সরকারি সিদ্ধান্তে চলছে মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ-চ্যানেলের খনন। কিন্তু কিভাবে ? কোন পরিকল্পনায় চলছে একই খনন কাজ ? কোন থায় ফেলা হবে খননকৃত মাটি ?
এসব নির্ধারণ না করেই চলছে নৌরুট চালুর বিশাল এই কর্মযজ্ঞ। স্থানীয়দের দাবি থাকলেও সুন্দরবনে তেলের ট্যাঙ্কার ডুবির আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নৌ-নৌরুটি পলী পড়ে ভরাট হবার মূল কারণ, সংযোগ নদী-খাল গুলোর বাঁধ অপসারণ কাজ শুরু হয়নি।
বিশেষজ্ঞের মতামতে, নিয়মিত ড্রেজিং না করা, চ্যানেলের ২দিকের দ্বিমুখি স্রোত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ৮০’র দশক থেকে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল অববাহিকায় সংযোগকারী নদী খাল দখল করে অবৈধ বাঁধ দিয়ে বাগদা চিংড়ি চাষের কারনে এ নৌরুটি দ্রুত পলি জমে ভরাট হতে শুরু করে। ২০০৬/২০০৭ সাল থেকে যা প্রকট আকার ধারণ করে।
এর আগে ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক এই নৌরুটে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পেড়িখালী অংশে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যায়ে খনন কাজ চালিয়ে এক পর্যায়ে পরিত্যাক্ত ঘোষনা করেছিল বাংলাদেশ অভ্যান্তরিন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)।
জলবায়ু নিয়ে কাজ করা স্থানীয় উন্নয়ন সহয়োগীসহ অভিজ্ঞরা বলছেন, পানীর প্রবাহ, নদীর গতি প্রতৃতি, উত্তরনের উপায়সহ নানা বিধ সমস্যা নিহ্নিত না করে এবং এসব উত্তরনের উপায় না খুজেঁই চলে খনন। ফলে চলতি এই খননের কাজও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
সুত্র জানায়, ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ সালের খননের সময় বিআইডাব্লিউটিএ গবেষনা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভারনমেন্টাল জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (সিইজিআইএস) কে দিয়ে সার্ভে করায়। সে সময় তারা ভালভাবে নদীর গতি প্রকৃতি অনুধাবন এবং উত্তরণের উপায় খুজে বের করেনি। প্রতিষ্ঠান সরকারকে খননের জন্য সঠিক তথ্য দিতে পারে নি।
নৌ-রুটটির চলতি খনন আজ শুরুর আগে আবারও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএসকে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী সমীক্ষার কাজ দেওয়া হয়। তাদের সমীক্ষায় বলা হয়, বিঞ্চু নদী ও দাউদখালী নদী খনন করে জোয়ার ভাটা প্লাবন ভূমিতে প্রবেশের ব্যবস্থা, মংলা ঘষিয়াখালীর সাথে সংযোগকারী ৩২টি খাল খনন করে জোয়ার অববাহিকা বন্ধ ও পোল্ডার তৈরীর মাধ্যমে জোয়ার অববাহিকার আয়তন হ্রাস করা হয়েছে।
যা বাঁধাগ্রস্থ করছে পানীর সাভাবিক প্রবাহ। ফলে দ্রুত পলি জমে ভরাট হচ্ছে এই নৌ চ্যানেল। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি, ওই সব বাঁধা দূর করে নৌ-চ্যানেলে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করার কথা বলেছে।
তবে মূল কাজে জোরাল ভাবে হাত না দিয়েই কেবল খননকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
এ ব্যাপারে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন শেখ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস এর সমীক্ষার সমালোচনা করে বলেন, বাগেরহাটের ৩৪/২ পোল্ডারের সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার আওতায় জৌখালী সাব প্রজেক্ট যা মল্লিকেরবেড়, বাইনতলা ইউনিয়নের কিছু অংশ, উজলকুড় ইউনিয়ন ও গৌরম্ভা ইউনিয়ন অবস্থিত। দাউদখালী নদীর আগায় ফয়লা এলাকায় জৌখালী পোল্ডারের অধীনে রেগুলেটর আটকিয়ে একটি মহল ও এর পাশাপাশি দাউদখালী নদীর ২ পাশের খাল প্রভাবশালীরা আটকিয়ে মাছ চাষ শুরু করে। এতে অতি দ্রুত জৌখালী পোল্ডারের দক্ষিন পাশ পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। এ উপর নির্মিত হয় বেশ কয়েকটি আশ্রায়ন বা আবাসন প্রকল্প।
