‘টাকা নিয়ে না গেলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে মা। আমাকে শেষ দেখা দেখে রাখ। কোন অন্যায় করলে মাফ করে দিও। আর কোন দিন হয়তো তোমরা আমকে দেখতে পারবে না।’
এক মাস আগে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে এ কথাগুলো বলেছিলেন ফাতেমা আক্তার সুখি (২৫)। তার সে কথাই এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
টানা ২১ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মঙ্গলবার (১৯ মে) সকালে লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার জিউধরা গ্রামের মোস্তফা গাজীর মেয়ে সুখিকে।
আদর করে নিকট আত্মীয়রা হয়তো নাম রেখেছিল ‘সুখি’। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই তার কাছে ধরা দেয়নি সুখ।
পিতার দ্বিতীয় বিয়ে পর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় মায়েরও। ছোট বেলা থেকেই তাই ফাতেমা আক্তার সুখি বড় হয়েছে মামার বাড়িতে। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে স্বাবলম্বী হবে। কিন্তু অভাবের কাছে হার মানতে হয়। মাত্র নবম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় সুখির।
বিয়ের পর স্বামী বাহারকে নিয়ে নতুন করে সুখি সংসারের স্বপ্ন দেখত সে। কিন্তু ভাগ্য তার সাথে প্রতারণা করেছে।
বুধবার (২০ মে) সকালে লাশ নিয়ে ফেরার সময় বাগেরহাট দড়াটানা ব্রিজের নিচে বসে নিহত ফাতেমা আক্তার সুখির মামা এমদাদ হোসেন বাগেরহাট ইনেফো ডটকমকে বলেন, বাপ-মা হারা সুখিকে মানুষ করেছে তারা। অভাবের ভেতরও তারা অনেক কষ্ট করে সুখির লেখা পড়া চালাচ্ছিলেন।
২০০৯ সালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুর উপজেলার আ. রাজ্জাক শেখের ছেলে বাহার উদ্দিন শেখ সুখিকে দেখে পছন্দ করে। সব কিছু যেনে শুনে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাদের। নুশরাত নামে সাড়ে ৩ বছরের একটি কন্য সন্তান রয়েছে সুখি-বাহার দম্পতির।
সুখির মামার অভিযোগ, বিয়ের ২/৩ মাস পর থেকে যৌতুকের জন্য চাপ দিতে থাকে সুখির স্বামী বাহার উদ্দিন। চালাতে থাকে শারিরীক ও মানুষিক নির্যাতন।
‘সুখির সুখের কথা ভোবে কয়েক দফায় তার ৮ মামা মিলে দেড় লক্ষ টাকা যৌতুক দেন।’
কিন্তু মাসখানেক আগে আবারো এক লাখ টাকা যৌতুক নিয়ে দেয়ার জন্য সুখিকে চাপ দিতে থাকে তার স্বামী বাহার। শুরু করে নির্যাতন।
নির্যাতন সইতে না পেরে তখন মামার বাড়িতে চলে আসে সুখি। কিন্তু তার জানা ছিল মামাদের অভাব-অনাটনের কথাও। তাই তো সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে টাকা ছাড়াই সুখি ফিরে যায় মকসুদপুরে স্বামীর বাড়িতে।
নিহতের মামা ও অন্য আত্মীয়রা মকসুদপুর গিয়ে স্থানীয়দের কাছে শুনেছেন, গত এপ্রিল মাসের ২৭ বা ২৮ তারিখ সুখিকে তার স্বামীর পরিবারের ৪/৫ সদস্য মিলে মারধরের পর জোর করে চেপে ধরে মুখে বিষ ঢেলে দেয়। ওই দিন রাতে তাকে ঘরেও ঢুকতে দেয়া হয়নি।
পর দিন অসুস্থ সুখিকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ৪ দিন পর নেওয়া হয় গোপালগঞ্জ হাসপাতালে। সেখান থেকে অবস্থার অবনতি হলে ৫ মে তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকার ‘গ্রিনলাইফ হাসপাতালে’।
তবে এ পর্যন্ত সুখির মামাদের এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি বলে দবি তাদের।
১৫ মে সুখির মুমূর্ষু অবস্থার কথা জনিয়ে খবর দেয়া হয় তার মামাদের। এভাবে ২১ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মঙ্গলবার বিকালে সে মারা যায়।
সুখির মৃত্যুর সাথে সাথে হাসপাতাল থেকে তার স্বামীসহ সকলে পালিয়ে যায়।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য নিহতের স্বামী বাহার উদ্দিনের সাথে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায় নি। তবে একবার ফোন রিসিফ করেও সাংবাদিক পরিচয় শুনে ফোন কেটে দেন বাহার উদ্দিন।
এঘটনায় মঙ্গলবার রাতে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর থানায় অভিযোগ করতে গেলেও থানার ডিউটি অফিসার মামলা না নিয়ে নিজেদের থানায় (বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ) মামলা দিতে পরামর্শ দেন বলে অভিযোগ সুখির মামার।
এ বিষয়ে মকসুদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবিজুর রহমান বলেন, আমরা কেন মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানাবো? অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।