হয়রত খান জাহান (র.) এর মাজারের দিঘির শতবর্ষী ‘ধলা পাহাড়’ কুমিটির মৃত্যুর সাথে পরিসমাপ্তি হয়েছে মিঠা পানির কুমির যুগল ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ ইতিহাসের।
তৎকালীন খলিফাতাবাদ রাষ্টের প্রতিষ্ঠাতা হযরত খানজাহান এবং তার পরবর্তি ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই কুমির।
ইতিহাস অনুযায়ী, সুলতানী শাসন আমলে হযরত খান জাহান (র.) খ্রীষ্টিয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে (১৪০১/মতান্তরে ১৩ শতকের শেষে) বাগেরহাটে তৎকালীন ‘খলিফতাবাদ’ নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে খান জাহান (র.)এর মাজার সংলগ্ন এই স্থানে তিনি একটি দিঘি খনন করেন।
১৯১৪ সালে প্রকাশিত সতীশ চন্দ্র মিত্রের লেখা ‘যশোহর খুল্নার ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বর্তমান দিঘিটির স্থানে পুরতন বৌদ্ধ আমলে উত্তর-দক্ষিণে একটি ছোট পুকুর (পুস্করিণী) ছিল। খান জাহান সেই প্রকান্ড একটি দিঘি খনন করেন। যার দৈর্ঘ্য-প্রস্ত প্রায় সমান, এক একদিকে ১৬০০ ফুট।
এই দিঘির উত্তর দিকে ৬০ ফুট প্রশস্ত একটি বাঁধান ঘাট (সিড়ি) আছে। ঘাটের উপরে পাড়ের অংশে খান জাহান (র.)এর মাজার বা সধাধি।
‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ নাম করণ –
অনেকেই মনে করেন ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ দুটি নিদৃষ্ট কুমিরের নাম। আসলে বিষয়টা কেবলই তা নয়।
সতীশ চন্দ্র মিত্রের ওই ইতিসাহ গ্রন্থ অনুসারে, খান জাহান তার এই দিঘিতে ‘কালা পাহাড়’ (পুরুষ) ও ‘ধলা পাহাড়’ (নারী) নামে দুটি কুমির ছাড়েন এবং লালন পালন করতেন। মাজারের দিঘির সাথে নিকটবর্তী নদী বা বিল থেকে এই কুমির দিঘিতে আনা হতে পারে বা আসতে পারে (‘ নদীর সহিত সংযোগবিশিষ্ট নিকটবর্ত্তী বিল হইতে কুমীর আসিয়া এই বিরাট দীঘিতে পাড়াও আশ্চর্য্যের বিষয় নহে’) বলে অনুমান করা হয় ওই গ্রন্থে।
খান জাহানের খনন করা ঘোড়া দিঘি, কোদাল ধোয়া দিঘিসহ অনান্য দিঘিগুলোতেও কুমির ছিল বলে সম্ভাবনার কাথা বলা হয়েছে বইতে।
ঐতিহাসিকদের মতে, খান-উল-আলম উলুঘ খান-ই-জাহান এই দিঘিতে তাঁর পোষা ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ নামে মিঠা পানির প্রজাতির কুমির দুটিকে নিয়মিত খাবার দিতেন, কুমির দুটি তাঁর হাত থেকে খাবার খেতো।
খান জাহানের মৃত্যুর পরও মাজারের খাদেম ও ভক্তরা এই কুমির দুটিকে নিয়মিত খাবার দিতেন। ক্রমে এই কুমির যুগল বংশ বিস্তার করে এবং গত ছয়শ’ বছর ধরে বংশানুক্রমে তারা এই দিঘিতে উন্মুক্ত পরিবেশে বসবাস করে আসছিলো।
আস্তে আসতে এক সময়ে এই কুমির হযরত খান জাহান (র.)এর ভক্ত অনুরাগীদের বিশ্বাস ও অনুভুতির প্রতিকে পরিণত হয়। এরা হয়ে ওঠে এই মাজার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংগ।
মাজারের খাদেম হুমায়ুন কবির ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ঋতি অনুয়ায়ি এই দিঘিতে ওই দুটি কুমিরের বংশধরদেরও ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ নামে ডাকা হত। অর্থাৎ কুমিরটি পুরুষ হলে তার নাম হত কালা পাহাড় আর নারী হলে ধলা পাহাড়।
মাজারের আরেক খাদেম ফকির মহিদুল ইসলাম সুমন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘আমি দিঘিতে খান জাহান (র.) এর সময়কার চার বংশধর দেখেছি। এর তিনটি আগেই মারা গেছে। আর সর্বশেষ বংশধর ধলা পাহাড় কুমিরটিরও মৃত দেহ বৃহস্পতিবার পাওযায়।’
মাজারের প্রধান খাদেম শের আলী ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, খান জাহানের কুমিরের সবশেষ বংশধর ‘ধলা পাহাড়ে’র বয়স ছিল প্রায় একশ’ বছর। মৃত কুমিরটি লম্বায় ছিল প্রায় ৯ ফুট।
‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ বলে ডাক দিলে এখানকার কুমিররা ছুটে এসে ভক্তদের আনা মুরগি খেয়ে তাদের মন আর চোখ জুড়িয়ে রাখত। মাজারের অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই কুমির।
