ইনজামামুল হক । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
সল্প খরচে এবং একদিনেই যারা সুন্দরবন ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য একটি আদর্শ দর্শনীয় স্থান ‘করমজল’ ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি ভ্রমন পিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র ছাড়াও এখানে রয়েছে হরিণ ও কুমির প্রজনন ও লালন পালন কেন্দ্র।
বাগেরহাটের মংলা উপজেলা সদর বা মংলা বন্দর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে করমজলের জেটিতে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা। নদী পথে মংলা থেকে দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার আর খুলনা থেকে প্রায় ৬০ কি.মি.।
এখানে প্রবেশপথেই মাটিতে শোয়ানো বিশালাকৃতির মানচিত্র সুন্দরবন সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেবে। মানচিত্রটিকে পেছনে ফেলে বনের মধ্যে দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি হাঁটা পথ। এই নাম ‘মাঙ্কি ট্রেইল’।
এই নামের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় ট্রেইলে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের। বানরগুলো ট্যুরিস্টদের কাছাকাছি চলে আসে। হাতে কলা বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে পথ না চলাই ভালো। কারণ বানরগুলো খাবারের জন্য আপনাকে ঘিরে ধরতে পারে। তাই সাবধান বানর থেকে।
কাঠ বিছানো পথের দুই ধারে ঘন জঙ্গল। দুই পাশে বাইন, কেওড়া আর সুন্দরী গাছের সারি। তবে বাইন গাছের সংখ্যা বেশি। কাঠের পথটি কিছু দূর যাওয়ার পর হাতের বাঁয়ে শাখা পথ গিয়ে থেমেছে পশুরের তীরে। শেষ মাথায় নদীর তীরে বেঞ্চ পাতানো ছাউনি। মূল পথটি আরও প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণে গিয়ে ছোট খালের পাড়ে থেমেছে।
এ পথের মাথায় গোলপাতার ছাউনির গোলাকৃতির আরও একটি শেইড। যেখানে বেঞ্চে বসে বনের নিস্তব্ধতা উপভোগ করা যাবে।
সেখান থেকে আবারও পশ্চিম দিকে কাঠের ট্রেইলটি চলে গেছে কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পাশে। এই ট্রেইলের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (বুরুজ)। করমজলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে একটি সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। এর চূড়ায় থেকে করমজল এবং চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়।
সুন্দরবনের উপরিভাগের সবুজাভ নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
কাঠের তৈরি ট্রেইলের একেবারে শেষ প্রান্তে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখান থেকে সামান্য পশ্চিম দিকে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। সামনেই ছোট ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা জলের কুমিরের বাচ্চা।
একেবারে দক্ষিণ পাশে দেয়াল ঘেরা বড় পুকুরে আছে রোমিও, জুলিয়েট আর পিলপিল। লবণ পানির প্রজাতির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য সুন্দরবনস বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন প্রকল্পের আওতায় ২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৮ একর জমির ওপর বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র সরকারি এই কুমির প্রজনন কেন্দ্র।
ওই বছর সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি লোনা পানির কুমির নিয়ে কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। রোমিও-জুলিয়েটের বয়স এখন ২৪। এই জুটি প্রজননক্ষম হয় ২০০৫ সালে।
জুলিয়েট আকারে রোমিওর চেয়ে সামান্য ছোট। লোনা পানির এই প্রজাতির কুমির ৮০ থেকে ১০০ বছর বাঁচে। এই কেন্দ্রটি তত্ত্বাবধানে ছিলেন (২০১৪ সাল) অষ্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক জন বন কর্মকর্তা।
জুলিয়েট এ পর্যন্ত (মে ২০১৫) ডিম দিয়েছে মোট ৫৩২টি। সেখান থেকে ২৮৪টি (ডিসেম্বর ২০১৪) বাচ্চা ফুটিয়েছেন বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেক নারী সদস্য পিলপিল। এখন পর্যন্ত সে ডিম দিয়েছে ৪৪টি, যা থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৩৩টি।
এর পাশেই চোখে পড়বে চিড়িয়াখানার মতো উপরিভাগ উন্মুক্ত খাচায় ঘেরা খোলা জায়গা। ভেতরে চিত্রা হরিণ। খাঁচার ভেতরে পশ্চিম কোণে ছোট আরেকটি খাঁচা। ভেতরে রয়েছে কয়েকটি রেসাস বানর।
সাম্প্রতি (২০১৫ সালে) আই.ইউ.সি.এন (IUCN) প্রকল্পের আওতায় বাচ্চা উৎপাদনের উদ্যেশ্যে ‘করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে’র পুকুরে ছাড়া হয়েছে ছাড়া হয়েছে ১৪টি কচ্ছপ।
- প্রয়োজনীয় তথ্য
করমজলে দেশি পর্যটকের জন্য প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা, বিদেশী পর্যটক ৩শ’ টাকা। দেশি ছাত্র ২০ টাকা। দেশি গবেষক ৪০ টাকা। বিদেশী গবেষক জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক (বারো বছরের নিচে) ১০ টাকা। দেশি পর্যটকের ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহারে ক্যামেরা প্রতি ২শ’ টাকা। বিদেশি পর্যটক ৩শ’ টাকা। সব মূল্যের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য।
করমজল যেতে হয় পশুর নদী পাড়ি দিয়ে। এই নদী সবসময়ই কম-বেশি উত্তাল থাকে। তাই ভালো মানের ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে যাওয়া উচিৎ। আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন নৌকায় পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া আছে কী না।
বন রক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না। হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের কোন প্রাণীকে খাবার দিবেন না।
- কীভাবে যাবেন
সুন্দরবনের ‘করমজল’ ইকো-ট্যুরিজম (পর্যটন) কেন্দ্রে যাবার জন্য সব চেয়ে সহজ মংলা থেকে নদী পথে যাওয়া। এছাড়া খুলনা থেকেও নদী পথে যেতে পারেন করমজল। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সড়ক পথে আপনি আসতে পারবেন বাগেরহাটের মংলায়। মংলা থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে যেতে হবে করমজল।
দশ জনের উপযোগী একটি ইঞ্জিন নৌকার যাওয়া আসার ভাড়া পড়বে ৭শ’ (৭০০) থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা। এসব ইঞ্জিন নৌকাগুলো সাধারণত ছাড়ে মংলা ফেরি ঘাট থেকে।
- কোথায় থাকবেন
সারাদিন করমজলে বেড়িয়ে রাতে এসে থাকতে পারেন বন্দর শহর মংলায়। এখানে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০৪৬৬২-৭৫১০০) ছাড়াও বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউস হোটেল-মোটেল। রুম (ডাবল) প্রতি ভাড়া পড়বে ৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকা (নন এসি/এসি)।
ইকনোমি বেড ৬শ’ টাকা। এছাড়াও মংলা শহরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। এসব হোটেলে দেড়শ’ থেকে ৬শ’ টাকায় কক্ষ পাওয়া যাবে।
সর্বশেষ আপডেট : ৩০ মে ২০১৫