এখন কিছুটা সুস্থ নাজমা। হাসপাতাল কর্তিপক্ষও চাইছে তাকে রিলিজ দিয়ে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবেন নাজমা? তা জানেন না তিনি নিজেও।
শুক্রবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় নাজমার থাকে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। দীর্ঘ আলাপ চারিতায় নাজমার কন্ঠে ফুটে উঠেছে তার সন্তানের ভবিশ্যৎ ভাবনা। সেই সাথে সংগ্রামী জীবনের অসমাপ্ত অধ্যায় কিভাবে চলবে সেই দুঃচিন্তা।
অসম্ভব পরিশ্রমী নাজমা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমি কিছুই চাই না। কিন্তু আমার বাচ্চার কি হবে ? ওর তো ভবিশ্যৎ আছে ? ওকে কি করে বড় করবো? এখন তো আমার আর এখানে (শরণখোলায়) থাকা যম্ভব না। সবাই আমাকে খারাপ মনে করে।
হাসপাতালে কোন আত্মিয় স্বজন তাকে দেখতে এসেছিলো কিনা জনাতে চাইলে তিনি বলেন, তারা তো কেউ আমার পরিচয়ই দেয় না। কেউই আসে নি।
এখন আপনি কি চান ? এমন প্রশ্নে কিছুটা খেপে যান নাজমা। ক্ষিপ্ত কন্ঠে তিনি বলেন, আমাকে কি ভিক্ষুক বানাতে চান। আমি এইটুক বড় হইছি কোন দিন কারো কাছে ভিক্ষা করিনি। কারো কাছে হাত পাতি নি। আর কোন দিন ভিক্ষাও করব না।
সাহায্যের কথা বলে আর কখনো ফোন দিবেনা বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
|| সন্তানকে কাছে রাখার আকুতি ‘নাজমা’র
কিছু ক্ষন পর আবারো ফোন আসে তার নম্বর থেকে। এবার কল ব্যাক করে কথা হয় বেশ দির্ঘ্য ক্ষণ। কথা বলার এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন নাজমা। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আমি এখন কই (কোথায়) যাব ? আমাকে তো এখন হাসপাতাল থেকে নাম কাইটে দিবে বলে কইতেছে। এর পর আমি কোথায় যাব।
আইজ দুপুরে এই হানে (দুপুরে এখানে) ভাতও দেই নি। আমি কি খাবো ?
আপনেরা যে কইতেছেন আমার জন্য কিছু করার কথা। আপনেরা কি করবেন? জেল খানা না কি কয়, পাগলাগারতের না হান। আমারে সেই হোমে পাঠাইবেন? আটকাইয়ে রাখবেন ? আমার বচ্চা ডারে আমর কাজ থেহে (থেকে) আলাদা করবেন।
ঢাহার (ঢাকার) থেকে কারা যেন ফোনে কথা কইছে। তারা কয় বাচ্চা ডারে নিয়ে কি ভাবে চলবা। আমার বাচ্চা ডারে নিতে যায়। আমি আমার বাচ্চারে কারো কাছে দিব না। ওরে মানুষ বানানো।
আপনাকে যদি কেই এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করে তবে কি আপনি থাকবেন ? এমন প্রশ্নে নাজমার উত্তর, আমি এখন কি ভাবে এখানে থাকব ! এখন কি কাজ করবো। কেউ কি আমাকে কোন কাজ দিবে?
কথা প্রসঙ্গে নামজমা জানতে চান ওই লোকটারে কি হবে। যে তাকে নির্যাতন করেছে। কবে আপনারা তারে কোটে তোল বেন? তার কি বিচার করবেন? তার তো বিচার করবেন, আমার কি হবে ? আমর বাচ্চাডার কি হবে ?
প্রশ্ন গুলোর মুখে নিজেও কিছুটা বাক রুদ্ধ হয়ে যাই আমি। বিচার তো আদালতের বিষয় বলে দায় এড়ানো চাষ্টা করি। কিন্তু তাকে খুব একটা লাভ হয় না। হয়তো অজ্ঞতা থেকেই আবারো প্রশ্ন করে বসেন, কি বিচার হবে ? তাতে আমার কি হবে ? কবে আদালত ডাকবে কন ?