সবশেষ বংশধরের মৃত্যু –
বহস্পতিবার ভোরে মাজার সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথম দিঘিতে কুমিরটির মৃতদেহ দেখতে পায়।
কুমিরটির মৃত্যুর এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মাজারের খাদেমসহ শতশত ভক্তরা মাজারে ভিড় জমান। মাজারের খাদেমদের অনেকই এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। খবর পেয়ে খান জাহানের মাজারে ছুটে যান বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক, থানা পুলিশ, সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ ও প্রাণী সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা।
৫ ফেব্রুয়ারি (বহস্পতিবার) দুপুরে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কুমিরটিকে পাড়ে তোলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত ‘ধলা পাহাড়’ এর মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে দিঘিতে অবৈধভাবে মাছ শিকার করার জন্য পেতে রাখা ফাঁস জালে জড়িয়ে অথবা অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে কুমিরটির মৃত্যু হতে পারে।
জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুখেন্দু শেখর গাইন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, ‘জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কুমিরটির মৃতদেহ ময়না তদন্ত শেষে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পরীক্ষাগারে পাঠানো হচ্ছে। সেখান থেকে প্রতিবেদন পেলে সুনির্দিষ্টভাবে মৃত্যুর কারণ বলা যাবে।
তবে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, খাদ্যে বিষক্রিয়া অথবা অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে শরীরে চর্বি জমে প্যান স্ট্যাটিস (চধহ ঝঃধঃরঃং) রোগে কুমিরটির মৃত্যু হতে পারে।’
দিঘির উত্তর পাড়ের বাসিন্দা বীণা বেগম মৃত কুমির দেখতে এসে কেঁদে ফেলে বলেন, ‘কুমিরটা প্রতিবছর আমাদের বাড়ির কাছেই দিঘির পাড়ে ডিম পাড়ত। কখনই আমাদের কোন ক্ষতি করত না।’
মাজারের এই কুমির নিয়ে এলাকার মানুষের মুখে প্রচলিত আছে অনেক কিংবদন্তি ও লোককাহিনী।
১৯৩৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত দিঘির আদী কুমির মৃত্যুর একটি পরিসংখ্যান –
সূত্র মতে, ১৯৩৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত বিভিন্ন ভাবে মোট ১১টি কুমির মারা যায়। এর মধ্যে মাজারের দিঘিতে খাদেম র্কতৃক অবৈধ ভাবে জাল দিয়ে মাছ ধারা সময় বেশির ভাগ কুমির জালে পেচিয়ে মারা যায়।
- ১৯৩৬ সালে ঋষিদের হাতে একটি কুমির মারা যায়
- ১৯৪১ সালে খাদেমদের মাছ ধারার জালে পেচিয়ে একটি
- ১৯৫০ সালে বহিরাগত সাওতালদের হাতে একটি
- ১৯৬০ সলের দিকে খাদেম গোলাপ ফকিরকে আক্রমনকারী কুমীরটি ঘটনার ২দিন পর মারা যায়
- ১৯৭০ সলে মোহাম্মদ ফকিরের ছেলে দুলুকে কুমীরে মেরে ফেলার পর ঘটনার ১দিন পর একটি কুমীরকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়
- ১৯৯০ সলের দিকে মাজারের দিঘির একটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছোট কালা পাহাড় (পুরুষ) কুমির অন্য একটি বড় কুমিরের আক্রমনে (কামড়ে) মারা যায়।
- ২০০০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর খাদেমদের জালে পেচিয়ে দিঘির সর্ববৃহৎ মাদী কুমিরের (ধলা পাহাড়) মৃত্যু
- ২০০৪ সালের ৪ ডিসেম্বর খানজাহানের দিঘির দুটি মাদী কুরিরের মারামারিতে গুরুত্বর আহত একটির মৃত্যু
- ২০০৫ সালের ৫ আগোস্ট ভারত থেকে আনা ৬টি কুমিরের ২টি পুরুষ কুমিরের আক্রমনে দিঘির একটি পুরুষ (কালাপাহাড়) কুমিরের মৃত্যু
- ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাদরাজের একটি পুরুষ কুমিরের আক্রমনে কালা পাহাড় (পুরুষ) নামে একটি কুমিরের মৃত্যু
