• সুব্রত কুমার মুখার্জী
ভৈরব-এর পাশের অংশের নাম দড়াটানা। স্থানীয় বয়স্করা বলে এ নদীটা নাকি কাটা। এক কালে খাল ছিল। পুটি মারির নোনা পানির স্রোতে নদী হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলে খানজাহান (রহ:) সর্বশেষ যুদ্ধ করেছিলেন ফতেপুরে সেখানে আসার জন্য এই নদী দড়ি টানা নৌকায় পার হয়েছিলেন এজন্য নাম হয়েছে দড়াটানা। এই দড়াটানা নদীর কূল ঘেষে আদর্শগ্রাম।
সরকার ভূমিহীনদের বসবাস করার জন্য নদীর চরে জায়গা দিয়েছে। শুধু জায়গা নয় মাথার গোজার জন্য পাকা ঘরও করে দিয়েছে। তারপর আর খোজ নেই। যারা ঘর পেয়েছিল অনেকেই চিটাগাঙে গার্মেন্টেসে চলে গেছে। প্রত্যেক বছর কেউ না কেউ লোনের তাড়নায় গ্রাম ছাড়ে। গ্রামটি তৈরী করার সময় সরকার গ্রাম মাতব্বর তৈরী করে ছিলো।
মাতব্বর এখন সর্দার। মাটি কাটার সর্দার। গ্রামে ডাক পড়ে যখন কোন পরিবার পালায়। তখন এনজিও স্যারেরা এসে ভয় দেয় সব টাকা দিতে হবে না হলে পুলিশ আসবে। দুই একবার যে পুলিশ আসেনি তাও নয়। গ্রামের এক পাশে জায়গা পেয়েছিল একটি হিন্দু পরিবার। বাবা মারা যাওয়ার পর বৃদ্ধ অন্ধ মায়ের সংসারের হাল ধরে কৃষ্ণ। কৃষ্ণ স্থানীয় সাইনবোর্ড বাজারে দোকানে কর্মচারীর কাজ শুরু করে। কাজ করতে করতে এক সময় সে কিছু টাকা নিয়ে নিজে দোকান দেয়। দোকান খুব ভাল চলছিল। সন্ধ্যা হলে এনজিও স্যারেরা কৃষ্ণর দোকানের সামনে চা খায়।
কৃষ্ণ একের পর এক দুটো মটর সাইকেল কেনে। লোকে বলে কোন এক মেয়ের প্রেমে পড়ে কৃষ্ণ, তাকে পাওয়ার জন্য কৃষ্ণ দেউলিয়া। কৃষ্ণর নামে এখন আদালতে কেচ। কৃষ্ণ নাকি এনজিও টাকা শোধের জন্য চেক দিয়েছিল। সেই হিসাবে টাকা না থাকায় কৃষ্ণকে থানার পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। মাতব্বর জানে কৃষ্ণ যখন টাকা নিয়েছিল তখনই সে চেক দিয়েছিল। এনজিও বেড়া জালে কৃষ্ণ একদিন দড়াটানা নদীতে ভেসে উঠল। আবার পুলিশ আসল। কত জেরা। মনে হচ্ছে যেন কৃষ্ণকে তারাই মেরেছে।
পুলিশ আসা বাদেও মাতব্বরের ডাক পড়ে যদি কখনও কোন বাড়িতে কেউ ছেলে দেখতে আসে বা মেয়ে দেখতে আসে। আনন্দহীন জীবনে যদি কোন বাড়িতে বিয়ে লাগে তাহলে একটু আনন্দ আসে। যদিওবা সকলকে দাওয়াত করতে পারে না। তবে আদর্শ গ্রামের সবাই ঐ দিন তাদের অফিস ঘরের সামনে নিজেদের বাড়ির খাবার নিয়ে এসে খায়। মাঝে মাঝে এনজিও স্যারেরা এসে কত কথা বলেন। তাদের দিয়ে নাকি অনেক কিছু করা সম্ভব। আল্লাহ তাদের বানানর সময় কিছু দেয়নি আর স্যারেরা। কিছু দিনের মধ্যে আর স্যারেদের দেখা যায় না।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের মুখে একটা কথা শোনে মাতব্বর “রাত পোহালে কিস্তি”। কথাটার অর্থ বুঝতে না পারলেও এটা বোঝে কিস্তি দিতে কি অবস্থা হয়।
