সাধারণত পানিতে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কারের ক্ষেত্রে তা অন্য স্থানে সরিয়ে দেওয়া, ভাসমান তেল তুলে নেওয়া, শোধন ও দাহ্য করার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
তবে কোনো তেলবাহী জাহাজ বা কার্গো ডুবে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি ডোবার আগেই অন্য জাহাজ পাঠিয়ে সেটিতে থাকা অবশিষ্ট তেল সরিয়ে নেওয়া হয়। এতে ক্ষয়-ক্ষতি অনেকাংশে হ্রাস পায়।
ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ায় বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন ও ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
এমনই আশঙ্কা সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগীগের কর্মকর্তাদের।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্ঘটনায় নদী বা সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কারে নানা পদ্ধতি বা উপায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে তেল ছড়ানোর স্থান, প্রকৃতির ওপর প্রভাব ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। অন্য দেশগুলো এ ধরনের দুর্ঘটনায় সমুদ্র কিংবা নদীর পানি থেকে ভাসমান তেল অপসারণে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে।
সাধারণত পানিতে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কারের ক্ষেত্রে তা অন্য স্থানে সরিয়ে দেওয়া, ভাসমান তেল তুলে নেওয়া, শোধন ও দাহ্য করার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে কোনো তেলবাহী জাহাজ বা কার্গো ডুবে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি ডোবার আগেই অন্য জাহাজ পাঠিয়ে সেটিতে থাকা অবশিষ্ট তেল সরিয়ে নেওয়া হয়। এতে ক্ষয়-ক্ষতি অনেকাংশে হ্রাস পায়।
সরিয়ে নেওয়া : এ পদ্ধতিতে পানিতে ছড়িয়ে পড়া তেলগুলোকে গভীরাঞ্চলের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এ জন্য নানা ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ওগুলো তেলকে দূরবর্তী স্থানে নিয়ে যায়। ফলে মানুষের বা বনাঞ্চলের কাছ থেকে তেলের বেশিরভাগ অংশ বেশ দূরে চলে যায়।
ভাসমান তেল তুলে নেওয়া : তেল সাধারণত পানির সঙ্গে মেশে না। এ কারণে অধিকাংশ তেলই পানির উপরিভাগে ভেসে থাকে। তেল ছড়িয়ে পড়া অঞ্চলে তেলবাহী জাহাজ পাঠিয়ে উপরাংশের তেল তুলে নেওয়া হয়। এভাবে সব তেল তোলা সম্ভব না হলেও তুলনামূলক কম পরিশ্রমে অনেক তেল উত্তোলন করা যায়।
শোধন : ভাসমান তেল তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে তেলের সঙ্গে অনেক পানি থেকে যায়। এ জন্য অনেক রাষ্ট্র সরাসরি তেল শোধনের প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ পাঠিয়ে থাকে। জাহাজগুলোর মাধ্যমে সমুদ্র বা নদীর উপর থেকেই তেল শোধন করে তোলা হয়। এ পদ্ধতিতেও সব তেল উঠানো সম্ভব হয় না।
পুড়িয়ে ফেলা : তেল অনেক বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পড়লে এবং তা লোকালয় বা বনাঞ্চল থেকে দূরে অবস্থিত হলে অনেক সময় সে তেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে তেল পোড়ানো হয়। এতে অবশ্য তেল পুড়ে আরেক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
তেল অপসারণে ব্যাকটেরিয়া : ২০১০ সালে পীত সাগরে তেল পরিষ্কার করতে চীন ব্যবহার করে তেলখেকো ব্যাকটেরিয়া। ডিপো থেকে তেল খালাসের সময় ১ লাখ ৫০০ টন অশোধিত তেল ছড়িয়ে পড়ে পীতসাগরে। দূষিত হয়ে পড়ে ১৭০ মাইল এলাকা। সেই তেল অপসারণে ২৩ টন ব্যাকটেরিয়া ছড়ায় চীন।
২০১০ সালে মেক্সিকোর উপসাগরে তেল ছড়িয়ে পড়ার পরপরই কীভাবে এর ক্ষতি থেকে প্রকৃতিকে বাঁচানো যায় এ নিয়ে গবেষণায় নামেন দেশটির বিজ্ঞানীরা। নিরলস চেষ্টার পর তারা একটা ‘উপায়’ও খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটা হল ব্যাকটেরিয়া। আরও স্পষ্ট করে বলা যায় তেলখেকো ব্যাকটেরিয়া।
তান্নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টেরি হ্যাজেনের নেতৃত্বে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পাওয়া যায় যা পানিতে ছড়িয়ে পড়া তেল শোষণ করে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে গভীর সমুদ্র থেকেও তেল শোষণ করতে পারে ওই ব্যাকটেরিয়া।
সমুদ্রের অত্যধিক ঠাণ্ডা অঞ্চলে ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রকৃতি থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন নিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তেল শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে থাকে।
ব্যাকটেরিয়াকে তেল শোষণের কাজে ব্যবহারের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক হলেও এর গতি অনেক ধীর। এর ফলে বিপুল পরিমাণ তেল শোষণ করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এ অবস্থায় তেল ছড়ানো স্থানে প্রকৃতি মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। তবে কম তেল ছড়িয়ে পড়া স্থানে তা ভালো কাজ করবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
তবে প্রচলিত কোনো পদ্ধতিই তেলের ক্ষতিকারক দিক থেকে পরিবেশকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারে না।
নিউজিল্যান্ডে ২০১১ সালে তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনায় জাহাজটি পুরোপুরি ডোবার আগেই অন্য জাহাজ পাঠিয়ে সেখান থেকে অনেক তেল সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দুই জাহাজের সংঘর্ষে সমুদ্রাঞ্চলে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর শোধন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। জাহাজের মাধ্যমে কর্মীরা সেখান থেকে প্রচুর তেল শোধন করে। এ ছাড়া স্থানীয়দের আশপাশের এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
একই বছর মেক্সিকোর উপকূলে ভয়াবহতম তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় স্থানীয়দের সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে তেল গভীর সমুদ্রে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সাধরণত তেল পরিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রথমে বিবেচনা করা হয় ঘটনাটি কোন অঞ্চলে ঘটেছে। সমুদ্রের উন্মুক্তাঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চল ও অগভীর এলাকাতে তেল পরিষ্কারের ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
পরবর্তী বিবেচ্য বিষয় হলো- দূষণরোধে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির পরিমাণ ও তেল পরিষ্কারের পদ্ধতি। যেমন- ভাসমান তেল তুলে নেওয়া, শোধন বা দাহ্য করা।
এ ছাড়া দ্রুত প্রকৃতি ও প্রাণীর ক্ষতি রোধ এবং পরিবেশকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
অনেক সময় উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণের পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পরিবেশগত সুরক্ষা, আর্থ-সামজিক প্রভাব ও স্বাস্থ্যঝুঁকিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বেশি মাত্রায় তেল ছড়িয়ে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে অনেক সময় স্থলচর ও জলজ প্রাণী সরিয়ে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বড় প্রাণীগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রাণী সেখানে থেকে যাওয়ায় বিপন্নের হুমকির মুখে পড়ে।
তেল পরিষ্কারের ক্ষেত্রে বাজেট ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত বাজেট বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা না হলে এ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে।
কাজী জামশেদ নাজিম ও শাহনেওয়াজ খান: দ্য রিপোর্ট