সবশেষ ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘ধলা পাহাড়’ এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হযরত খান জাহান (র:) এর মাজারের দিঘিতে ছয়শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকা মিঠা পানির কুমির যুগল ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ এর ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটলো।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে সরকারিভাবে খান জাহানের মাজারের দিঘির এই কুমির সম্প্রসারণের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন দিঘি থেকে কয়েকটি কুমিরের বাচ্চা ঢাকা, রাজশাহী, খুলনার চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেগুলো কোনটিই বাঁচানো যায়নি।পরবর্তিতে দিঘিতে কুমিরের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে।
এর পর ১৯৯৩ সালে ষাটগম্বুজ মসজিদসহ হযরত খান জাহান (রহ:) এর সকল স্থাপত্য ও নিদর্শন গুলোকে ইউনেস্কো ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ ঘোষণা করলে এখানকার বিরল এই মিঠা পানির কুমির সংরক্ষণে দেশি-বিদেশি ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রচেষ্টা শুরু হয়।
২০০৫ সালে এই দিঘিতে মিঠাপানির বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির এই কুমিরের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র দুটিতে।
দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে তখন পর্যন্ত এই প্রজাতির এটাই ছিল শেষ কুমির।
‘ধলা পাহাড়’কে সংরক্ষনের উদ্যোগ –
ইতপূর্বে ২০০৬ সালে মাজারের দিঘির মৃত ‘কালা পাহাড়’ কুমিরটির চামড়া প্রকৃয়াকরণ করে ষাটগম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন যাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। সর্বশেষ ঐতিহ্য ‘ধলা পাহাড়’কেও সংরক্ষনের উদ্যেগ নিয়েছে প্রশাসন।
বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও যাদুঘরের কিউরেটর মো: গোলাম ফেরদৌস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, খলিফতাবাদ নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও খান জাহান পরবর্তি ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে মাজারের দিঘির কুমিরযুগল ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ এবং তাদের পরবর্তি প্রজন্ম বংশানুক্রমের ইতিহাসের সাথে অবিচ্ছেদ্যবাবে জড়িত। এই কুমির ছিল বাগেরহাটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
তাই জেলা প্রশাসন ও সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের সহযোগিতায় আমরা কুমিরের এই চামড়াটি প্রক্রিয়াকরণের পর স্টাফড্ করে আমাদের যাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নয়েছি। সেই সাথে আমরা এর কংকালটিও প্রক্রিয়াকরণেল জন্য চেষ্টা করছি।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, আগামী প্রজন্মের কাছে খান জাহানের দিঘির কুমিরের পরিচয় করিয় দিতে কঙ্কাল ও চামড়া ষাটগম্বুজ জাদুঘরে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসাইন চৌধুরী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, হযরত খান জাহানের (র:) দিঘির এই কুমির দেশে বিদেশে মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। এটি বিরল প্রজাতির মিঠা পানির কুমির। আমাদের দেশে উন্মুক্ত পরিবেশে সম্ভবত এটিই ছিলো এই প্রজাতির সর্বশেষ কুমির।
প্রসঙ্গত, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এই দিঘিতে কুমিরের বিচরণ অব্যাহত রাখা জন্য ২০০৪ সালের ২৬ জুন ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাঙ্ক থেকে ৬টি কুমির এনে এখানে অবমুক্ত করা হয়। অবমুক্ত করা ঐ কুমিরগুলোর মধ্যে দুটি কুমির মারা যায়।
অবশিষ্ট ৪টির মধ্যে দু’টি কুমির নিজেদের মধ্যে মারাপারির পর সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য পাঠান হয়। আর বর্তমনে দিঘিতে মাদ্রাজ থেকে আনা মিঠাপানির প্রজাতির দুটি কুমির রয়েছে।