জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ ও দাবি উপেক্ষা করে সুন্দরবনের শ্যালা নদী পথে ২৭ দিন পর পুনরায় নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রদানের পর বুধবার সকাল থেকে আবারও শ্যালা নদীতে পণ্যবাহী নৌযান চলে শুরু করে। সকাল ৬টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত প্রায় ৪ শতাধিক সার, ক্লিংকার, সিমেন্ট, লবণ, বালু, খাদ্যশস্য, ফ্লাইঅ্যাশসহ বিভিন্ন পণ্য বোঝাই নৌযান চলেছে শ্যালা নদী দিয়ে।
নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হওয়াতে স্বস্থি ফিরে এসেছে নৌযান শ্রমিক, মালিক ও শিল্প কলকারখানা মালিকদের মধ্যে। তবে ইতিমধ্যে মংলা বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে।
৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের এই নদীতে ফার্নেস তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর থেকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া নৌযান চলাচল।
মংলা বন্দরের হারবার মাস্টার মো. হাসান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বুধবার সকাল থেকে সীমিত আকারে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে। নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় মংলা বন্দর ও তার আশপাশের নদীতে কয়েকশ’ নৌযান আটকে পড়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছিল।
বর্তমানে মংলা বন্দরে সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালবাহী চারটি, ইউরিয়া সারবাহী তিনটি এবং একটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ অবস্থান করছে। আজ নতুন আরও তিনটি জাহাজ বন্দরে ভেড়ার কথা রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্যালী নদী দিয়ে সীমিতভাবে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে বনবিভাগ, কোস্ট গার্ড ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের তদারকির কথা থাকলেও শুধু নবিভাগের সদস্যদের দেখা গেছে। তারা মাইকিং করে জাহাজ স্টাফদের নৌ চলাচলের শর্ত জানাচ্ছিলেন।
তবে ব্যপক শব্দ করে বেপরোয়াভাবে সুন্দরবনের মধ্যদিয়ে চলা নৌযান স্টাফদের সেদিকে কোন খেয়ালই ছিলোনা। আর নৌযান চলাচলের তদারকি এবং ফিটনেস ও অনান্য কারিগরি দিকগুলো দেখার দায়িত্বে থাকা বিআইডাব্লুটিএ, মংলা বন্দর কিম্বা কোস্টগার্ডকে সারাদিনেও দেখা যায়নি সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা ও সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. বেলায়েত হোসেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, তিনটি শর্ত সাপেক্ষে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
শর্তগুলো হলো দিনের বেলায় শুধু শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল করবে, রাতে শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলবে না এবং নোঙ্গর করেও থাকতে পারবে না। এছাড়া কুয়াশা বেশি থাকলে এ নদী দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে না।
এ সকল শর্ত ব্যতিরেকে কেউই চলাচলের চেষ্টা করলে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, এই পথ দিয়ে তেলবাহী জাহাজ ও ট্যাংকার চলাচল বন্ধ থাকবে। আমরা সব সময় চাই এই নদী দিয়ে যেন নৌযান চলাচল বন্ধ থাকে। ঘষিয়াখালী নৌপথ বন্ধ থাকায় এই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এই নদীতে নৌযান চলতে সরকার অনুমতি দিয়েছে।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল শুরুতে যেন কোনভাবেই ঘষিয়াখালি চ্যানেলেও খনন কাজে স্থবিরতা না আসে সেদিকে কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে অনুরোধ করেন তিনি।
পণ্য পরিবহন করা লাইটারেজ জাহাজগুলো যাতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্য পরিবহণ করতে না পারে এবং তাদের নৌযানের ফিটনেস আছে কিনা তা কোস্টগার্ড তদারকি করবে বলেও জানান তিনি।
তবে, বুধবার সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত সরেজমিনে শ্যালা নদীর চাঁদপাই জয়মনী, জয়মনীর ঘোল, আন্ধারমানিকসহ বিভন্ন এলকা ঘুরে দেখা মেলে নি কোস্টগার্ড সদস্যদের।
এব্যাপারে জানতে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার মেহেদি মাসুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি জানান, ‘আমরা আজ সন্ধা পর্যন্ত এবিষয়ে কোন চিঠি বা নির্দেশ পাইনি।’
তবে বৃহস্পতিবার থেকে কোস্টগার্ড শ্যালায় নৌযান চলাচলের তদারকিতে থাকবে বলে জানান তিনি।
মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরুর হুমকির পর বিকেলে আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে মংলা বন্দরের যোগাযোগ স্থাপনকারী ওই নৌপথটি পুনরায় চালুর ঘোষণা দেয়।
এদিকে, চ্যানেলটি বন্ধ থাকায় নৌযান মালিক ও কলকারখানার যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ প্রায় ১শ কোটি টাকা দাবি করেছেন মংলা বন্দর ব্যবহারকারী মেসার্স নুরু এন্ড সন্স কোং এর সত্ত্বাধিকারী এইচ.এম দুলাল। বাগেরহাট ইনফো ডটকমের সাথে আলাপ কালে তিনি শ্যালা নদীর বিকল্প মংলা-ঘাসিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেলটি দ্রুত চালুর দাবী জানান।
এদিকে শ্যালা নদী দিয়ে আবারও নৌযান চলাচল শুরু হওয়ায় স্থানীয়রা নতুন করে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন।
তারা বলছেন, নদী দিয়ে আবারও যদি বেপরোয়া নৌযান চলাচল করে তাহলে যেকোন সময় নতুন কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যাতে আবারও হুমকিতে পড়তে পারে সুন্দরবন।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল, সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), সুন্দরবন একাডেমিসহ পরিবেশবিদরা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌচলাচল বন্ধে দীর্ষ দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
তাদের এই দাবি উপেক্ষো করে শ্যালা নদীতে ফের নৌযান চলাচল করতে দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।
অন্যদিকে শ্যালার নৌ-রুট চালু করায় পূর্বঘোষিত নৌযান শ্রকিমদের দেশব্যাপী কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন।