দেশের প্রধান কৃষি ফসল ধান। নিকট অতীতেও চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ আমদানি করতো প্রধান এই খাদ্য শস্য (ধান-চাল)। কিন্তু মাঠে কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে কেটেছে আমদানি নির্ভরাতা। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসল উৎপাদন করলেও ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকেরা। ফলে ধান চাষে হতাশা বাড়ছে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের কৃষকদের।
বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বারুইখালী গ্রামের নিবাস চন্দ্র সাহা (৫৩)। পৈত্রিক পেশা কৃষিকে আকড়ে ধরে আছেন এখনও। কৃষি মানে তার কাছে ‘ধান’ চাষ। চলতি মৌসুমে নিজের এবং প্রতিবেশীর কাছ থেকে নিয়ে মোট দুই একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন তিনি।
তার হিসেবে, একর প্রতি ধান উৎপাদনে বীজ, সার, সেচ, কৃষি শ্রমিকসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। যে হিসাবে নাই তার নিজের এবং স্ত্রী সন্তানের পরিশ্রমের আর্থিক মূল্য।
নিবাস চন্দ্রের ভাষায়, ‘গায় খাটা শ্রমের তো হিসাবই নেই; নগদ টাকায় লিজ নেওয়া প্রতিবেশীর এক একর জমির জন্য দিতে হয়েছে আরও ৪ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এক একর জমিতে ধানের উৎপাদান খরচ প্রায় ১৪ হাজার টাকা।’
সেই জমি থেকে ধানের উৎপাদন হয়েছে ২৭ মনের কিছু বেশি।
তিনি জানান, চলতি বছরে তাদের এলাকায় ব্রি-২৮ জাতের একমণ ধানের সর্বোচ্চ মূল্য ছিলো ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা। বছরে নিজের যোগান রেখে ৫৮০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করেছেন তিনি।
সে হিসাবে নিজেদের শ্রমের মজুরি বাদে এক একর জমি থেকে নিবাস চন্দ্র পেয়েছেন ১৫ হাজার ৬৬০ টাকা। যাতে লাভ হয় মাত্র (১৫,৬৬০- ১৩,৫০০) ২ হাজার ১৬০ টাকা।
কৃষক নিবাস চন্দ্রের স্ত্রী রিতা রানী সাহা বলেন, ‘ধানের যে বাজার তাতে কোন লাভ আস না। কৃষক হিসাবে একটু জমি আছে, দু’টো গরু-বাছুর আছে তার জন্য এখনও ধান চাষ করা হয়।’
ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে রিতা রানীর মতো হতাশ জেলার অধিকাংশ কৃষক। বাগেরহাটের কৃষি প্রধান এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশি ভাগ কৃষকেরই ফসল তোলা শেষ। হাতে গোনা দুই একজন কৃষকের এখনও মাঠে ধান আছে।
তবে অধিকাংশ কৃষক ধান শুকিয়ে বিক্রিও করে ফেলেছেন। এখন লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন তারা।
কচুয়া সদরের কৃষক কঙ্কজ সাহা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, জাত ভেদে এবার সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা পর্যন্ত মণ দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। যাতে কৃষকের উৎপাদন খরচও ওঠেনা। অন্য সব ফসলের চেয়ে ধানের দাম এখন কম।
‘৫ বছর আগেও আমরা এক মণ ভজন ধান বিক্রি করছি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। আর সেই ধান এখন চারশ সাড়ে চারশ টাকায় বিক্রি করতে হয়। সব কিছুর দামই বাড়তি। ধানের দাম কমলি কৃষক বাঁচবে কী করে,’ প্রশ্ন তার।
উপকূলীয় এলাকার এই কৃষক বলেন, ‘ধানে আমাগো লাভ নেই। তাই অনেকেই জমি-ক্ষ্যাত কমায় দিছে। কৃষি কাজ ছেড়ে এখন ব্যবসা ধরছে, ভ্যান-রিকশা চালাচ্ছে। জমি না চষে রিকশা চালানাও তো লাভ!
চিতলমারী উপজেলার চরবানিয়ারী গ্রামের কৃষক মোজাফফর হুসাইন বলেন, সরকার নাকি ন্যায্য মূল্যে ধন-চাল কিনে শুনেছি। ২৮ বছর ধরে কৃষি কাজ করলেও কোনো দিন সরকারের কাছে ধান বেচতে পারিনি। সরকার ধান কেনে লিডারদের (নেতা) কাছ থেকে, মিল-ফরিয়াদের কাছ থেকে। কৃষক কখনই দাম পায় না। আমরা আর চাষ করতে চাই না।
‘হাইব্রিড, ব্রি-২৮, আলোড়ন, ভজনসহ বিভিন্ন জাতের ধান লাগালেও এবার ফলন গত বারের চেয়ে কম। শেষ দিকে এসে ধানে চিটা হইছে বেশি। আর দামও কম,’ পাশে বসেই বেশ হতাশ সুরে বলছিলেন এই গ্রামের বিলাস সাহা।
তার ভাষায়, সরকার যে সুযোগ দেয় তা চাষিরা পায় না। নেতারা চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে নেয়। তারাই সরকারকে বিক্রি করে, সুযোগ-সুবিধা পায়।
বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, এই মৌসুমে জেলায় ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫১ হাজার ৮১৭ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৫১ হাজার ১৬০ হেক্টরে। গেল বছরে (২০১৪-২০১৫) আবাদ হয় ৫০ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি।
জেলায় সবচেয়ে বেশি ধান আবাদ হয়েছে চিতলমারী উপজেলায়, যার পরিমাণ ১১ হাজার ৬৩০ হেক্টর। আর মংলা উপজেলা বোরোর কোনো আবাদই হয়নি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, সরকার নির্ধারিত ২৩ টাকা কেজি দরে কৃষক সরাসরি ধান বিক্রি করতে পারলে তারা কিছুটা লাভবান হতো। আগেই কম মূলে অনেক কৃষক ধান বিক্রি করে ফেলেছে।