কদিন ধরেই আমরা খুব উত্তেজিত ছিলাম। তুমি প্রথম তোমার পিতার বাস্তুভিটায় যাচ্ছ। তোমার দাদু আর দাদাভাইও দারুণ উত্তেজিত। নানারকম আয়োজনের পরিকল্পনা তারা করছে। আত্মীয় স্বজন সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে। ধোয়া মোছা হচ্ছে। চলছে গৃহপ্রবেশের তোড়জোড়। এই প্রথম সুযোগ এসেছে আমার গ্রামে থাকা কাছের, দূরের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, শৈশবের বন্ধুদের সাথে তোমার সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হবার। যেদিন ঢাকা থেকে তোমাকে নিয়ে আমাদের রওয়ানা দেবার কথা, তার ঠিক দুদিন আগেই খবরটা এলো। বজ্রাঘাত! তোমার মনো ফুপু মারা গেছেন।
মনো দিদি আমার চাচাতো বোন। আমরা চাচাতো ভাইবোনেরা একসঙ্গে এক ঘরে মানুষ হয়েছি। একে অপরকে আপন ভাইবোন গণ্য করেছি। এখনো করি। তোমার দাদু বাড়িতে আমরা ছিলাম যৌথ পরিবার। বলতে পার এখনো আছি। যদিও এখন ভাইবোনদের আলাদা আলাদা পরিবার। জনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তাই হয়ত আলাদা বাড়িতে থাকা হয়। কিন্তু সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা না হওয়ায় এবং আয়ের উৎস বহুলাংশে অভিন্ন থাকায় আমরা যৌথ পরিবারই বটে। এই যৌথ পরিবার ব্যাপারটা আজকাল আর খুব একটা দেখা যায় না। আমার খুব ইচ্ছা তুমি আমাদের এই বৃহৎ পরিবারের সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখো। সবার সুখে দুখে পাশে থাকো। ইন্টারনেট-ফেসবুক বাস্তবতায় সেটা তোমার জন্য কতটা সহজ হবে জানিনা।
টেলিফোনে তোমার দাদু যখন আমাকে মনো দিদির মৃত্যু সংবাদ দেয়, তখন মুহূর্তের মধ্যে আমার জগৎটা থেমে যায়। মা সম্ভবত টেলিফোনে আমাকে আরো কিছু বলছিল। কিন্তু কিছুই আমার কানে প্রবেশ করেনি। মুহূর্তের এক ফ্ল্যাশব্যাক আমাকে নিয়ে যায় ত্রিশ বছর পেছনে।
আমি নিজেকে আবিষ্কার করি বিরাট এক কাঠের বাড়িতে। বাড়ির তিনদিকে টিনের চাল। একদিকে শেওলা ধরা লাল টালি। সেই টালি-অলা চালের পাশে একটা বিরাট আম গাছ। বড় বড় ফজলি আম তাতে। জোর বাতাসে টুপটুপ করে পাকা আম পড়ছে। আর পট পট করে ফাটছে পুরনো পচে ওঠা টালি। একটু বাদে আবার দেখতে পাই ফজলি আমের গোঁড়ায় থাকা বকুল গাছটাকে। বিরাট লম্বা বকুল গাছটির ডগা গিয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। নিচে পড়ে আছে অযুত ফুল। যেন সোনালী রঙের সুগন্ধি কার্পেট। ভোরবেলা বাসিমুখে সেই বকুল ফুল কুড়িয়ে আনছি আমি আর তানি। তানি আমার প্রায় সমবয়সী ভাগ্নি। ছোটবেলার খেলার সাথী। উপচে ওঠা বকুল ফুলের ডালি সামনে নিয়ে মালা গাঁথছে শানু দিদি। সেই মালায় সাজানো হবে ড্রেসিং টেবিলের আয়না, ঘরের জানালা। সুবাস ভেসে বেড়াবে সারাটা ঘরজুড়ে।