তিনি দাবী করেন, এতে দাউদখালী নদী শেষ হয়ে যায়। সেই সাথে রাজনৈতিক বিবেচনায় ভূমিহীনদের নদীর ২ পাড়ের জমি বন্দোবাস্ত দেওয়া হয়। এছাড়া নতুন করে ঝনঝনিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সংলগ্ন দাউদখালী নদী দখলে নিয়ে আমাদের গ্রাম নামক এনজিও এর একটি ক্যান্সার কেয়ার প্রকল্পে জমি দেওয়া হয়েছে। যে প্রকল্পটি সম্পূর্নভাবে দাউদখালী নদী দখল করে নিয়েছে।
এই সব বিষয়গুলি ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে গেছেন না হয় সরকারের রোসানলে পড়ার ভয়ে রিপোর্ট তৈরী হয়নি এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, সর্ব প্রথম চ্যানেল সংশ্লিষ্ট ৩২টি খালের অবৈধ বাঁধ ও পলি অপসারণ, অন্যতম শাখা নদী দাউদখালী খনন ও পলি অপসারণ করতে হবে। এর পাশাপাশি চ্যানেলের ২ পাড়ে জেগে ওঠা চরে মাটি রাখার ড্যাম্পিং ব্যবস্থা করে চ্যানেল খননের কাজ শুরু করলে স্বল্প সময়ের মধ্যে এই নৌ রুটটি চালু করা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ বিষেশজ্ঞ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, পরিকল্পনা মাপিক খনন কাজ করলে অবশ্যই চ্যানেলটি দ্রুত সচল করা সম্ভব। চ্যানেল সংলগ্ন অন্যতম শাখা নদী দাউদখালী নদী এখনও খনন শুরু হয়নি। রয়েছে সমন্বয়হীনতা।
তিনি আরো বলেন, সর্ব প্রথম দাউদখালী নদী খনন ও এর উপর নির্মিত সকল বৈধ অবৈধ স্থাপনা অপসারন করে এবং চ্যানেল সংলগ্ন সকল খাল সচল করতে হবে। তা না হলে আবারও এই খনন কাজ ব্যার্থ হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর মাধ্যমে এ চ্যানেল খনন ও তার তদারকির দায়িত্ব দিতে দাবি জানান তিনি।
গত বছরের ১ জুলাই বিআইডাব্লিউটিএ এর নিজস্ব ৫ টি ড্রেজার দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নৌ-রুট মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খনন কাজ শুরু করে।
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর এই চ্যানেল খননের জন্য সরকারের উপর চাপ বাড়ে। এতে সরকার চ্যানেল খননের জন্য আবারও জোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। গত ৪ জানুয়ারী নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খান ও পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ চ্যানেলটি পরিদর্শন করেন।
তবে, কাজের গতি আশানুরূপ বাড়েনি বলে দাবি করে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল রক্ষা কমিটি ও ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেন, সরকারের কাজে সমন্বয়হীনতা এবং মনিটরিং এর অভাব রয়েছে। নেতৃবৃন্দ দাবী করেন, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার আওতায় ৩৪/২ পোল্ডারের অনুকূলে পরিবেশ বান্ধব ও পরিকল্পিত বেড়ীবাঁধের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ১শ ৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করে। কোন রকম সমীক্ষা ছাড়া এ প্রকল্প স্থাগিত ঘোষনা করা সঠিক হয়নি।
তারা আরও দাবী করেন, ভেড়ীবাঁধ বাস্তবায়ন ও মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-চ্যানেল খনন সাংঘর্ষিক নয়। কারন ওই বরাদ্দোর ভেতর ১শ ১০ কিলোমিটার নদী খাল খননের বরাদ্দ রয়েছে যা অত্যান্ত পরিবেশ বান্ধব। এ ব্যাপারে রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রাফা মোঃ আরিফের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, চ্যানেল খনন সর্ম্পকিত তথ্য বিআইডাব্লুউটিএ এর কাছ থেকে জানা যাবে। আমার শুধু ১৩ টি খাল খননের দায়িত্ব রয়েছে। যা ইতিমধ্যে ৭৫% সম্পন্ন হয়েছে।
বিআইডাব্লুউটিএ এর স্থানীয় কর্মকর্তা সহকারী ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ হোসেনের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ পর্যন্ত ১০টি ড্রেজার মেশিন ও ১০ স্কুবেটর মেশিন খনন কাজে যুক্ত রয়েছে। সর্বশেষ ১০লাখ কিউবিক ঘন মিটার মাটি খনন করা হয়েছে। খনন কাজ পাওয়া চায়না হারবার কোম্পানি এখনও কাজ শুরু করেনি।