নাইলে আমি কোটে (কোর্টে) যইয়ে কই আমার বিচার লাগবে না।
আমর যত টুক ক্ষতি হওয়ার তা তো হইছে। এখন বাচ্চা ডারে তো মানুষ করতে হবে। কোট (আদালত) যদি বড় কোন টাহা দেয় তাই ব্যাংকে রাইখে ওরে মানুষ করতাম। আর যদি কোন কাজ পাই তাই করে খাইতাম।
ওই লোকটা আমার যেমন ক্ষতি করছে আমি তার বিচার চাই।
যদি ঢাকা বা এলাকার বাইলে অন্য কোথাও কাজের জন্য যে তে হয় তাকে তার আপত্তি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাচ্চা ডারে মানুষ করা যাবে এমন কোন কাজ করা গেলি আমি যাতি রাজি আছি। আমি কাজ করে ওরে মানুষ করতি চাই।
নাজমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া স্থানীয় সংবাদকর্মী ও শরণখোলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন লিটন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, অনেকে দুর থেকে মেয়েটির সহায়তার কথা বললেও এখনো কেউই তার পাসে এসে দাড়ায় নি। দেশে এতো নারী বাদি সংগঠন, সংস্থা কিন্তু নাজমার পাশে দাড়াতে কারোই দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় কোন এনজিও বা সরকারি সংস্থাও কাছ থেকেও তেমন কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা।
তিনি আরো বলেন, সংবাদ মাধ্যমের কল্যানে নাজমার কথা তো এখন প্রায় সবার জানা। যারা নারীর অধিকারের কথা বলেন তারা সবাই কোথায়। নাজমার কি কোন মনবাধিকার নেই। তার মতোন সংগ্রামী কিশোরীর পাশে তবে কেন কেউ দাড়াচ্ছে না ?
শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. অসীম কুমার সমাদ্দার সন্ধ্যায় বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, নাজমা এখন মোটামুটি সুস্থ। তার শারিরীক অবস্থা আগের চেয়ে বেশ ভালো। যদিও মানুষিক ভাবে সে বেশ ভেঙে পড়েছে। পরিপাশিকতার জন্য এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সময়ের প্রয়োজন। তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া যায়।
‘হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলে তার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় আমার তাকে এখনও হাসপাতালে রেখেছি।’
তিনি আরো বলেন, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পর থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নজমার পরিবারের কেউ তাকে দেখতে আসেনি। কেবল শত শত উৎসুক মানুষই তাকে দেখতে এসেছে। যা তাকে নিজের কাছে আরো বেশি দূর্বল করে দিয়েছে।
সামাজিক ও পারিপাশিক অবস্থা বিবেচনায় নাজমাকে সাহায়তার ও পূনরবাসনের জন্য সরকারি বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আশার আহ্বান জানান তিনি। তা না হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে শরণখোলায় থেকে তার জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন বলেও মনে করেন ডা. অসীম সমাদ্দার।
শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খান মতিয়ার রহমান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সরকারের যে সমাজ সেবা এবং মহিলা ও শিশু অধিদপ্তর আছে তার কিরছে? তারা কেন মেয়েটির পাসে দাড়াচ্ছে না।
এখন তো অবস্থা এমন যেন সব দায় কেবল সাংবাদিকদের। কেউ এগিয়ে আসতে চান না।
তবে নাজমার বিষয়ে কথা বলতে শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. অতুল মন্ডলের সাথে শুক্রবার ও শনিবার কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্ট করা হলেও তিনি এই প্রতিবেদকের ফোন কেটে দিচ্ছিলেন।
এর আগে বুধবার উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।
শরণখোলা থানার ওসি মো. রেজাউল করিম শনিবার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, রোববার (৩০ আগস্ট) নাজমাকে তার শিশু সন্তানসহ আদালতে হাজির করা হবে। আদলতই নির্ধারণ করবে তাকে কোথায় পাঠানো হবে।
মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) ভোর রাতে শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন কিশোরী নাজমা বেগম। দীর্ঘদিন ধরে জীবিকার তাগিদে এলাকায় পুরুষ বেশে চলা নাজমুল ওরফে নাজমার সন্তান হওয়ার খবরে এলাকায় চাঞ্চল্য দেখা দেয়।
পেটের দায়ে প্রায় দুই বছর ধরে নিজের নাম গোপন করে ছদ্মবেশে রিকশা-ভ্যান চালাতেন সে। সবার কাছে পরিচিতি পায় নাজমুল ইসলাম নামে। কিন্তু কয়েক মাস আগে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর লালসার শিকার হয় সে।