বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন, দূষণ, সচেতনতার অভাব ও সরকারের অবহেলায় এ বন থেকে একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রাণী।
এক সময় প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখির বসবাস ছিল এই সুন্দরবনে। কালের বিবর্তনে তা এসে ঠেকেছে ২৭০ প্রজাতিতে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় ১৩০ প্রজাতির পাখি।
বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটারই জলভাগ। এই বিস্তীর্ণ নদী-খালে রয়েছে প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ।
সম্প্রতি শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির ঘটনায় ইরাবতী, বোতলনাক, গাঙ্গেয়, ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক, ফিনলেস পরপয়েস, প্যানট্রপিক্যাল স্পটেড প্রজাতির ডলফিন বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে।
সুন্দরবনের ভেতরে জঙ্গল ঘেঁষে চলাচল করছে বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ৷ এ সব জাহাজের সৃষ্ট ঢেউ ভাঙন ধরায় সুন্দরবনে৷ এ সব জাহাজের প্রোপেলারের আঘাতেও প্রায়ই ডলফিনের মৃত্যু ঘটে৷ এ ছাড়া রাতে জাহাজ চলাচলের সময় সার্চ লাইটের আলো ও শব্দ হরিণ, নিশাচর প্রাণীসহ সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের গর্ব ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে মাত্র ৪৪০টি। এর মধ্যে পুরুষ বাঘের সংখ্যা ১২১টি, নারী বাঘ ২৯৮টি এবং শিশু ২১টি। ২০ বছর আগেও এর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০-এর কাছাকাছি।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে—১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে বাঘ ছিল ৪০ হাজার প্রায়। এর অর্ধেকের বেশি ছিল সুন্দরবন এলাকায়।
সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছই চির সবুজ ম্যানগ্রোভ শ্রেণীর৷ এই বনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে যার মধ্যে ১৭টি ফার্ন জাতীয়, ৮৭টি একবীজপত্রী ও ২৩০ প্রজাতি দ্বিবীজপত্রী৷ বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বা নোনা পানির বন হিসেবে ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)।
পৃথিবীজুড়ে যে ৫০ প্রজাতির প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ আছে, তার ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় সুন্দরবনে৷
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, অবৈধ বসতি স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটার কারণে গত ৩৭ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার। বনের সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরী গাছ কমে গেছে ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
সুন্দরবনের অদূরে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে পশুর নদী শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ঘণ্টায় ২৫ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হবে।
জানা যায়, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘণীভূত ছাই বা স্লারি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে। কারণ এতে ক্ষতিকর সালফার এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন ভারি ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদি মিশে থাকে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৪২ টন সালফার ডাই-অক্সাইড (SO2) ও ৮৫ টন নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড (NO2) নির্গত হবে। এছাড়া তেল পোড়ানোর ফলেও প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সইড নির্গত হবে। এর প্রভাবে সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদ বিপন্নের মুখে পড়বে।
মনুষ্যসৃষ্ট কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য পরিবর্তন হলে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবনকে বাদ দিবে কি না এমন আশঙ্কার জবাবে পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় সবকিছু অন্তর্ভুক্ত হয় না। বিশেষ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্য কোনো স্থান, স্থাপনাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ করা হয়। সুন্দরবনের বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এটি। বিরল প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রা হরিণের আবাসস্থান সুন্দরবন, এ ছাড়া বহু প্রজাতির বৃক্ষ, লতা-গুল্ম ও প্রাণীর কারণে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যদি এসব অনন্য বৈশিষ্ট্য না থাকে তাহলে কেন এটাকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলা হবে? সুন্দরবন কোনো রাষ্ট্রের একক সম্পদ নয়। এটা সমস্ত বিশ্বের সম্পদ। ইউনেস্কো যদি মনে করে সুন্দরবন তার নিজস্ব জীব-বৈচিত্র্য হারিয়েছে তখন হয়তো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবনকে বাদও দিতে পারে। এটা ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত।’
নাসের খান বলেন, ‘সহজভাবে যদি বলি, যে বাগানে কোনো তাল গাছ নাই, সে বাগানকে কী আপনি তালবাগান বলবেন। ঠিক তেমনি যখন সুন্দরবনে কোনো ঐতিহ্য থাকবে না, তখন কেন তাকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলবে। আমরা নিজেরাই সুন্দরবনকে ধ্বংস করছি। এখন যদি ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে বাদ দেয় তাহলে অবাক বা বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান ও ভূ-তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মহসিন আলী বলেন, ‘বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য সুন্দরবনের মতো একটি প্রাকৃতিক উপহার আমরা পেয়েছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমুদ্রে সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আর সেখানে আমরা এটাকে ধ্বংস করছি। সুন্দরবন প্রতিনিয়ত সরকারের বা রাষ্ট্রের উদাসীনতার জন্য ধ্বংস হচ্ছে। এর মধ্যে সিডরের মতো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবনের বড় একটি অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। সুন্দরবনের কারণে দক্ষিনাঞ্চলের মানুষ সিডরের ভয়াবহতা তেমনটা আঁচ করতে পারেনি। কিন্তু মজার বিষয় হলো— এই সিডরই ছিলো সুন্দরবনের জন্য প্রথম বড় ধরনের আঘাত। অবশ্য এটা ছিল প্রাকৃতিক।’
মহসিন আলী বলেন, ‘কিন্তু এবার যে ঘটনাটি ঘটেছে বা আগামীতে যা ঘটতে চলেছে তা প্রাকৃতিক নয়। তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ায় যে ধরনের ক্ষতি সুন্দরবনের হয়েছে তা কিছুদিনের মধ্যেই আমরা অনুধাবন করব। আর এরপরের আঘাতটি হচ্ছে সুন্দরবনের নিকটে রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন। আর এটা হবে সুন্দরবনকে নিঃশেষ করে দেওয়ার একটা প্রকল্প। এতো কিছুর পরও ইউনেস্কো কী দেখে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রাখবে সেটা আমার প্রশ্ন?’
– রানা হানিফ ও শাহনেওয়াজ খান: দ্য রিপোর্ট