আমাদের বাড়িটায় ছিল অনেকগুলো ঘর। মাঝখানে বিরাট একটা ঘর। এই ঘরকে ঘিরে চারিদিকে গোটা দশের কুঠুরি। মধ্যিখানের ঘরটার নাম বড় ঘর। ওই ঘরের অর্ধেক জোড়া এক বিরাট খাট। ওয়াল টু ওয়াল। চারপাশে রেলিং দেয়া। সামনে একটা সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় খাটের উপর। আমরা সব ভাই-বোনেরা আর ভাগ্নে-ভাগ্নিরা আট-দশজন ওই খাটের উপর ঘুমাই, খেলি। এক কোনায় কয়েকটা জং ধরা তোরঙ্গ। আরেক কোনায় একটা দরজা-অলা বিরাট কাঠের বাক্স। দরজা খুললেই বেরিয়ে আসে একটা বিশাল সাদাকালো ফিলিপস টেলিভিশন। তারপরও অনেক জায়গা থাকে খাটে। এই খাটটি আমার কাছে পৃথিবীর প্রিয়তম জায়গা।
আমার শৈশবের সেই কাঠের বাড়ি এখন আর নেই। এক ভয়াল রাতে সিডর ঝড়ের আঘাতে মাটিতে মিশে যায় দাদার আমলের সেই পুরনো কাঠের বাড়ি। সেই ‘পোতা’য় এখন মুরগির খামার করেছে মর্জিনা ভাবী।
একের পর এক দৃশ্য সরে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে দিয়ে। এবার দেখলাম ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টি পতনের শব্দ যেন গিটার আর ড্রামসে ওয়ারফেজের জ্যামিং। আমরা বড় খাটে সব ভাইবোন কাঁথা মুড়ি দিয়ে সেই কনসার্ট শুনছি আর আর গরম গরম চালভাজা খাচ্ছি। মাঝে মাঝে কাঁচা রসুনের কোয়ায় কামড় দিয়ে নিচ্ছি ঝাল ঝাল সালাদের ফ্লেভার। ফাটা টালি হয়ে ‘হাপালের’ কাঠ চুইয়ে এখানে সেখানে পড়ছে বৃষ্টির পানি। পানি পড়ে মাটির মেঝে কাদা কাদা হয়ে উঠছে। বড় চাচি হাড়ি বালতি নিয়ে ছোটাছুটি করছেন যেখান থেকে পানি চোয়াচ্ছে সেই বরাবর নিচে পেতে রাখার জন্য। পশ্চিমঘরে ‘বু’ সুর করে খনার বচন আওড়াচ্ছেন, ‘শনির সাত, মঙ্গলের তিন, বুধে বুধে আষ্ট’। শনিবারে বৃষ্টি শুরু হলে সাতদিন টানা চলবে, মঙ্গলে শুরু হলে চলবে টানা তিনদিন, আর বুধবার শুরু হলে সেই বৃষ্টি থামবে পরের বুধবার। বু হলো দাদী। একটু পর নিজেদের আবিষ্কার করি উঠোনে ছোটাছুটি করে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছি। তারপর পুকুরে ঝাপাঝাপি। পুকুরে ডুব দিলে বৃষ্টির কনসার্ট বদলে যায়। এবার ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা। এমনও দিন গেছে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করেছি সকালে, সেখান থেকে পুকুরে, বিকেলে মা পিটিয়ে পুকুর থেকে তুলেছে। কিন্তু জ্বর-সর্দি হয়নি কখনো। তোমার মায়ের ভাষায় জলের কুমির। তোমারও দেখি পানি অনেক পছন্দ। আগে বেসিনের সামনে দাঁড়ালে তুমি অবাক নয়নে ট্যাপ থেকে পানি পড়া দেখতে। আজকাল ট্যাপের তলায় হাত ঢুকিয়ে ভিজিয়ে নাও আর খিলখিল করে হাস। হবে নাকি জলের কুমির?
