ইনজামামুল হক । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশে নির্মিত প্রাচীন আমলের মসজিদ গুলোর মধ্যে সর্ববৃহত। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন এ মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য (World Heritage Sites) হিসাবে মর্যাদা দেয়। মসজিদটি বাগেরহাট শহরকে বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী শহরের মধ্যে স্থান করে দিয়েছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোকিটার দুরে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাসে ষাটগুম্বজ বাসস্টপেজ লাগোয়া সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত ষাটগম্বুজ মসজিদটি।
মসজিদে প্রবেশের প্রধান ফটকের ডান পাশে রয়েছে বাগেরহাট জাদুঘর। এখানে প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামটির ফলকসহ খানজাহান আমলের অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। আছে খানজাহানের দিঘির ঐতিহ্যবাহী ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ কুমিরের মমি।
মসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই। তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিলো সে সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে নিশ্চিত ভাবে ধারণা করা হয় এটি খান-ই-জাহানের নির্মিত। ধারণা করা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ [খানজাহান আলী (রঃ) নামে বেশি পরিচিত] মসজিদটি নির্মাণ করেন।
মসজিদের পূর্বদিকে (১২৫মি. দুরে) ‘কোদালধোয়া’ দিঘি, পশ্চিমে বিশাল আকারের ‘ঘোড়াদিঘি’ উত্তরে (৩’শ মিটার দুরে) খানজাহানের ‘বসত ভিটা বা ঢিবি’ এবং দক্ষিনে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক। খানজাহানের দরগাহ থেকে মসজিদটির দুরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার।
আকৃতির বিচারে বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত মধ্যযগীয় মসজিদ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ষাটগম্বুজ মসজিদ। এটি হযরত খান জাহান (রহ:) এর সর্ববৃহৎ কীর্তি/নিদর্শন।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৮ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৯০ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৮·৫ ফুট পুরু। মসজিদের ভেতরে মেঝে হতে ছাদের উচ্চতা প্রায় ২১ ফুট।মসজিদটি ষাটগম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গুম্বজ আসে ৮১টি। মসজিদের চার কোনের মিনার বা বুরুজের উপরের ৪টি গুম্বজ বাদ দিলে গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি। আর ৭৭টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার এবং মধ্যের একটি সারিতে ৭টি গুম্বজ চারকোণবিশিষ্ট। দক্ষিণ-পূর্ব কোণের বুরুজটির ভিতর দিয়ে উপরে (ছাদে) উঠার সিঁড়ি আছে। এর নাম ‘রওশনকোঠা’। উত্তর-পূর্ব কোনের বুরুজটির নাম ‘আন্ধারকোঠা। এটিতেও উপরে ওঠার সিঁড়ি ছিলো যা বর্তমানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ষাটগম্বুজ মসজিদের পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি ভাগে ৭টি সারিতে বিভক্ত (৭x১১) মোট ৭৭টি গুম্বজ আছে। গুম্বজ গুলোর ছাদ-পরিকল্পনার এই ভার বহনের জন্য নিচের অংশে সারিবদ্ধভাবে (৬x১০) ৬০টি পাথরের থাম বা পিলার আছে।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই ষাটটি থামের অস্তিত্ব থেকেই মসজিদটির নাম হয় ‘ষাটখাম্বাজ’ সেখান থেকে কালের বিতর্তনে বিকৃত কথ্যরূপ ‘ষাটগম্বুজ’। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের ‘সাত গম্বুজ’ এবং তা থেকে ‘ষাটগম্বুজ’ নাম হয়েছে।
নাম করণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের আরেকটি মত হচ্ছে, মসজিদটির ছাদ সমন নয় গুম্বুজ আকৃতির। অর্থাৎ ছাদে গুম্বজ। যার থেকে মসজিদটি ‘ছাদ গুম্বুজ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। সেখান থেকে কথ্যরুপ ‘ষাটগুম্বুজ’ নাম হয়েছে।
জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খানজাহান (রঃ) ষাটগুম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর সুদূর চট্রগ্রাম, মতামত্মরে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে পাথর ভাসিয়ে এনেছিলেন। ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
মসজিদের ভিতরে পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাব আছে। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং তুলনা মূলক অধিক কারুকার্যমন্ডিত। এ মিহরাবের দক্ষিণে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে। শুধু মাঝের মিহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে একটি ছোট দরজা।
ধারণা করা হয়, খান-ই-জাহান এই মসজিদটিকে নামাযের কাজ ছাড়াও দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন, আর এই দরজাটি ছিলো দরবার ঘরের প্রবেশ পথ। আবার কেউ কেউ বলেন, মসজিদটি সেসময় মাদ্রাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হত।
মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে। মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা। পশ্চিম দিকের প্রধান মেহরাবের পাশে ১টি সহ ষাটগুম্বুজ মসজিদের মোট ২৬টি দরজা আছে। মসজিদের ৪ কোণে ৪টি মিনার বা বুরুজ আছে। এগুলোর নকশা গোলাকার এবং এরা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে। এদের কার্ণিশের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড ও চূঁড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে। মিনারগুলোর উচ্চতা, ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি।
সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি ছিলো এবং এখান থেকে আযান দেবার ব্যবস্থা ছিলো। এদের নাম ‘রওশনকোঠা’ ও ‘আন্ধারকোঠা।
মসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলারই পাথর কেটে বানানো হয়েছে। এদের কয়েকটি আবার পাথরের বাহিরাবরণে ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঢাকা ছিল। খুব সম্ভাব মসজিদের প্লাস্টার বিহীন দেওয়ালেন সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য এমনটা করা হয়েছিল।
মসজিদের ইতিহাসঃ
সুলতান নসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান (রঃ) সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খানজাহান তার প্রশনিক রাজধানীতে শাসনকার্য পরিচালনা এবং বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা ষাটগম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদটিতে তুঘলকি ও জৌনপুরী নির্মাণশৈলী সুস্পষ্ট।
প্রয়োজনীয় তথ্য:
পাঁচ বছরের অধিক প্রত্যেকের জন্য ষাটগম্বুজ মসজিদ কম্পাউন্ডে প্রবেশে ফি বাধ্যতামূলক। দেশি পর্যটকদের জন্য ২০ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য ২০০ টাকা, তবে সার্কভুক্ত দেশসমূহের নগরিকদের জন্য ১০০টাকা। আর মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশ ফি (টিকিট) জন প্রতি ৫ টাকা।
ঢাকার সায়েদাবাদ ও গাবতলী বাসস্টান্ড থেকে সরাসরি বাস আছে বাগেরহাটের। সায়েদাবাদ থেকে বাসে সময় ও অর্থ দুটির খরচই কম পড়বে। জন প্রতি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকায় বাগেরহাট পৌঁছানো যায়। প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছাড়ে।
চাইলে গাবতলী বা শ্যামলি থেকেও বাগেরহাটে বা খুলনার বাস ধরতে পারেন। ট্রেনে যেতে চাইলে কমলাপুর থেকে সরাসরি খুলনা, সেখান থেকে বাসে বাগেরহাট আসতে পারবেন।
আর মন চাইলে সময়টা আরও একটু উপভোড় করতে চাইলে সদরঘাট থেকে চেপে বসতে পারে ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল চালিত স্টিমারে। জেলার মোড়লগঞ্জে নেমে সেখান থেকে চলে আসে পারেন বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে।
Support Context:
- বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর
-
যশোর খুলনার ইতিহাস – সতীশ চন্দ্র মিত্র
- বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : খলিফাতাবাদ > বাগেরহাট – প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর
-
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন