাল দিয়ে পানি নামিয়ে দেয়াই একমাত্র উপায় এখন জীবন বাঁচানোর। মনুষ্যত্ব বাঁচানোর।
মিশন শুরু হলো সকাল ৯.০৭ মিনিটে। সন্ধ্যা ৬ টায় যখন বাসায় ফিরলাম তখন মাথাটা যেকোনো সময় ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছিলো। সারাদিন বৃষ্টি আর রৌদ্রের খেলার ক্লান্ত আমি এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বৃষ্টির পানিতে পুরোপুরি ভিজেছি এবং শুঁকিয়েছি। দিনশেষে ফলাফল দিয়ে বিবেচনা করলে নিজের কাছে সন্তুষ্ট। এক দিনের কাজে মোটামুটি বৃহৎ দুটো বাঁধ সম্পূর্ণ উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছে।
–
এই ৯ ঘণ্টায় এমন রাস্তায় হেঁটেছি যেখানে প্রতি পদক্ষেপে পা পিছলে যায়। শেষ পর্যন্ত লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটেছি। নৌকা নিয়ে খালের পানিতে গিয়েছি এক স্পট থেকে অন্য স্পটে। ভ্যান গাড়িতে করে পাড়ি দিয়েছি গ্রামের মেঠো পথ। বাঁশের সাঁকো পাড় হয়েছি কাঁপা পায়ে। প্যান্টের পকেট পর্যন্ত লাগা কাঁদা শুঁকিয়ে শক্ত হয়েছে। তবুও এগিয়েছি।
কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত একটানা চলেছি। যারা ধরে নিয়েছিলো তাদের দেয়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাঁধগুলো কখনো অপসারণ করা যাবে না, তাদের ধারণা ভেঙে গুঁড়িয়ে এসেছি।
জলাবদ্ধতায় কষ্ট পাওয়া অসহায় মানুষগুলো যখন কথা বলছিলো তখন তাদের চোখের কোণায় চিকচিক করা পানির কণা মনে প্রশান্তি দিয়েছে। সমস্ত আশা হারিয়ে কতোটা নিরুপায় তারা ছিলো তা প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি শব্দে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।
এটা আমার দেশ। এরা আমার মানুষ। এদের জন্য কাঁদা পানিতে কেন, প্রয়োজনে গলা পানিতে নেমে অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াই করবো। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এসেছিলো। এবার আমাদের হাত ধরে দুর্নীতি অনিয়ম দূরীভূত হবে।