আরেক দৃশ্যে দেখছি, সন্ধেবেলা ‘হোগলা’র পাটি বিছিয়ে সুর করে নামতা মুখস্থ করছি। সামনে চেরাগ জ্বলছে। চেরাগ হলো কেরোসিনের কুপি। কাচের কিংবা পিতলের বোতলে ঢোকানো ‘কেরেছ ত্যাল’। বোতলের মুখে লাগানো সরু ধাতব নলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে কাপড়ের সলতে। সলতের মাথায় আগুন। এই চেরাগ আর হ্যারিকেন ছিল আমাদের সন্ধের আলোর উৎস। চেরাগ একটু উঁচুতে রাখার জন্য আছে ‘দেউলগা’। দেউলগা হল কাঠের পিলসুজ বা স্ট্যান্ড। কখনো কখনো বাজার থেকে ভাড়ায় আসে হ্যাজাক। এটাও কেরোসিনের হারিকেন, কিন্তু একেবারে ফ্লুরোসেন্ট আলো দেয়। মাঝে মাঝে শুধু পাম্প করতে হয় এটাকে। হ্যাজাক যেদিন আসে, সেদিন মাছ কোপাতে যাওয়া হয়। মাছ কোপানো মানে রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে গভীর রাত পর্যন্ত কোচ আর হ্যাজাক নিয়ে ‘ডরে’ ঘোরাঘুরি। ডর হলো নিচু ধানক্ষেত বা বিল। আর কোচ হলো একটা লাঠির মাথায় অনেকগুলো ধারাল লোহার কাঁটা লাগানো বর্শা। কামরুল নানা অন্ধকারে সা-ঝাঁক করে ছুঁড়ে দিত হাতের কোচ। যখন হাতল ধরে টেনে তুলতো তখন তাতে গাঁথা থাকতো বোয়াল মাছ।
এরকম কতক্ষণ চোখের সামনে দৃশ্য ভাসত জানিনা, কিন্তু তোমার মায়ের উদ্বিগ্ন প্রশ্নে সাড়া দিতেই হলো। তাকে মনো দিদির মৃত্যুসংবাদ জানালাম। সিদ্ধান্ত হলো, যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি যাব। পরদিন ভোরবেলায় যখন ঢাকা থেকে রওয়ানা দিলাম, তখন দেখা গেল, তোমার বিছানা বালিশ, তোমার মায়ের ঘরে পড়ার পোশাক ইত্যকার নানা জরুরি জিনিস নিতে ভুলে গেছি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধে নাগাদ দাদু বাড়িতে পৌঁছলে তুমি। তোমার যেদিন গৃহপ্রবেশ হল, তার আগের দিনই চিরবিদায় নিলো বাড়ির আরেক কন্যা। যে ভালবেসে ঘর ছেড়েছিল পাশের বাড়ির কনককান্তি ছেলেটির হাত ধরে। অতি অল্প বয়সের এই প্রেমের খেসারত যাকে দিতে হল সারাজীবন ধরে। সংসার সামলাতে গিয়ে নিজেকে সে তিলে তিলে নি:শ্বেস করে দিল। তোমার জন্মের আগে এবং পরে কতবার টেলিফোন করে তোমার আর তোমার মায়ের খোঁজ নিয়েছে মনো দিদি, তার ইয়ত্তা নেই। তোমাকে দেখবার বড় শখ ছিল তার। যদি তোমাদের দেখা হতো, তাহলে দেখতে, এই মানুষটির ভুবন ভোলানো মুক্তোঝরা হাসি। যে তোমার পিতাকে কখনো নাম ধরে ডাকেনি। তার কাছে আমি ছিলাম আরু ভাই, ভাইডি, আলু ভর্তা, সোনাভাই আরো কত কি। আমারও শেষ দেখাটা হল না তার সাথে।
১লা মার্চ, ২০১৬
পুনশ্চ: গ্রামের বাড়িতে তোমার আকিকা করেছেন তোমার দাদাভাই। আকিকা অনুযায়ী ‘আরিয়া তানিয়া হোসেন’ এখন তোমার কাগুজে নাম। আর ডাক নাম ‘প্রেরণা’। আশা করি এখন সবাই তোমাকে প্রেরণা নামেই ডাকবে।