গ্রামের আরেক পাশে কুডুর সংসার। যার সারা সপ্তাহে ৬ দিনই কিস্তি। সকাল হতে না হতে কুডুর বউ কারুর না কারুর ঘরের সামনে টাকা হাওলাতের জন্য। এরই মধ্যে পাশের কলেজ থেকে কয়েকটি ছেলে মেয়ে এসেছিল। তাদের বিশ্বাস করেছিল মাতব্বর। তাদের দেখান স্বপ্নে মাতব্বর স্বপ্ন দেখ ছিল। গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াবে। ডাক্তার দেখবে। দ্বিতীয় গলির মারুফের মায় মরন শয্যায় ছটফটকরছে তবুও মরছেনা, তাকে বলে ভাল করা যাবে। কিছু দিন যেতে না যেতে আর আসে না।
মাঝে মাঝে বিচার করতে বসলেও কেউ মানতে চায় না। হাশেম তেলীর ছেলে লতি ভালবাসে পাশের গলির মনি শিকদের মেয়েকে। মনি শিকদারের দাদা ফজলু শিকদার নাকি কোন এক গ্রামের মেম্বর ছিল। ফজলু মেম্বরের ভয়ে নাকি এলাকার বাঘে মোষে এক ঘাটে পানি খেত। মাতব্বর বুঝতে পারে বাঘে মহিষে পানি না খেলেও মানুষ ঠিকই খেত। এলাকার লোক কোন কিছু সই করাতে আসলে ফজলু মেম্বর নাকি বলত তার সিল সই অমলের কাছে। অমল ছিল ফজলু মেম্বরের ডান হাত। সেই ফজলু মেম্বরের মেয়েকে বিয়ে করবে হাশেম তেলীর ছেলে। দুই বাড়ি থেকেই মাঝে মাঝেদা, শাবল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে। ছেলে-মেয়ে দুইজনে দুইজনকে ভালবাসে। শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যান আসল। সবাই মিলে ঠিক করল বিয়ে হবে। বিচারের শেষে কাজীকে ঢেকে বিয়ে দেওয়া হল।
হাশেম তেলীর বউ মানতে রাজী হলেও হাশেম তেলী ছেলের বউকে ঘরে নেবে না। মনি শিকদার জামাইকে মানতে রাজী হলেও মনি শিকদারের বউ মেনে নেবে না। তাই সবাই মিলে নদীর পাশে আর এক খানা ঘর বানানর সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক হল দুই পরিবার কিছু টাকা দেবে। বাদ বাকি টাকা চেয়ারম্যান সাহেব দিবেন।
মাতব্বরের সামনে একদিন হাশেম তেলী তার বউ পৃথিবী ছাড়ল, মনি শিকদারও পৃথিবী ছাড়ল। এখন মনি শিকদারের বউ বেঁচে আছে। মাতব্বরও বুড়ো হয়েছে। চোখে দেখে না। মাতব্বরের ছেলে এখন মাতব্বর; আবার বিচারও করে। কানে না শুনলেও মাতব্বর বিচারে যায়। গ্রামের বিচারে যত দিন জীবিত আছে ততদিন যাবে। তবে এখন আর তার সময়ের মত বিচার হয় না। কেউ মানতে চায় না। সবাই এখন বড় লোক হয়েছে। গ্রামে কারেন্ট এসেছে। বাড়ি বাড়ি টিভি চলে। তাদেরও ঘরেও টিভি চলে। অফিস ঘরে অনেক লোক। লতি নাকি তার বোনকে বিয়ে করেছে। অন্যরা সবাই পৃথিবী ছাড়লেও মনির বউ আছে। হাশেম তেলীর সাথে তার নাকি অবৈধ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্কের ফসল তাদের মেয়ে। এইজন্য তারা বিয়েতে আপত্তি করেছিল।
বুড়ি মনির বউ কথা বলতে পারে না, চোখেও দেখে না। বিচার সভা দোষী স্বাবস্থ্য করে গ্রাম থেকে বের করে দিল। আর লতি তার বউকে তালাক দিবে। পরের দিন সকাল হতেই আবার পুলিশ। মনির বউ নাকি অফিস ঘরের সামনে মরে পড়ে আছে। মাতব্বর ঘর থেকে বের হয়না।
লেখক : ব্লগ মডারেটর, বাগেরহাট ইনফো ডটকম।